রুয়ান্ডায় অন্য রকম ঈদ

ঈদ উপলক্ষে অনেক দিন পর একসঙ্গে প্রবাসীরা। ছবি: লেখক
ঈদ উপলক্ষে অনেক দিন পর একসঙ্গে প্রবাসীরা। ছবি: লেখক

বিশবিশের (২০২০) শুরুতে সবাই যখন ‘শুভ নববর্ষ’ বলে পরস্পরকে সম্ভাষণ শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম, তখন ভুলেও কি কারও মনে এসেছিল যে করোনা নামের ভাইরাস এসে জীবনকে এভাবে এলোমেলো করে দেবে। একসঙ্গে বসে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী মিলে আনন্দ করতে পারব না। মন চাইলেই হাওয়ায় উড়তে পারব না, যখন মন যা চায়, তা করতে পারব না। এমনকি মসজিদে প্রার্থনায় যেতেও একাধিকবার ভাবতে হবে বা চিন্তা করতে হবে যে নামাজ পড়া যাবে তো? অথবা কর্তৃপক্ষ নামাজ পড়ার অনুমোদন দেবে তো? কোনো ঝামেলায় পড়ব না তো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু তাই যেন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাইরে বেরুতে গেলেই চিন্তা, গাড়ি চড়তে চিন্তা। কারও সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতেও যেন কেমন এক চিন্তা মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বা রাখছে। কিছুই যেন আগের মতো করা যাবে না এবং একেবারে সীমার মাঝে বন্দী হয়ে থাকাটা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে।

ঈদের দিনে প্রবাসীরা। ছবি: লেখক
ঈদের দিনে প্রবাসীরা। ছবি: লেখক

করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষের মতো পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার মানুষজনও যে নিশ্চিতই একই অভিজ্ঞতা অর্জন করে চলেছেন, তা আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। হোক তা চাকরি করতে আসা বা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা, সবার ক্ষেত্রে ওই একই অবস্থা বিরাজমান।

ধরুন, এবারের রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের দিনে কোনো ধরনের সংক্রমণ রোধের লক্ষ্যে ঈদের জামাত একেবারে নিষিদ্ধ ছিল বিধায় মসজিদে বা ঈদগাহতে নামাজ পড়তে যাওয়ার কথা চিন্তাও করা যায়নি। কিন্তু ঈদুল আজহার সময় যেহেতু সর্বস্তরে কিছুটা নমনীয় ভাব এসেছিল এবং তা ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে ঈদুল আজহার নামাজ মসজিদে বা জামাতে আদায় করা সম্ভব হবে।

ঈদে অনেক দিন পর একসঙ্গে প্রবাসীরা। ছবি: সংগৃহীত
ঈদে অনেক দিন পর একসঙ্গে প্রবাসীরা। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না যে নামাজের আগে মসজিদ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে নামাজের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করতে হবে। তাই না জেনেই নামাজের জন্য যথাসময়ে মসজিদে হাজির কিন্তু নাম না থাকায় ঢুকতে মানা, যদিও মসজিদসংশ্লিষ্ট কোনো একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢোকার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু বিধিবাম হলে যা হয় তা-ই ঘটলে এবং নামাজ শুরু হওয়ার আগেই ইমাম সাহেব এসে অনুরোধ করলেন, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মুসল্লির সংখ্যা থেকে বর্তমান উপস্থিতির সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়াতে আমাদের বের হয়ে যেতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিতই সেনসিটিভ এবং এ বিষয়ে কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ সরকার থেকে যেভাবে অনুমোদন বা পরামর্শ এসেছে এর বাইরে যাওয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। কারণ এটাই এখানকার প্র্যাকটিস এবং কোনো প্রভাবশালী নেতা বা সরকারি কর্তা যিনিই হোন না কেন, কারোরই সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

তবে বের হওয়ার সময় ব্যক্তিগতভাবে ইমাম সাহেব ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পরামর্শ দিয়ে জানতে চাইলাম, আমরা চলে যাব এতে কোনো সমস্যা নেই তবে দ্বিতীয় জামাতের ব্যবস্থা করা যাবে কি না? বিষয়টা ইমাম সাহেবসহ অন্যদের মনে ধরল এবং তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। যদিও আমরা কয়েকজন বাংলাদেশি/পাকিস্তানি এবং স্থানীয় ২/৪ জন মুসল্লি ছাড়া বাকিরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা না করে চলে যাওয়াতে মাত্র ৯ জন নিয়ে দ্বিতীয় জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

পরম করুণাময় আল্লাহ তা আলার প্রতি শুকরিয়া যে প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় আমাদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।

ঈদের দিনে ছোট্ট শিশুরা একসঙ্গে। ছবি: লেখক
ঈদের দিনে ছোট্ট শিশুরা একসঙ্গে। ছবি: লেখক

বাংলাদেশিদের কয়েকজন মিলে গরু কোরবানির আয়োজনও করা হয়েছিল। যদিও নিজ বাড়িতে/বাসায় কোরবানির কার্যক্রম সীমাবদ্ধতার কারণেই করা যায়নি। গরু নিয়ে শহরের ভেতরের রাস্তা দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া নিষিদ্ধ করা আছে (যা আমাদের দেশে প্রায় অসম্ভবই বলা যায়) এবং তাই কোরবানির জন্য নির্ধারিত স্থানেই গরু জবাই করানো হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে তা এক জায়গায় এনে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে কোরবানির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল।

মোটের ওপর ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার দিনটা বেশ ভালোই কেটেছে। কারণ, অনেক দিন পর অন্তত আমাদের ৫-৬টি পরিবার এই দিনে একসঙ্গে মিলিত হয়ে এবং প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এর জন্য সাদত অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে দুঃখ একটাই আর তা হলো, বিগত কয়েক বছর অন্তত কোরবানি ঈদের সময়টা দেশে থাকতে পারলেও এবার বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণেই দেশে যাওয়া হলো না। আগামী দিনে অবস্থার উন্নতি হবেই হবে, ইনশা আল্লাহ।

ঈদুল আজহার কল্যাণে ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দুনিয়ার সব মানুষের জীবন প্রশান্তিতে ভরে উঠুক, এই কামনা রেখে শেষ করছি ।