ইতালিতে করোনা: ‘মৃত্যুভয়’ মানুষকে কীভাবে বদলে দিল

করোনা ভাইরাস
ছবি: রয়টার্স

হঠাৎই ঘোষণা দেওয়া হলো, করোনাভাইরাসের কারণে এখানে স্কুল-কলেজ, জাদুঘর, থিয়েটার, সিনেমা, স্টেডিয়াম, কনসার্টসহ জনসমাগমের স্থান বন্ধ। করোনাভাইরাস চারদিকে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। খুব শিগগির সারা শহর যেন মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ভয়াবহ বিপর্যয় সম্মুখে। বাসায় হিসাব করে দেখলাম বাজারঘাট যা অবশিষ্ট রয়েছে, তা দিয়ে কোনোমতে এক সপ্তাহও পার হবে না। রোগটি প্রচণ্ড ছোঁয়াচে, তাই ছোঁয়াছুঁয়ির হাত থেকে দূরে রাখার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে বিপদে পড়তে হবে ভেবে তড়িঘড়ি গাড়ি নিয়ে সুপারমার্কেটের দিকে রওনা হলাম। একটি অজানা ভয় ঘিরে ধরছিল, যেন কোনো মহামারির মধ্যে হঠাৎ করেই ঢুকেছি কিংবা চারদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। শহরে হঠাৎ কারফিউ জারি হতে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে মানুষের অস্থির পদচারণ, যেন কিছুক্ষণের মধ্যে সবাইকে যার যার গৃহে অবস্থান করতে হবে। সন্ধ্যা প্রায়, আবছা আলোয়, অস্থির হাতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় ভুলক্রমে প্রায় দুর্ঘটনার কবলে পড়তে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম। সুপারমার্কেটে এসে তাড়াহুড়ো করে ট্রলি নিয়ে ঢুকতে যাওয়ার সময় দেখা গেল বিশাল বড় লাইন। কে কার আগে বাজার করবে, তা–ই নিয়ে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। সন্ধ্যা সাতটার সময় সুপারমার্কেটগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

পরদিন থেকেই সুনসান নীরবতা! রাস্তাঘাট হঠাৎই ফাঁকা। আমরা সবাই বাসায় আটকা পড়ে গেলাম অনির্দিষ্টকালের জন্য। সময় যেন থমকে গেছে, এক দিন চব্বিশ ঘণ্টা নয়, যেন আটচল্লিশ ঘণ্টা, সুদীর্ঘ সময়! অস্থিরতা নিজেকে গ্রাস করে ফেলল। প্রথমে মনে হচ্ছিল, হয়তো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লোকজন কিছুটা বাড়াবাড়ি করছে। এরপর যত দিন যেতে লাগল, সত্যিকারের পরিস্থিতি সামনে আসতে শুরু করল। আশপাশের অনেক লোকজনের আক্রান্ত হওয়ার খবর কানে এল। সরকার ৬৯ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে দিল। আমার ঠিক পাশের ভবনগুলোয় মাঝেমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামার শব্দ শুনতাম। রোগী নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।

করোনাভাইরাস পরীক্ষা
প্রতীকী ছবি


একদিন সকালে আমার এক ইতালিয়ান বান্ধবী, নাম গাব্রিয়েলা, কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে জানাল, তার বাবা করোনা পজিটিভ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। অ্যাম্বুলেন্সে করে ডাক্তার এসে তার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, কখনো ফিরবে কি না, কে জানে। তারা কেউ তার বাবার সঙ্গে যেতে পারেনি। এর চেয়ে বড় কষ্টের আর কী হতে পারে? বাবাকে আর কখনো দেখতে পারবে কি না কিংবা তাদের মধ্যে আর কখনো কি ফিরে আসবে—এ কথা বলেই সে ফোনে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল।

হঠাৎ অনুভব করতে শুরু করলাম, যখন কোনো মহামারি শুরু হয়, মানুষ এভাবেই নিজেকে অসহায় বোধ করে? একবিংশ শতাব্দীতে এসে ও ঠিক এভাবে আমরা অসহায়? আমরাই বলেছিলাম, ‘বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয়!’
আমার ‘ডে কেয়ার সেন্টারে’ যাওয়া বন্ধ। কাজের ওখানে প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রতিদিন খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। ঘরে বসেই টেলিফোনে দেশের সবার খবর নিই, দেশের জন্য প্রচণ্ড টেনশন হতে শুরু করল।

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

এর মধ্যে একদিন বাঙালি এক ভাবি ফোন দিয়ে কিছু টাকা ধার চাইলেন। তাঁর বর রেস্তোরাঁ চাকরি করতেন। করোনার কারণে রেস্তোরাঁগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকাতে ঠিকমতো বেতন পাচ্ছিলেন না। অনেকে সরকারি অর্থ পেলেও সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। সরকার বেতনের ৭০ শতাংশ দিচ্ছে, কিন্তু যাদের একজনের বেতনে সংসার চলে, তাদের মাস শেষে পুরো বেতনে হাত টান শুরু হয়ে যায়। সেখানে ৭০ শতাংশ বেতনে কীভাবে পুরো মাসের খরচ চালাবে? তার ওপর তাঁরা প্রত্যেক মাসেই দেশে বসবাসরত বাবা-মাকে হাত খরচের কিছু টাকা পাঠান।

দুই সপ্তাহ পরে বাসার বাজার শেষ, বাজার না করলেই নয়। হঠাৎই গুজব শুনলাম খাবারের জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুপারমার্কেটে গিয়ে দেখি, বিশাল বড় লাইন। একজন বের হলে আরেকজন প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছে, সবার ভেতরেই অস্থিরতা। সবার মুখেই মাস্ক, এরপরও সবাই মিটারখানেক দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটাচলা করছে। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা, চারদিকে থমথমে পরিস্থিতি। এর মধ্যে এক নারী অন্য আরেকজনের একটু বেশি কাছে ঘেঁষতেই তার সঙ্গে রুক্ষ আচরণ করে উঠল! ‘মৃত্যুভয়’ মানুষকে কীভাবে বদলে দেয়!

লেখক

২.
এখন শুধু নিজেদের জন্যই ভয় নয়, বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনকে নিয়েও মনে ভয়, কখন কার মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছায়, এ ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকি। একদিন ব্যালকনিতে বসে আছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম আশপাশের ব্যালকনি থেকে লোকজন একে অপরকে এ বিপদের সময় সহমর্মিতা জানানোর উদ্দেশ্যে ইতালিয়ান জাতীয় সংগীতসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় সংগীত সমস্বরে গেয়ে উঠেছে। নাগরিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতীকী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমরা ও হাততালি দিয়ে তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলাম। ২০ মার্চ ২০২০, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো ইতালির ইতিহাসে সব রেডিওতে বেলা ১১টার সময় চারটি জনপ্রিয় সংগীত সম্প্রচার করা হয়।

গৃহবন্দীর ওই সময়ে চারদিকে শুধু মৃত্যুর খবর। টেলিভিশনে মৃত্যুর খবর ছাড়া আর কোনো খবর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এর মধ্যেও প্রকৃতি নিজেকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে যেন। একদিকে যেন প্রকৃতি ধ্বংসে ব্যস্ত, আবার অন্যদিকে এ ধ্বংসস্তূপের ওপরই কিছু উপহার এ মনুষ্যসমাজকে দিয়েছে। মানুষের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রকৃতি ধীরে ধীরে তার শূন্যস্থানগুলো পুনরুদ্ধার করতে আরম্ভ করেছে। কোথাও বুনো শুয়োরগুলো রাস্তার ওপর তার বাচ্চাদের নিয়ে খেলায় মেতেছে, আবার কোথাও হরিণদের দেখা গেছে ঠিক রাস্তার পাশেই।
পর্যটকদের ভিড়ে সয়লাব হয়ে থাকা ভেনিসের জল, পর্যটকদের অনুপস্থিতির কারণে কয়েক শতাব্দীর মধ্যেও এত স্বচ্ছ দেখা যায়নি। সমুদ্রের তীরে ডলফিনদের খেলাধুলা করতে দেখা গেছে।

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

৩.
‘শেষ হইয়া ও যেন হইলোনা শেষ’—গত অক্টোবরে থেকে আবার নতুন করে করোনার প্রভাব দেখা গেল ইতালিতে। এবার যেন আরও নির্মম হয়ে আঘাত হানার জন্য ভাইরাসটি ফিরে এসেছে।

নভেম্বরের ২০ তারিখ। হঠাৎ ঘুম ভাঙল আমার প্রিন্সিপালের ফোন পেয়ে। ‘খবর শুনেছ? মাত্তেও মারা গেছে।’ সকাল সকাল এমন খবরে আঁতকে উঠলাম। মাত্তেও! সাত বছর আমি এই ডে কেয়ার সেন্টারে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করি। প্রথম দিন থেকেই আমি মাত্তেওকে চিনি। সমুদ্রের স্বচ্ছ জলের মতো গভীর নীল চোখের, চমৎকার একটি ছেলে। হাসিখুশি তার মুখ, হুইলচেয়ারের ওপর থাকত, জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী, হাঁটার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু কথা বলতে পারত। সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে নানা খুনসুটি করত। একবার আমি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিয়ে কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিলাম। এ দেখে মাত্তেওর সে কী হাসি! যেন থামতেই চায় না!
খবর শুনেছিলাম, মাত্তেওকে কিছুদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এক মাস পর অনেকটা সুস্থ হয়ে সে বাসায়ও প্রবেশ করেছিল! সে মাত্তেও বাসায় প্রবেশের মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় আমাদের ছেড়ে চলে গেল! সে নীল চোখের, হাসিখুশি মাত্তেও!
এর মধ্যেও দু–একটা ভালো খবর কানে আসতে শুরু করল। আমার বান্ধবী গাব্রিয়েলার বাবা দীর্ঘ নয় মাস হাসপাতালে কাটানোর পর বাসায় ফিরেছে। এ নয় মাস সে তার বাবাকে দেখতে পায়নি। তার বাবার কাছে ঘেঁষতে পারেনি। তার বাবা ফিরে আসবে—এমন সম্ভাবনা তারা মন থেকে মুছে ফেলেছিল। আজ সে আমাকে ফোন দিয়ে জানাল, তার বাবা গৃহে প্রবেশ করেছে। যদিওবা হুইলচেয়ারে থাকতে হচ্ছে, এরপরও বেঁচে আছে, এটাই তাদের সবচেয়ে বড় পাওনা। তারা বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল।
এই তো জীবন, আনন্দ আর কষ্টের পাশাপাশি সহাবস্থান। ফেব্রুয়ারির পর যখন গ্রীষ্ম এল এবং করোনারি প্রভাব কমে গেল, ভেবেছিলাম হয়তো জীবনযুদ্ধের এখানেই ইতি। কিন্তু সে চিন্তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আবার করোনা মহামারির আকারে আমাদের আঘাত হানল।

ব্যাকুল হৃদয় তবু মানতে চায় না। বেঁচে থাকাটাই সৌভাগ্য। বহুদিন প্রবাস জীবনে থেকে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য মন অস্থির হয়ে থাকে। তবু আমাদের হাত-পা বাঁধা। কোনো অন্ধকার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি, কবে হবে আমাদের মুক্তি?

লেখক: শারমিন প্রহেলিকা, শিক্ষক, ডে কেয়ার সেন্টার, ইতালি