মেয়েবেলার এ দেশ–সে দেশ

ছোটবেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে, ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর এলাকাগুলোর একটিতে, খুব সুন্দর একটি পারিবারিক পরিবেশে বড় হওয়া তারিন কখনো দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি। বাংলাদেশের খুব অল্প যে সংখ্যক মেয়ে পরিবারের ছেলেটির সম–অধিকার নিয়ে বড় হয়, সে ছিল তাদেরই একজন। পড়াশোনা শেষ না হতেই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চাকরি আর সদ্য সমাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রি নিয়ে সে জানত দেশেই খুব সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব তার পক্ষে। কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায়ই বলুন আর এক ভালোবাসার মানুষের টানেই বলুন মেয়েটিকে পাড়ি দিতে হলো সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়।

প্রথম একটা বছর কি অসম্ভব মন খারাপ করা দিনগুলো তারিনের। পড়া আর দিনরাত চাকরির চেষ্টা। ভালো লাগত না সে দেশে মোটেই। মনে হতো, নিজের দেশটাই তো অনেক ভালো ছিল, সবকিছু কত সহজ ছিল। নিয়ে আসা জমানো টাকাও ফুরিয়ে যাচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিল যেকোনো একটা চাকরিতে ঢুকে যাবে, তা সে যে কাজই হোক না কেন। যোগ দিল একটি প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার সার্ভিস বিভাগে। যেটি বাসা থেকে দূরে ছিল। ট্রেন–বাস মিলিয়ে যেতে দুই ঘণ্টার বেশি লাগত। কাজ শুরু হতো সকাল সাতটায়। বাসা থেকে বের হতে হতো ভোর পাঁচটারও আগে। শীতের সেই সময়টায় তখন গভীর অন্ধকার। বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে ট্রেন স্টেশন যেত। রাস্তাটা থাকত জনমানবহীন নিস্তব্ধ অন্ধকার। বেশ কিছুদিন পর একদিন ট্রেনে বসে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে তার মনে হলো, এই যে সে অন্ধকারে এতটা পথ হেঁটে আসে প্রতিদিন, আবার রাতে একা বাসায় ফিরে, কই কোনো দিন কেউ তো পিছু নেয় না, ভয় দেখায় না, মেয়ে বলে জ্বালাতন করে না। সে নিজের মতো চলাচল করে। রাস্তায় কিংবা ভোরের খালি ট্রেনে কারও সঙ্গে দেখা হলে তারা হয়তোবা একটু হেসে ‘শুভ সকাল’ বলে। তার বাংলাদেশে নিজের মেয়েবেলার কথা মনে পড়ল, যখন সে গভীর রাতে একা বের হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারত না, অদ্ভুত এক নিরাপত্তাহীনতা ঘিরে রাখত তাকে সর্বক্ষণ। আর ঠিক তখনই সে বুঝতে পারে, একটা দেশ উন্নত দেশ কি না, সেটা তার বিলাসবহুলতা কিংবা জাকজমক দিয়ে প্রকাশ পায় না। সেটা প্রকাশ পায় সেই দেশে একটি মেয়ে কতটা নিরাপদ, সেটা দিয়ে। তা সেদিন রাত যখনই হোক না কেন, আর সে মেয়েটি যে পোশাকই পরে থাকুক না কেন।

উন্নয়ন মানে সীমিত কিছু মানুষকে সব সুবিধা দেওয়া নয়, বরং সম্পূর্ণ জনগণের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন। তারিনের মনে হলো, সত্যি তো এই এত দিনে সে তো রাস্তায় কোনো অভুক্ত মানুষ কিংবা পথশিশু দেখেনি। চারদিকে হয়তোবা বিলাসের ঘনঘটা নেই, কিন্তু সাম্য আছে। পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে সততার আনন্দও আছে।
ওর সহকর্মী থমাসের ডাকে চমকে তাকাল তারিন। ‘কী ভাবছ বিভোর হয়ে?’ জিজ্ঞেস করল থমাস। ‘নাহ, এ দেশে আসার পরের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম। পাঁচ বছর হয়ে গেল! নিজের পছন্দমতো চাকরিতে ঢুকেছি তা–ও তিন বছরের বেশি, কিন্তু প্রথম দিনগুলো আজও মনে পড়ে।’ উত্তর দিল তারিন।
‘সত্যি মাইগ্রেশন খুব কষ্ট। আমার বাবাও ইংল্যান্ড থেকে এ দেশে এসেছিলেন।’ বলল থমাস। ‘যাই হোক, চলো চলো, আজকে যে ফাইনান্স ও এইচআর ডিপার্টমেন্টের মিটিং, ভুলে গেছ?’ তারিনকে তাড়া দিল থমাস। ‘মনে আছে।’ হাসল তারিন।
তাড়াতাড়ি মিটিংয়ের কাগজপত্র গোছাতে থাকল তারিন আর ভাবতে থাকল সেই ফেলে আসা জন্মভূমির কথা, যেখানে তার অনেক অনেক ভালোবাসার মানুষেরা! সেই দেশটি কবে সত্যিকারের উন্নত দেশ হবে? সেই দেশে কবে একটি মেয়ে নিরাপদে বাঁচতে পারবে?