রোমেনা লেইস

একাত্তর সাল। নিত্যদিনই সকাল হয়...সকাল সাতটা। রেডিও পূর্ব পাকিস্তান। ‘সরকার কবীরউদ্দিন খবর পড়ছি...’। তার পরপরই আবার, ‘আকাশবাণী কলকাতা। নীলিমা সান্ন্যাল খবর পড়ছি।’ আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ি। 

হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসি। নাশতা খেয়ে সিপি আর নীতার সঙ্গে স্কুলে যাই। শহর প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। টলটলে জলভরা সরকারি পুকুরের পাড় ধরে হেঁটে যাই। তখনো আমরা তিনটা বই আর শ্লেট দুই হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে গল্প করে করে স্কুলে যাই। ‘পুরব বাংলার শ্যামলীমায়, পঞ্চ নদীর তীরে অরুণিমায়, ধূসর সিন্ধু মরু সাহারায়, ঝান্ডা জাগে যে আজাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’... অ্যাসেম্বলির সময় গাই।
তারপর হঠাৎই নীতার বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে নীতা, গৌতম, তাপস আর প্রতিমাদিকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেলেন। অনেক প্রশ্ন মনে, কেন হঠাৎ করে ওরা চলে গেল? ইন্ডিয়ায় কেন গেল? আবার কবে আসবে? আসবে কি ফিরে?
কিন্তু প্রশ্নগুলো করা হয়নি। ভাঙনের আরও বাকি তা বুঝিনি তখনো। পাক বাহিনী সুনামগঞ্জে চলে এসেছে। সরকারি ডাকবাংলোতে উঠেছে। সেদিন ভোরবেলা নীতার দিদিমাসহ সব মাসি আর মামারা মরাটিলার রাস্তা ধরে তল্পিতল্পাসহ চলে যাচ্ছেন। আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। কী হচ্ছে এসব? আরতিমাসী এসে বিদায় নিয়ে গেলেন। সিপিরাও ভারত চলে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় বিন্দু বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল ওরা। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। তারপর আমরাও বাড়ি ছেড়ে পালালাম। কিছুদিন পর ফিরে আসলাম। বড়বোনের টাইফয়েড জ্বর। খুব অসুস্থ। একরাতে উত্তর পূর্ব আকাশে লেলিহান আগুন।
আব্বা বললেন, ‘সারাদের বাসায় আগুন দিয়েছে পাক আর্মিরা। এই বাসা ছিল আমাদের খুব প্রিয়। সারা আমার বন্ধু। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন। আব্বা আম্মার সঙ্গে আমরা বেড়াতে যেতাম সব সময়। সারার আব্বা আম্মা আমাদের খুব আদর করেন। সেই খালু, মানে নানু মোক্তার খালু, সারার আব্বা নাকি দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে চলে গেছেন।’
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। দেশ কী? স্বাধীন কী? বুঝি না। তবে বন্ধু হারানোর বেদনা আর খাওয়ার কষ্ট শুধু বুঝি। রাতে আর্মি এসে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। এসব নানা ভয় বুকের ভেতর। তখন সন্ধ্যায় ব্ল্যাক আউটের জন্য ভেন্টিলেটরগুলো সব আঠা দিয়ে ভারী কাগজে মুড়িয়ে দিলেন আব্বা। হারিকেন জ্বলত মিটমিটে আলোয়।
এক সন্ধ্যায় একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা আব্বা নিয়ে এলেন ঘরে। কাজী বশির উদ্দিন ওরফে নানু মোক্তার সাহেব। সেই সন্ধ্যার স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে আজও। হ্যাঁ সারার আব্বা নানু মোক্তার খালু খাকি হাফপ্যান্ট আর চাদর গায়ে। কাঁধের স্টেনগান চাদরে ঢাকা ছিল। আম্মা বসতে বললে তিনি সোফায় না বসে মেঝেতে আসন পেতে বসলেন।
একবার হাসেন। একবার কাঁদেন। আম্মাকে বললেন, ‘ভাবি গোসল করি না কত দিন। কাদা ধুলা গায়ে মেখে সোফায় বসতে পারব না।’
এই প্রথম অস্ত্র হাতে একজন সত্যিকারের রক্ত মাংসের মুক্তিযোদ্ধা দেখলাম। অস্ত্রটাও একটু ছুঁয়ে দেখলাম। আমাদের আদর করে বললেন, ‘আমার সারা ময়নাকে দেখি না কত দিন।’
একাত্তরের ৭ ডিসেম্বরে সুনামগঞ্জ স্বাধীন হয়। সেদিন প্রথম স্লোগান দিতে দিতে শহরে ঢুকেছিলেন যে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাদের মধ্যে ছিলেন হাশিম ভাই, মালেক চাচা, মনোয়ার বখত নেক, সুজাতসহ আরও অনেকে। তবে আমি চিনতাম মালেক চাচা, নেক ভাই আর হাশিম ভাইকে।
দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরছেন। আব্বা ভেন্টিলেটরের মোড়ানো কাগজ খুলে নিশ্চিত হলেন। যখন মুক্তিযোদ্ধারা ফিরছেন তখন আমরা লুকিয়ে রাখা পতাকা নিয়ে বের হয়ে এলাম রাস্তায়।
সারাদের বাসার পাশের মাঠে প্যান্ডেল করে স্বাধীনতা উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে করা হয়েছিল। সারাদের বাসা আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। তবুও নানুমোক্তার খালু অক্ষত ফিরে এসেছিলেন তাই আনন্দ ছিল সীমাহীন।
‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/তবু এই বিজয়ী বীর মুক্তি সেনা’।
এটাই সত্যি। সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ওপর কয়েকটা বই, বাংলাপিডিয়া ঘেঁটে কাজী বশিরউদ্দিন আহমদ (নানু মোক্তার) আর মালেক পীর বা আবদুল হাশিমের নাম উল্লেখযোগ্যভাবে আমি পাইনি। তবুও তাঁদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তোমরা অস্ত্র ধরে দেশ স্বাধীন করেছিলে। তাইতো আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক।