মিনিকেট চালের নামে আমরা কী খাচ্ছি

ছবিতে দেখা যাচ্ছে চালে প্রাপ্ত টোটাল ভিটামিন B3-এর ৮৫ ভাগই pericarp-এর মধ্যে। Aleurone layer–টি প্রোটিন ও ফ্যাটে ভরপুর।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে চালে প্রাপ্ত টোটাল ভিটামিন B3-এর ৮৫ ভাগই pericarp-এর মধ্যে। Aleurone layer–টি প্রোটিন ও ফ্যাটে ভরপুর।

বাজারে মিনিকেট নামে যে চাল পাওয়া যায়, সেটি আসলে কী? ‘মিনিকেট’ শব্দটা এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘mini’ ও ‘kit’ থেকে। Minikit আদতে কোনো ধানের ভ্যারাইটি নয়। Minikit হচ্ছে একধরনের প্রোগ্রাম। যেখানে ভারত সরকার মিনি প্যাকেট অর্থাৎ ২ কেজি ধানের বীজের প্যাকেট কৃষকদের উপহার হিসেবে দিত। নতুন কোনো ধানের জাত আবিষ্কৃত হলে, সেটা কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় করতে এই পদ্ধতির ভূমিকা অপরিহার্য।

পরে অবৈধভাবে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে কিছু ধানের জাত বাংলাদেশে এসেছে। তখন ধানের মূল নামের পরিবর্তে ভারতীয় প্রোগ্রামের নামানুসারে বাংলাদেশে মিনিকেট নামের প্রচলন শুরু হয়ে থাকতে পারে। বর্তমানে যেসব চাল মিনিকেট নামে বিক্রি হচ্ছে, এসব আসলে বিদেশি কোনো চাল নয়। বরং যেকোনো দেশীয় জাতের মোটা চালকে ঘষেমেজে চকচকে ও স্লিম করে মিনিকেট নামে বিক্রি করা হয়। বাজারে ব্রাউন ও মোটা চালের চাহিদা অনেক কম থাকার কারণে, মিল মালিকদের অতিরিক্ত দুটি যন্ত্র কিনতে হয় এই মোটা চালকে সরু করার জন্য।

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে, চাল কীভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাজারে আসে, সেটা একটু বুঝতে হবে। প্রথমেই ঘর্ষণের মাধ্যমে ধানের বাইরের খসখসে খোসাটিকে (Husk) আলাদা ও পরবর্তী সময়ে অপসারণ করা হয়। যার ওজন ধানের ওজনের প্রায় ২০ শতাংশ। এরপর ব্রাউন চালকে স্লিম ও চকচকে সাদা করতে হোয়াইটেনার (Whitener) ও পলিশার (Polisher) নামক দুটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এখানেও মূলত ঘর্ষণকে কাজে লাগিয়ে চালের বাইরের বাদামি বর্ণের আব রণটিকে এমনভাবে সরিয়ে ফেলা হয়, যাতে করে চালটি অনেকটাই স্লিম হয়ে যায়। ফলাফল bran অর্থাৎ pericarp, seed coat, aleurone layer ও embryo বা germ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়। এই দূরীভূত হওয়া অংশের ওজন মূল চালের ৮ থেকে ১০ শতাংশ।

সাদা চাল দেখতে সুন্দর, চকচকে, ভাত খেতে মজা, আর চাল টেকেও বেশি দিন। ব্রাউন চালে যে ফসফরাস থাকে, সেটা ‘ফ্যাটিক অ্যাসিড’ হিসেবে থাকে। এই ফ্যাটিক অ্যাসিড শরীরে জিংক গ্রহণে বাধা দেয়। তাই ফ্যাটিক অ্যাসিড দুষ্ট। এটিসহ জিংককে দূরীভূত করাই শ্রেয়। এর বাইরেও, যদি কোনোভাবে ধানটি আর্সেনিক দ্বারা দূষিত হয়ে থাকে, তবে bran অপসারণ করার মাধ্যমে চালের আর্সেনিক দূষণ অনেকাংশে দূরীভূত হয়। লাভেই লাভ, তাই না?

একটু সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলেই বুঝতে পারব ক্ষতিটা কোথায় ও কীভাবে হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাচ্ছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, চালে প্রাপ্ত টোটাল ভিটামিন B3–এর ৮৫ ভাগই pericarp–এর মধ্যে। Aleurone layer–টি প্রোটিন ও ফ্যাটে ভরপুর। চালে প্রাপ্ত টোটাল খনিজের ৫১ ভাগ ও টোটাল আঁশের ৮০ ভাগ এই bran–এর মধ্যে রয়েছে। এর সঙ্গে germটি অপসারণের ফলে, আমরা সিগনিফিকেন্ট পরিমাণ ভিটামিন B1 ও ভিটামিন E হারাচ্ছি। রয়ে যাচ্ছে শুধুই শর্করা। উপরন্তু যখন মাড় গেলে ভাত রান্না করা হয়, তখন আর কীই–বা অবশিষ্ট থাকে সেটাই বড় প্রশ্ন! আর রেস্টুরেন্টগুলোতে মাড় গালা ভাত ঠান্ডা পানি দিয়ে একবার ধুয়ে দেওয়া হয়।

লেখক
লেখক

এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন বলেছিলাম সাদা চাল বেশি দিন টেকে?

প্রথমত, ফ্যাট অংশ না থাকার কারণে চাল rancid হয় না। দ্বিতীয়ত, পুষ্টিকর অংশগুলো অপসারণের ফলে, জীবাণু দ্বারা কম সংক্রমিত হয়। জীবাণুরা আমাদের চেয়ে ঢের ভালো বোঝে, যেখানে পুষ্টি নেই, সেখানে তাদের ইন্টারেস্ট কম।

এভাবে, চালকে সাদা ও স্লিম করার কারণে আমরা গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিনস, খনিজ ও আঁশ হারাচ্ছি। আঁশের পরিমাণ কম থাকার কারণে পরিপাকে খুব তাড়াতাড়ি শর্করা ভেঙে উৎপন্ন চিনি রক্তে চলে যায়। এ কারণে সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক ওপরে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সাদা চাল গ্রহণ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ব্রাউন চাল দৈনিক আঁশের চাহিদার প্রায় এক–সপ্তমাংশ পূরণ করতে সক্ষম। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সেলেনিয়ামের প্রায় এক–চতুর্থাংশের জোগান হতে পারে ব্রাউন চাল থেকে। তাই ব্রাউন চাল শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। হার্টের সমস্যা, ক্যানসার, গলগণ্ড রোগ, অ্যাজমার প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। সর্বোপরি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এ ছাড়া দৈনিক ম্যাংগানিজের চাহিদার প্রায় ৮৮ শতাংশ পূরণ করতে পারে ব্রাউন চাল।

উল্লেখ্য, প্রোটিন সহকারে ব্রাউন চাল খেলে শরীর সহজেই জিংক গ্রহণ করতে পারে। তাই দুষ্ট ফ্যাটিক অ্যাসিড নিয়েও দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, পেট মোটা ব্রাউন চাল খেয়ে স্লিম হবেন, নাকি মিনিকেট চাল খেয়ে নিজের পেট বাড়াবেন?
...

ড. মো. নাহিদুল ইসলাম: খাদ্য গবেষক, ওডেন্স, ডেনমার্ক।
ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: