রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত ধরে...

অতিমারির দীর্ঘ প্রায় দুই বছরের স্থবিরতা কাটিয়ে জীবন আবার সচল হতে শুরু করেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। এত দিন থেমে থাকা সব আয়োজন এখন সরাসরি প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে সশরীর, সরব উপস্থিতিতে। লন্ডনেও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, সব নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই শিথিল হয়ে সবার সঙ্গে মেলার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। সবার সঙ্গে পুনরায় মিলিত হওয়ার এ স্বাধীনতাকে উদ্‌যাপনে রূপ দিয়েছে লন্ডনের সাংস্কৃতিক সংগঠন আনন্দধারা আর্টস।

‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত ধরে’ শিরোনামে ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনের পপলার ইউনিয়নে আনন্দধারা আর্টস সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করে। চমৎকার এ আয়োজনকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পর্বে ভাগ করে সাজানো হয়েছে।

প্রথম পর্বে ছোটদের ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যের অংশবিশেষের উপস্থাপন সবাইকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। গীতিনাট্যের আঙ্গিকে ছোটদের সাজসজ্জা ছিল দৃষ্টিনন্দন। এ সাজসজ্জা এবং গীতিনাট্যটির ভাবানুবাদ করেছেন লেখক, শিল্পী কান্তা তাজরীন।
এ মুগ্ধতার রেশ না কাটতেই মঞ্চে এসেছে আনন্দধারা আর্টসের বড়দের গানের দল দ্বিতীয় পর্বের উপস্থাপন নিয়ে। বড়দের সম্মিলিত সংগীত, রবীন্দ্রনাথের পাঠ এবং চমৎকার সঞ্চালনা মিলিয়ে পর্বটি হয়ে উঠেছিল ভীষণ উপভোগ্য। এ আয়োজনের চমৎকার সঞ্চালনা করেছেন সমর সাহা, রবীন্দ্রনাথের পাঠ থেকে ইংরেজিতে অনূদিত ভাব পড়েছেন প্রখ্যাত কবি জন বেকার। আরও আবৃত্তি করেছেন ইয়াসমিন মাহমুদ পলিন, সিনথিয়া দাস ও সুনিতা চৌধুরী।

মনোমুগ্ধকর এ আয়োজনের সমাপ্তি পর্বটি অসামান্য। এ পর্বে আনন্দধারা আর্টসের কর্ণধার মূলধারার রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ড. ইমতিয়াজ আহমেদের অনবদ্য পরিবেশনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে দেশাত্মবোধ যতটা প্রকাশিত, ঠিক ততটাই প্রবল তাঁর বিশ্বমানব চরিত্র। তাঁর মৌলিক রচনার ব্যাপ্তি যেমন বিস্তৃত, তেমনি বৃহৎ তাঁর সারা পৃথিবী থেকে আহরণ করা অভিজ্ঞতাকে নিজস্ব ভাবনা বা আঙ্গিকে মেলে ধরার ক্ষমতা। আমাদের সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মিল ঘটিয়ে নতুন একটি ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। ড. ইমতিয়াজ রবীন্দ্রনাথের গানের বিশাল সম্ভার থেকে সেসব গানগুলোকে বেছে নিয়ে পরিবেশন করেছেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমাত্রিক সত্তাটির সন্ধান মেলে। গানের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী গানগুলোর তথ্যের পাশাপাশি এগুলোর ভাব এবং আমাদের মনে ও মননে তার প্রভাব নিয়ে ছোট ছোট কথামালা জুড়ে পরিবেশনাটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছেন। এ আয়োজনের অন্যতম সুন্দর বিষয় ছিলো যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যবহার। পিয়ানো, বেহালা, তবলা, গিটারের চমৎকার সমন্বয় পরিবেশনাটির ভীষণ সাজুয্যপূর্ণ। সংগীতশিল্পী এবং পিয়ানোবাদক অমিত দে চমৎকার বাজিয়েছেন, সেই সঙ্গে মুগ্ধ করেছে রস বার্জেসের বেহালা, পিয়াস বড়ুয়ার তবলা এবং মিলন বিশ্বাস ও তানজিল তাহমিদের গিটারের মিলিত প্রয়াস। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রানুসঙ্গর পরিমিত ব্যবহার এ আয়োজনে লক্ষণীয়।

আয়োজনটি সমাপ্ত হয়েছে ড. ইমতিয়াজ আহমেদের ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’ গানটির মধ্য দিয়ে। এ চরম দুর্যোগের দিনে শোক, সংকট, বিচ্ছেদ–যাতনা কাটিয়ে আর্ত মানুষের হৃদয় যেন এ গানের ভেতর স্বস্তির আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। শিল্পীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতে গাইতে শ্রোতাদের অনেকের চোখ ভিজে উঠছিল।

আসনস্বল্পতার জন্য সব দর্শকের স্থান সংকুলান হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই আয়োজনের কান্ডারি ইমতিয়াজ আহমেদ। কিন্তু ফেসবুক লাইভে এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ায় একদম বঞ্চিত হতে হয়নি শ্রোতাদের। অসামান্য এ আয়োজন শেষে দর্শক–শ্রোতা বাড়ি ফিরেছেন এক নিবিড় প্রশান্তি নিয়ে। এমন আয়োজন বিদেশের মাটিতে বারবার হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে বলেই মনে করছেন অভিজ্ঞ দর্শকমহল।