টিনের স্লেট

এসফিল্ড পার্কের বইমেলা থেকে কেনা বাংলা বই
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের সময় লেখাপড়ার হাতেখড়ি হতো আদর্শলিপি বই আর টিনের শ্লেটে চক দিয়ে লেখার মধ্য দিয়ে। ক্লাসের হিসাবে তখন ছোট ওয়ান, বড় ওয়ান, তারপর ক্লাস টু।

অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে। ১, ২ নিয়েও এই রকম ছড়া ছিল, যেটা এখন আর ভালোভাবে মনে করতে পারছি না। হাট থেকে আব্বা সস্তার টিনের শ্লেট এনে দিতেন, সঙ্গে হয়তোবা এক–দুটি চক। কিন্তু অনেক বেশি লেখার কারণে দু–এক দিনের মধ্যেই চকটা ক্ষয় হয়ে যেত। তখন মায়ের কাছে বায়না ধরতাম নতুন চকের জন্য। কিন্তু মায়ের হাতে বেশির ভাগ সময়ই পয়সা থাকত না।

তখন মা আমাদের চক বানানোর একটা সহজ উপায় বাতলে দিতেন। গোসল করতে গিয়ে আমরা পুকুরের পাড় থেকে নরম এঁটেল মাটি দলা বানিয়ে তুলে আনতাম।

তারপর সেটা প্রথমে ছেনে হাতের তালুতে নিয়ে মাটির ওপর ঘষে ঘষে লম্বা আকৃতি দিতাম। এরপর রোদে শুকিয়ে সেগুলোকে মাটির চুলাতে রান্নার শেষে যে আগুন থাকে, সেই আগুনে ফেলে ঢেকে দিতাম। এরপর একসময় মা সেই আগুনের ছাইগুলোকে ফেলার সময় বেছে বেছে চকগুলোকে আলাদা করে দিতেন। হাতে বানানো এই চকগুলো সাধারণ চকের মতো অতটা মোটা হতো না। আর এগুলোর বর্ণও সাধারণ চকের মতো সাদা হতো না; বরং মাটির রং অনুযায়ী একেকটা একেক রঙের হতো। সেগুলো দিয়ে আমরা লিখতাম। আর লেখা মুছে ফেলার জন্য মা পুরোনো কাপড়ের একটা ছোট পুঁটলি বানিয়ে দিত। সেটা পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে মোছার এবং পুনরায় লেখার কাজটা চলত। একেকটা অক্ষর লেখার পর আমরা সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতাম কারটা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে।

আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। এরপর কোরাসে ওপরের ছড়াগুলো পড়তাম। আর স্যার, আপারা লিখতে দিলে কে কার আগে লিখে স্যারকে দেখাতে পারে, সেটা নিয়ে আমাদের মনে একধরনের প্রতিযোগিতা কাজ করত। লেখা জমা দেওয়ার ব্যাপারে আমি বরারই সবার আগে থাকতাম। একটা জমা দেওয়া হয়ে গেলে অন্য লেখাটা নিয়ে আগেই স্যারের টেবিলের পাশে ঘুর ঘুর করতাম।

এমনই একদিন কোনো কারণে আমি সবার আগে লেখাটা জমা দিতে পারলাম না। আমার আগেই প্রবাল নামের অন্য ছেলে লেখাটা জমা দিয়ে দিল। সেটা দেখে আমার প্রচণ্ড রাগ হলো ছেলেটার ওপর। সেই রাগ ঝাড়ার জন্য হাতে ধরা টিনের শ্লেট দিয়ে ওর মাথা বরাবর একটা ঘা বসিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে ওর মাথা থেকে রক্ত বের হয়ে এল। সারা ক্লাস রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। স্যার, ম্যাডাম সবাই তখন ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি সুযোগ বুঝে দ্রুত ক্লাস থেকে বের হয়ে বাড়ি গিয়ে মায়ের অজান্তে সোজা খাটের তলায় ঢুকে পড়লাম। এরপর প্রবালের পুরো পরিবার বাড়ি এসে মায়ের কাছে নালিশ দিল। এরপর অবধারিতভাবেই আমার কপালে জুটেছিল মায়ের বকুনি।

এসফিল্ডের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ

পাড়ার সম্পর্কে প্রবালের মাকে আমরা কর্তা, মানে দাদি বলে ডাকতাম। সেই হিসেবে প্রবালের সঙ্গে আমাদের চাচা-ভাতিজার সম্পর্ক। একই ক্লাশে পড়া ছাড়াও পাড়াময় দাপিয়ে বেড়াতাম দল বেঁধে। আর সব ধরনের কাজেই আমরা দুজন দলনেতা হয়ে বসতাম। বড় হয়ে যাওয়ার পর একদিন প্রবালের সঙ্গে দেখা। ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করতেই প্রবাল বলল, ‘ভাতিজা, কী যে এক ঘা দিছিলা, এখনো আমার মাথার ওই জায়গায় চুল ওঠে নাই।’ বলে মাথাটা আমার দিকে ঝুঁকে দিল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যিই ওর মাথার মাঝামাঝি অনেকখানি জায়গাজুড়ে গড়ের মাঠ। এভাবেই আমাদের লেখাপড়ার পাঠ শুরু হয়েছিল।

এরপর নিজে সন্তানের পিতা হলাম। তখন মনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ভাবনা কাজ করছিল, যদি আমাদের মেয়ে তাহিয়াকেও ছোটবেলার মতো আদর্শলিপি আর শ্লেট দিয়ে লেখাপড়াটা শুরু করাতে পারতাম। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে উত্তরার আজমপুর ওভারব্রিজের নিচের ফুটপাত দাঁড়ালাম। সেখানে সোবহান ভাইয়ের একটা অস্থায়ী দোকান। সেখানে বিভিন্ন প্রকার পত্রিকার পাশাপাশি দৈনন্দিন বইপুস্তক, এমনকি বড় বড় উপন্যাসের বইও পাওয়া যায়। সোবহান সাহেবকে ইচ্ছার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই উনি প্লাস্টিকের মোড়কে বাঁধানো রংচঙা একখানা আদর্শলিপি ধরিয়ে দিলেন। আদর্শলিপি তো সহজেই জোগাড় হয়ে গেল। আর মুদিদোকান থেকে নিয়ে এলাম চকও। কিন্তু গোল বাধল শ্লেট খুঁজতে গিয়ে। শ্লেটের চল উঠেই গেছে তখন।

অনেক খোজাঁখুজি করেও শ্লেট জোগাড় করতে পারলাম না। এর মধ্যেই একদিন অফিসের কাজে একবার খুলনা গিয়েছিলাম। সাইটের কাজ পরিদর্শন শেষ করে ফিরছিলাম এক বিকেলে। ডুমুরিয়া বাজার পার হতে হতেই মনে পড়ল, ছোটবেলায় আব্বা তো হাট থেকেই আমাদের শ্লেট কিনে এনেছিলেন। ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলে হয়তোবা টিনের শ্লেট পেয়ে যেতে পারি। বাজার পার হয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাজারে গিয়ে বিভিন্নজনকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম, এখানে কোথাও শ্লেট পাওয়া যায় কি না। একজন বললেন, বাজারের মাঝামাঝি একটা বই–খাতার দোকান আছে, ওখানে দেখতে পারেন। আমি খুঁজে খুঁজে অবশেষে দোকানটা পেয়ে গেলাম। দোকানিকে আমার ইচ্ছার কথা বলতেই উনি বললেন, ‘আমার কাছে শ্লেট আছে, তবে সেটা টিনের নয় প্লাস্টিকের।’ আমি দেখাতে বললাম। উনি বের করে দেখালেন। শ্লেটটা হুবহু শৈশবের টিনের শ্লেটের মতো, কিন্তু প্লাস্টিকের তৈরি। এরপর সেটাই কিনে নিয়ে এলাম এবং মেয়েকে লেখাতে শুরু করলাম। মেয়ে এটা পেয়ে খুবই খুশি হলো। একই লেখা বারবার লেখে আর মুছে ফেলে আবার লেখে। এভাবেই ও একসময় বাংলা বর্ণমালা থেকে শুরু করে অঙ্ক—সবই লেখা শিখে গেল। এরপর ফেব্রুয়ারি মাস এলে ওকে বললাম, ‘আমাকে একুশ লিখে দেখাও।’ ও তখন আমাকে প্রশ্ন করল, ‘শুধু একুশ কেন?’

শ্লেটে চক দিয়ে লেখা বাংলা বর্ণ

বললাম, ‘কারণ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশের ছাত্ররা বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দাবি করে রক্ত দিয়েছিল। যে কারণে এখন আমি তুমি বাংলায় কথা বলতে এবং লিখতে পারছি।’ সে কী বুঝল জানি না, কিন্তু গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে আমাকে অনেক বড় আকারের একটা ২১ লিখে দেখাল। খুশিতে আমি ক্যামেরায় ওর লেখাটার ছবি তুলে রাখলাম।

এরপর জীবনের বহমানতায় একসময় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলাম। এত দিনে পরিবারে আরও এক সদস্য যোগ হয়েছে, রায়ান। রায়ানও একসময় বড় হয়ে গেল। ওর স্কুলে যাওয়ার ক্ষণও ঘনিয়ে এল। কিন্তু আমার মনে ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের আদলে ওকেও হাতেখড়ি দেওয়ার। সিডনিতে অনেক সংগঠনই সরস্বতীপূজা পালন করে। আমাদের বাসার কাছাকাছি আগমনী অস্ট্রেলিয়া এবং শঙ্খনাদ নামক দুটি সংগঠন পূজা উৎসবগুলো পালন করে থাকে। আমি আগে থেকেই জানতাম, সরস্বতীপূজার সময় হাতেখড়ি দেওয়া হয়, তাই সরস্বতীপূজাকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। চক খুব সহজেই জোগাড় হয়ে গেল, মুশকিল হলো শ্লেট খুঁজতে গিয়ে। অনলাইনে খুঁজেও পেলাম, কিন্তু সেগুলোর ডেলিভারি আসতে আসতে পূজা পার হয়ে যাবে। এরপর সরস্বতীপূজার কয়েক দিন আগে বাসার পাশের মিন্টো মার্কেটপ্লেসের কেমার্ট চেইনশপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শ্লেট পাওয়া যায় কি না? ওরা আমার কথা ঠিক বুঝল না। তখন গুগুল করে শ্লেটের ছবি দেখলে জানাল, ওরা এমনই একটা জিনিস বিক্রি করে, কিন্তু স্টকে আছে কি না, নিশ্চিত নয়।

এরপর আমাকে একটা দিক দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে গিয়ে দেখতে পারেন।’ আমি অনেক খুঁজে একটা জায়গায় অবশেষে শ্লেট পেয়ে গেলাম। সেটা সাধারণ শ্লেটের তুলনায় দ্বিগুণ আকৃতির, কিন্তু শ্লেট তো, তাই নিয়ে নিলাম।

এরপর সরস্বতীপূজার দিন অফিস থেকে অর্ধেক দিন ছুটি নিয়ে এলাম হাতেখড়ি দেওয়ানোর জন্য। বাসায় ফিরে তাহিয়াকে তার স্কুল থেকে আর রায়ানকে তার কেয়ার থেকে নিয়ে শঙ্খনাদের পূজামণ্ডপ মিন্টোর রন মুর কমিউনিটি সেন্টারে চলে গেলাম।

হাতেখড়ির উৎসবটা একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু রবি দাদা জানতেন আমি অনেক দিন ধরে হাতেখড়ির পরিকল্পনা করছি। উনি আমাদের দেখে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ভেতরে যান, রিপন দাদা হয়তোবা এখনো আছেন। ওনাকে বললেই রায়ানকে হাতেখড়ি দিয়ে দেবেন।’ আমরা ভেতরে ঢুকে দেখি, রিপন দাদা বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমাদের ইচ্ছার কথা শুনে কোল থেকে ওনার বাচ্চাকে নামিয়ে দিয়ে এসে হাতেখড়ি দিতে বসলেন। রায়ান এমনিতেই লাজুক। তাই তাকে সাহস দেওয়ার জন্য আমি আর তাহিয়া পাশে বসে পড়লাম। এরপর হাতেখড়ি দেওয়া শেষ হলে রিপন দাদাকে ধন্যবাদ দিয়ে সরস্বতীদেবীর সঙ্গে ওদের ছবি তুলে নিলাম।

এভাবেই প্রবাসেও বাংলা ভাষা তার স্বমহিমায় বেঁচে আছে। প্রবাসে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্য বাংলা ভাষা শিক্ষার অনেকগুলো কমিউনিটি স্কুল আছে অস্ট্রেলিয়াজুড়েই। বাসার পাশেই দ্য গ্র্যাঞ্জ পাবলিক স্কুলেরই কয়েকটি কক্ষে সপ্তাহান্তের রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত চলে বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্লাস।

বাংলা ভাষা শিক্ষার এই স্কুলের নাম ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতির কবিতা, গান, নাচ, নাটিকা—সবকিছুই শেখানো হয়। এ ছাড়া গুরুত্বসহকারে পালন করা হয় বাংলাদেশের সব জাতীয় দিবস।

এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অন্যতম। তাহিয়া এই স্কুলেই তার বাংলা শেখার চর্চাটা অব্যাহত রেখেছিল। এখন পরিকল্পনা করছি রায়ানকেও এই স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার। আমাদের বাসায় বেশির ভাগ আলাপই বাংলাতে হয়, তাই রায়ান এখন ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাটাও বলতে পারে। এখন এই স্কুলে গেলে বাংলা পড়া আর লেখাটাও শিখে যাবে আশা করি।

সিডনিতে হাতেখড়ি দেওয়ার পর তাহিয়া ও রায়ান

অস্ট্রেলিয়ার এসফিল্ড পার্কে রয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ। সেখানে প্রতিবছরই ২১ ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে বইমেলা এবং সাংস্কৃতিক উৎসব হয়। এখানে গেলে কিছুটা হলেও বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির বইমেলার ছোঁয়া পাওয়া যায়। আর নতুন প্রজন্ম জানতে পারে বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং বুঝতে পারে বাংলা ভাষা শেখার গুরুত্ব। এভাবেই বাংলা ভাষা একসময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে যথাযথ চর্চার অভাবে, কিন্তু বাংলা ভাষার বিশ্বব্যাপী চর্চার ফলে সেটা কোনো দিনই হারিয়ে যাবে না বলে আমার বিশ্বাস।

আমাদের শৈশবের টিনের শ্লেটে শেখা ভাষা এখন সময়ের আধুনিক যন্ত্র মুঠোফোন ও কম্পিউটারেও লেখা যায়। এর জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার।

আমরা ছোটবেলায় শ্লেটে লিখে সহজেই মুছে ফেলতে পারলেও এখনকার বাংলা ভাষা কখনোই আর মুছে যাবে না। বরং বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষীরা যেখানেই যাবেন, সেখানেই এই ভাষার বীজ তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে বুনে দেবেন আর তখনই বাংলা ভাষা বিশ্বব্যাপী আরও গুরুত্ব পাবে।