রক পাখি এখন সাহিত্যের উড়াল পঙ্খি

লতিফুল ইসলাম শিবলী
লতিফুল ইসলাম শিবলী

বাংলা রকসংগীতের রক পাখি বললেও তাঁকে ভুল হবে না। নব্বইয়ের দশকে তাঁর গানের কথাগুলো বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরত। রক পাখির মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি তাঁর লেখা গানগুলো দিয়ে। রকসংগীতের সোনালি দিনে গানের এ রক পাখি লিখেছেন বাংলা রকগানের ঝড় তোলা লিরিকগুলো। সে কথার সুরে নিজে উড়ছিলেন, উড়িয়েছিলেন শ্রোতাদেরও। কিন্তু এখন আর গান নিয়ে কথা বলতে চান না। এ যেন ভিন্ন কেউ। বললেন, ‘গান নিয়ে কোনো কথা না’। গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলীর কাছ থেকে এমন কথা যেন একদমই মানায় না।
আপাদমস্তক একজন গানের মানুষ হিসেবেই সবার কাছে তাঁর পরিচিতি। লতিফুল ইসলাম শিবলীর এবারই প্রথম আমেরিকা সফর। এসেছিলেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত নিউইয়র্ক বইমেলায়, আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন লতিফুল ইসলাম শিবলী।
যা কথা বললেন, সব বই নিয়েই বললেন। জানালেন, পরিচয় পাল্টে ফেলেছেন এখন আর গীতিকার না, কথাশিল্পী তিনি। শুরুও হয়েছিল সাহিত্যের পথে হেঁটে মঞ্চনাটক দিয়ে। অভিনয়ও করেছিলেন মঞ্চনাটকে। এরপর মাঝপথে নতুন পথ ধরে হয়ে উঠেছিলেন গীতিকার। লতিফুল ইসলাম শিবলীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা তাঁকে গীতিকার হিসেবেই চেনেন। তিনি যে নাটক লিখেছেন, নাটকে অভিনয় করেছেন, মডেলিং করেছেন, তার কাহিনি অবলম্বনে সিনেমাও হয়েছে। ব্যান্ড সংগীত নিয়ে গবেষণাও করেছেন তিনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে লতিফুল ইসলাম শিবলীর পরিচিতি গীতিকার হিসেবেই। পুরোনো এসব পরিচয় ঝেড়ে শিবলী এবার পুরোদস্তুর লেখকই হতে চান।
লেখক হিসেবেই এবার আমেরিকায় এসেছেন লতিফুল ইসলাম শিবলী। নিউইয়র্ক বইমেলায় তাঁর উপন্যাস দারবিশ-এর ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়েছে। এর বাংলা সংস্করণটি এবারের বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিক্রির তালিকায় শীর্ষে ছিল। আমেরিকায় এবারই লতিফুল ইসলাম শিবলীর প্রথম সফর হলেও তাঁর বইয়ের পাতায় সবার আগে কিন্তু আমেরিকাই ধরা দিয়েছে। তাঁর নায়ক গত শতকেই আমেরিকায় পা রেখেছিলেন। ঢাকা থেকে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে আটকে যায় আমেরিকার জটিল সময়ে। লতিফুল ইসলাম আমেরিকায় আগে না এলেও তাঁর উপন্যাসে ঠিকই বন্দী করেছেন ষাট-সত্তর-আশির দশকের অস্থির আমেরিকাকে। কলম দিয়ে দেখা সেই আমেরিকাকে এবার নিজের চোখে দেখলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা হয় টাইমস স্কয়ারে। যে টাইমস স্কয়ারের সঙ্গে বাঙালির এক গর্বের গল্প লুকিয়ে আছে। বাঙালির গর্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষের ক্ষণে ১৯৬১ সালের ৭ মে এই টাইমস স্কয়ারের নাম এক দিনের জন্য পাল্টে রাখা হয়েছিল ‘টেগোর স্কয়ার’। স্মৃতিময় এ টাইমস স্কয়ারের নিচে বসে লতিফুল ইসলাম শিবলী উজাড় করে দিলেন নিজের অনেক কথাই।
লতিফুল ইসলাম শিবলীর কথায় গান গেয়ে একসময় দেশ মাতিয়েছেন জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, শাফিন আহমেদ, পার্থদের মতো তারকাশিল্পীরা। সেই গানের কারিগর কেন এখন আর গান নিয়ে কথা বলতে চান না? তবে কি জেমসের ‘বিবাগি’র মতো বা ‘বড় বাবু মাস্টারের’ মতো ক্লান্ত তিনি। সোজাসুজি কিছুই বলেননি। বললেন, ‘আমি আর গীতিকার নই। এখন শুধু কথাশিল্পী হিসেবেই বাঁচতে চাই।’
তারপর সাহিত্য নিয়ে আলাপ হয় লতিফুল ইসলাম শিবলীর সঙ্গে। বললেন, সাহিত্যে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। লোকে এখন আর বই পড়ে না। তবে কি পাঠক আর বইয়ে ফিরবে না? এমন প্রশ্নে তিনি অবশ্য দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন, পাঠক ফিরবেই। কাছে টানার মতো বই হলে পাঠক কাছে আসবেই। বইমেলা সম্পর্কে অবশ্য বেশি কিছু বলেননি তিনি। শুধু বললেন, হচ্ছে যে এটাই ভালো। গানের মানুষ লতিফুল ইসলাম শিবলী। যতই মানা করুন না কেন, তিনি কাছে থাকলে গান ঘুরেফিরে আসবেই। কিছুটা বিরক্ত হলেও কথা বলেন গান নিয়ে। ব্যান্ড সংগীতে এখন কিছুই হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। বললেন, অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও আগের শিল্পীদের নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদ থাকত। আর এখনকার শিল্পীরা তৈরি করা প্ল্যাটফর্ম পেয়েও তা ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছেন না। এখন তো ব্যান্ড মানেই কলকাতা ও বোম্বের গানেরই অনুকরণ। যেমন আজম খান মাটি থেকে কথা তুলে গান তৈরি করেছেন, তেমনটি তো এখন আর হচ্ছে না। এখনকার শিল্পীরা যেন আজম খানের গানের সেই আলাল-দুলাল। আলাদা করে খুঁজে মিলে না তাদের। এখন প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও ভালো শিল্পী খুঁজে মিলছে না। আগে প্রকৃতিই শিল্পী খুঁজে দিত। ব্যান্ড সংগীতের এ দুঃসময়ের জন্য তিনি এর পেছনের বাণিজ্যকে দায়ী বলে মনে করেন। সাহিত্য-সংগীতের এ শূন্যতার জন্য তিনি এগুলোর ওপর রাজনীতির প্রভাবকেও দায়ী বলে মানেন।