টেলিভিশনে গেছি আনন্দ-বিনোদন দিতে

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

গত ২৫ জুলাই ছিল অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের এই দিনে তাঁর জন্ম। ৭৯ পেরিয়ে তিনি ৮০ বছরে পা রেখেছেন। কিছু দিন আগে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বাংলা বইমেলা উপলক্ষে নিউইয়র্ক ঘুরে গেছেন। ২৩ জুন বিকেলে বইমেলার মঞ্চে অতিথি হিসেবে ছিলেন তিনি। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। গতানুগতিক অর্থে সেটি ছিল না কেবল মুখোমুখি সাক্ষাৎকার। তাঁকে মঞ্চে পেয়ে নানা বিষয়ে কথা হয়। কথায় কথায় ফিরে গেলেন জীবনের পেছনের দিকে। জন্মদিনের কিছু দিন আগে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এই স্বপ্নদ্রষ্টার সঙ্গে সেই কথোপকথন তুলে ধরা হল পাঠকদের জন্য—

প্রথম আলো: আপনি সাহিত্য কেন পড়াতে চাইলেন? শিক্ষকতার তো আরও উপায় ছিল। কিন্তু আপনি গেলেন সাহিত্য পড়াতে-কেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: সাহিত্যের শিক্ষক হয়েছিলাম, তার কারণ হতে পারে আমার আব্বা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন, এটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল। স্কুলে থাকতে সাহিত্যের দিকে আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। এই রবিন হুড, তারপর আঙ্কেল টমস কেবিন—এসব বই ছিল আমার পড়ার বিষয়। একটু আগেই বলেছি, আমার শরীরটা ভালো নেই। এতই খারাপ যে, কথা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। (এ সময় স্যারকে বসে কথা বলার অনুরোধ করলেন অনেকে)। আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন, উনি একটা অদ্ভুত উদাহরণ আমার সামনে রেখে গেছেন। সেই শিক্ষক যে খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন, তাও না। আমাদের কলেজজীবনের শিক্ষক। তিনি একদিন এসেছেন। শিক্ষকদের কাঠের মঞ্চ থাকে, তার ওপর টেবিল-চেয়ার থাকে, উনি এসে সব সময় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেন। আমাদের কোনো শিক্ষককেই আমরা ক্লাসে বসে কথা বলতে দেখিনি। একদিন দেখলাম, সেই শিক্ষক এসে কথা বলছেন। তাঁর মুখ কালো হয়ে গেছে, শরীর অসুস্থ দেখাচ্ছে এবং তিনি কাঁপছিলেন। উনি কিছুক্ষণ কথা বলার পরে আমাদের এক ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আপনি তো অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। আপনি বসে কথা বলেন। উনি বললেন, দেখ আমি বসে কথা বলতে পারব না। ওই ছাত্র বলল, স্যার আপনি কাঁপছেন, আপনি পড়ে যাবেন...এ রকম অসুস্থতা নিয়ে…আপনি বসেন। উনি তখনো বললেন, না আমি বসতে পারব না। তখন ওই ছাত্র একটু উত্তেজিত হয়ে গেল। বলল, স্যার আপনি কেন বসতে পারবেন না? উনি বললেন, দেখ আমাদের যুগটা একটু আদর্শের যুগ ছিল। তখন উনি বললেন, দেখ আমি বসতে পারব না এজন্য যে, আমি যখন ক্লাসে ঢুকেছিলাম তখন তোমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সম্মান দেখিয়েছিলে। এর বিনিময়ে এখন যতক্ষণ ক্লাস চলবে তোমরা বসে থাকবে। আমি দাঁড়িয়ে তোমাদের সে সম্মানের জবাব দেব। [দর্শকদের হাততালি] এরপর থেকে আমি নিজে কখনো বসে কথা বলিনি। তবে মাযহারদের (সাক্ষাৎকারগ্রহীতা) ক্লাসে বসেছি, কারণ তাদের সংখ্যাই ছিল মাত্র তিন বা চারজন। 

(সাক্ষাৎকারগ্রহীতা সুধরে দিলেন, ১৩ জন ছাত্র ছিল, ৩/৪ জন ক্লাসে থাকত)
আমার তো ধারণা ছিল, বাকিরা ছাত্রই ছিল কিনা! তো কলেজে উঠে আমি সাহিত্য নিয়ে একদম পাগল হয়ে গেলাম। সেই পাগলামি আট বছর পর্যন্ত আমার ছিল। সাহিত্যের আনন্দ, কবিতার আনন্দ, উপন্যাসের আনন্দ, গল্পের আনন্দ-মফস্বল শহরে আমি ছিলাম, সেখানে অন্য কোনো উত্তেজনা ছিল না, অন্য কোনো ব্যাপার ছিল না। একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য নিয়ে দিনের পর দিন পাগলের মতো, মাতালের মতো, আমি পড়াশোনা করেছি এবং যে আনন্দ পেয়েছি তা আমি আর সারা জীবনে ওইভাবে পাইনি। আমার তখন মনে হতো, আনন্দটা আমি পেলাম সাহিত্য পড়ে, সে আনন্দ যেন অন্যরাও পায়। সাহিত্য পড়ে আমি যে আনন্দ পেয়েছি, আমি চেষ্টা করেছি সে আনন্দটা অন্যকেও পৌঁছে দিতে। এটাই আমার শিক্ষক হওয়ার প্রেরণা ছিল। কলেজে সেই সময় আমাদের বেশ কিছু ভালো শিক্ষক ছিলেন—ইংরেজিতে, বাংলায়, ইকোনমিকসে, ফিলোসফিতে—অসাধারণ সব শিক্ষক। তাঁরা ক্লাসে পড়াতেন। আমি প্রত্যেকের ক্লাস করতাম। সেটা কলেজের প্রথম বর্ষের হতে পারে, দ্বিতীয় বর্ষের হতে পারে, তৃতীয় বর্ষের হতে পারে, চতুর্থ বষের হতে পারে। যে ক্লাসে একজন ভালো শিক্ষক পড়াচ্ছেন আমি সেই ক্লাসে গিয়ে পেছনে বসে থাকতাম। আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন ইকোনমিকসের, অসাধারণ শিক্ষক! উনি যখন পড়াতেন কীভাবে যে অর্থনীতির মধ্যে আমাদের ঢুকিয়ে ফেলতেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাগলের মতো কথা বলে যেতেন। পাগল মানে ওই পাগল না, যারা রাস্তার পাশে বসে থাকে, পাগল মানে যারা অন্যকে পাগল করে তোলে। আশ্চর্য ক্লাস তাঁর—সেই দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য এবং বিজ্ঞান সব কিছুর ওপর দিয়ে তিনি পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলতেন। আমরা তাঁর পেছনে পেছনে চলতে থাকতাম। ১০ মিনিট পরেই দেখতাম, আমাদের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। আমাদের মনে হতো কেউ বোধ হয় ইচ্ছা করে চল্লিশ মিনিটের ক্লাসে দশ মিনিটের সময় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতাম, ঠিকই চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। এত অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কাছে পড়ার পর মনে হলো, যদি কোনো বিষয় নিয়ে পড়তে হয় তাহলে তা হবে অর্থনীতি। আমি তাঁর শিষ্য হয়ে গেলাম এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। দুঃখের বিষয়, সেই শিক্ষক ছয় মাস পর হঠাৎ চলে গেলেন। আমাদের সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা চলে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গে। মানে এই সমাজে যারা শিক্ষায়, রুচিতে নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তাদের বিরাট একটা অংশ চলে গেলেন। তাঁর কাছে অর্থনীতি পড়ে আমার মনে হয়েছিল, যদি কোনো বিষয় নিয়ে এই পৃথিবীতে পড়তে হয় তাহলে সেটা হবে অর্থনীতি। কোথায় সাহিত্য, কোথায় শিল্প—সব উড়ে চলে গেল। অর্থনীতিই হয়ে গেল আমার একমাত্র স্বপ্ন! কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের নতুন একজন অর্থনীতির শিক্ষক এলেন এবং সেই শিক্ষক এতই খারাপ [দর্শকদের হাসি] যে, আমি এক মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনো বিষয়ে যদি না পড়তে হয় তাহলে সেটা হবে অর্থনীতি। মানুষের জীবনে শিক্ষক এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। ন্যাচারালি আমি আবার সাহিত্যের আনন্দের মধ্যে ফিরে এলাম এবং এখন পর্যন্ত চলছে।
প্রথম আলো: একটা সম্পূরক প্রশ্ন স্যার। আপনি তো সাহিত্যের শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু এখনকার যে যুগ, সেখানে তো সাহিত্যের কোনো মূল্য নেই বলেই মনে হয়। সাহিত্য তাহলে মানুষকে কী দেয়?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এখনকার যুগের কথা যদি বলা হয় তাহলে একটা কথা আমি বলবে, এখনকার যুগ যে শুধু সাহিত্যকে পরিত্যাগ করেছে তা নয়। মানবসভ্যতার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও মহৎ সবকিছুই এই যুগ পরিত্যাগ করেছে। এই যুগে একটা ঝাণ্ডাই শুধু উড়ছে, সেই ঝাণ্ডার নাম হচ্ছে টাকা। [দর্শকদের মধ্য থেকে সজোর হাততালি] এখানে শিল্প গেছে, সাহিত্য গেছে, দর্শন গেছে, এখানে বিজ্ঞান গেছে—সব গেছে, একমাত্র পতাকা পতপত করে উড়ছে টাকা।
সাহিত্য মানুষকে কিছু দেয় না। অনেকে মনে করেন, যারা বিপ্লব করেন তারা মনে করেন, সাহিত্যের কাজ হচ্ছে বিপ্লবের হাতিয়ার হওয়া। যারা সমাজের অন্য রকম পরিবর্তন চান, তারা মনে করেন সাহিত্যের কাজ হচ্ছে সেটা। প্রত্যেকে যে যা করেন, তারা মনে করেন সাহিত্যের কাজ হচ্ছে সেই কাজটা করা। মানে সাহিত্য একটা গোলাম আর কী! যাকে দিয়ে যা খুশি যে করবে। সাহিত্য একটা কাজই করে যেটা টি এস এলিয়ট বলেছেন, আমি এ পর্যন্ত যত ডেফিনেশন পেয়েছি সাহিত্যের একটা ডেফিনেশন...আমার কাছে অ্যাকসেপ্টেবল মনে হয়েছে যে, সাহিত্য সারবান কথাও বলে না, মানুষকে মহৎ বৃহৎও করে না। কিছুই করে না, মানুষকে সম্মৃদ্ধ করে। মানুষের আলোকিত করে। যে মানুষ ছোট ছিল, তাকে বড় করে। তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বড় করে। তার স্বপ্নকে বড় করে। তার জীবনকে বড় করে। তার আনন্দকে বড় করে। সে বড় জায়গা থেকে জীবনকে দেখতে পায় এবং তার মধ্যে একটা অসম্ভব মানসিক বিকাশ ঘটে। সাহিত্যের যদি আলটিমেটলি কোনো কাজ থাকে, এটাই সেটা। আমরা যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করছি, সেটার মূলে এই প্রেরণা যে, আমার জাতির মধ্যে আলোকিত মানুষ হোক, উৎকর্ষমণ্ডিত মানুষে ভরে যাক বাংলাদেশ। এটাই আমাদের স্বপ্ন। কারণ সাহিত্য এটুকুই করতে পারে।
প্রথম আলো: স্যারের যে পরিচয় নিয়ে আমরা এতক্ষণ কথাবার্তা বললাম, সেটা তাঁর সাহিত্যিক পরিচয়। সাহিত্যিক পরিচয়ে আবার দুটি দিক। একটি হচ্ছে তিনি সাহিত্যের অধ্যাপক বা শিক্ষক, আরেকটি দিক তিনি লেখক।... আমরা যেটা জানতে চাচ্ছি সেটা হলো স্যারের যে টেলিভিশনের প্রতি প্রীতি—সেই প্রীতি কিন্তু এখনো যায়নি। সেটি কেন ছিল এবং এখনো কেন যায়নি? সেটাও কিন্তু অনেকে জানতে চায়!
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অন্যকে আনন্দ দিতে পারে, দিতে চায়, তাদের মনও আনন্দময়। এই যে শিল্পী, শিল্পীরা কী? তারা কী চায় শেষ পর্যন্ত! এই ‘‘মরিতে চাহি না না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ কোনখানে বাঁচিবারে চাই? মানুষের হৃদয়ের মধ্যে আমি বাঁচিবারে চাই! এটা রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও, গ্যেটেও তাই, শেক্সপিয়ারও তাই—আমাদের মতো বিনোদনকারী সবাই তাই। একটা মানুষের হৃদয়, মানুষের খুশির মধ্যে একটু আনন্দিত হলো, এই আনন্দের মধ্যেই আমি বেঁচে আছি—এটি চাই! সেটা যিনি দর্শন করেন, ফিলোসফার প্লেটো, অ্যারিস্টটল—তাঁরাও তাই চেয়েছেন। শিল্পীরাও তাই চেয়েছেন, যাঁরা অভিনয় করেন তাঁরাও তাই চান। তো, এই যে একটা আনন্দের জগৎ, আনন্দ ভুবন, এই জন্যই। সেটা এখন কেউ মনে করতে পারে যে টেলিভিশন সেই লেভেলের জিনিস না, ফিলোসফি যে লেভেলের জিনিস, টেলিভিশন সেই লেভেলের জিনিস না...এটি একটা ইরেজ মিডিয়া...এটা মুছে যায়... এটা হারিয়ে যায়...আমি তা মনে করি না। ওটা হারিয়েই যেতে পারে, ওটা টেকনোলজির অভাব, এটা টেকনোলজির প্রবলেম। কিন্তু যে মানুষটি এ কাজটি করেছে, সে তার সারা জীবনের পুরো সত্তা দিয়ে সে সেটা করেছে, অন্যের মনকে আনন্দের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে এই শ্রেণি যদি না থাকত, তাহলে মানবসমাজ আরও বেশি বিমর্ষ, আরও অনেক বেশি ডিপ্রেসড হয়ে পড়ত। এই শিল্পীরা আছে বলেই পৃথিবী এখনো প্রাণবন্ত আছে। আমি মনে করি, আমরা টেলিভিশনে যা-ই করি ওটা তো একটা শিল্পের অংশ। আমি তাতে বড় শিল্পী না হতে পারি, কিন্তু সেটা তো শিল্পের অংশ। সেই শিল্প করেছি। রবীন্দ্রনাথ কেন শিল্প করেছেন সেটা রবীন্দ্রনাথকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। [দর্শকদের হাসি]
প্রথম আলো: আরেকটা সম্পূরক প্রশ্ন করতে চাই। আপনি কি টেলিভিশনে আনন্দ দিতে চাইতেন, নাকি বিনোদন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, আনন্দ আর বিনোদন কিন্তু এক না। বিনোদন হালকা জগতের জিনিস। বিনোদন একটা ফালতু জিনিস। বিনোদনও আনন্দ। কিন্তু আনন্দের একটা জলমেশানো সংস্করণ। ওটা একটু নিম্নমানের আনন্দ। একটা লোক এখান দিয়ে যাচ্ছে। সে হঠাৎ এখানে আসল, সে খেয়াল করে নাই এখানে কেউ একটা কলার ছোকলা রেখে গেছে। স্যুট-টাই পরা একজন মানুষ এখান দিয়ে আসতে আসতে ওটার ওপর পা-টা পিছলে পড়ে গেলেন। সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এটা হলো বিনোদন। [দর্শকদের হাসি] আর রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন, মম চিত্তে নিতি নৃত্যে/কে যে নাচে তাতা থই থই তা তা থই থই/ তাতা থই থই—এটা আনন্দ! এটা স্পিরিচুয়াল বিনোদন। অনেকটা শারীরিক। যখন ব্যান্ড সংগীত হচ্ছে তখন বিনোদনের চরম চেহারা দেখা যায়। গায়ক আর কী নাচে, নাচে দর্শক! আমাকে ওয়াহিদুল হক খুব একটা অসাধারণ কথা বলেছিলেন একবার, গান যদি শরীরকে আঘাত করে সেটা নিম্ন শ্রেণির গান। ওটা গান নয়। এই ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক হয় কী প্রচণ্ড সাংগীতিক উন্মাদনা সেখানে চলতে থাকে। কিন্তু একটা দর্শক কি নড়ে? নড়ে না। এবং স্থির হয়ে বসে থাকে। ওটা আত্মার ভেতরের সেই আনন্দ—মম চিত্তে নিতি নৃত্যে...সে ভেতরে নাচছে। যেটা রবীন্দ্রনাথ আরও সুন্দর করে বলেছিলেন, চোখের আলোয় দেখেছিলেন চোখের বাইরে—সেই আনন্দ! আনন্দ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন, ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়—পাতায় পাতায় আলোরা নাচছে, আমাদের সামনে প্রতি মুহূর্তে হয়—কিন্তু আমরা...বলে যে, অ নাচছে! [স্যার একটু ব্যঙ্গাত্মক অভিনয় করে দেখালেন!]
প্রথম আলো: টেলিভিশনে আপনি কি আনন্দ দিতে পারতেন? নাকি বিনোদন দিতেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি দুটোকে মেশাতে চেষ্টা করতাম। আমার প্রবলেম ছিল, আমি গেছি ওখানে বিনোদন দিতে। বিনোদন মানে আনন্দ দিতে। কিন্তু আমি যে মাস্টার! একবার এক সিনেমার প্রযোজক আমাকে ধরল, তার একটা ছবিতে আমাকে অভিনয় করতেই হবে। কত টাকা চাই! ১৯৬৮ সাল! এবং শেষ পর্যন্ত উনি আমাকে বললেন, আপনি যদি অভিনয় করতে রাজি হন তাহলে আপনাকে ২৮ হাজার টাকা দেব। সে কালে ২৮ হাজার টাকা কিন্তু অনেক টাকা! এখন ২৮ লাখের চেয়েও বেশি! সেটা ঢাকার একটা সিনেমা। তাতে বোঝা যায়, টাকাটা উনি ঠিক সিনেমার জন্য ব্যয় করতে চাচ্ছেন না, উনি আমাকে দিতে চাচ্ছেন! আমি তাকে বললাম, দেখেন ভাই আমি তো শিক্ষক! আমি কী করে সিনেমায় নেমে নায়িকার হাত ধরে সমুদ্রের কিনারা দিয়ে, পর্বতের শৃঙ্গ দিয়ে কী করে নেচে বেড়াব! উনি বললেন, কোনো প্রবলেম নাই! এটা একেবারে নির্জলা, নিখাদ একটা বিশুদ্ধ চরিত্র, একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার। কোনো প্রবলেম নাই! শেষ পর্যন্ত আমি অভিনয় করলামই না! এমনকি জাহানারা ইমামও পর্যন্ত আমাকে এটাতে উৎসাহিত করলেন। বললেন, আপনারা শিক্ষক কিন্তু আধুনিক শিক্ষক! আপনারা সিনেমা করবেন তাতে কী এসে যায়! কিন্তু আমি বললাম, দেখেন আমি কোথায় যেন একটু কনজারভেটিভ। কারণ আমি যে ছাত্রের সামনে আদর্শের কথা বলি, ন্যায়ের কথা বলি, আমার পক্ষে এটা কিন্তু...হুবহু আস্বাদন করা আমার পক্ষে ঠিক সম্ভব না।...ছবিটা কিছু কাল পরে বেরোল। বলাকা হলে মুক্তি পেল। বলাকা সিনেমা হল থেকে আমাদের কলেজ ২০০ গজ দূরে। আগে সিনেমা হলে বড় বড় ছবি থাকত—সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে নায়ক তাঁর নাম আর বলি না, দাঁড়িয়ে আছেন এবং নায়িকাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায়। আমি ভাবলাম, হায় হায়...এই ছবি যদি করতাম এই নিউ মার্কেটের সামনে দিয়ে আমার ছাত্ররা সব যায়...যেতে যেতে তারা তাকাতো এবং বলত, স্যার ভালোই তো আছেন!...আমি যদি ব্যান্ডসংগীতও করি তাহলেও আমাকে মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে করতে হবে। যে মাস্টারি করে, ব্যান্ড সংগীতও করে—আমি মনে করি বানর ছাড়া আর কিছু না। আমি বিপদে পড়ে গেলাম যে, টেলিভিশনে আমি গেলাম, সেখানে একটু হালকা মেজাজ, সেখানে তো অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। বাড়ির কাজের মেয়েটার কাছেও পৌঁছাতে হবে, আবার ভাইস চ্যান্সেলরের কাছেও পৌঁছাতে হবে। আমি কী করব! তারপর একটা সময় একটা প্রোগ্রাম কিছুটা জনপ্রিয় হলো। আমার প্রযোজক বলতে লাগল, দেখেন এ রকম একটা জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, পোশাক-টোশাকের মধ্যেও কিছুটা রং, কিছুটা কারুকাজ আশা করছে। বললাম, কিন্তু ভাই আমি যে মাস্টারি করি। আমার পক্ষে তো এটা করা সম্ভব না। শেষ পর্যন্ত একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পছন্দ করা হলো—গলার দিকে সামান্য কারুকাজ, ওটা পরে আমি প্রোগ্রাম করলাম। প্রোগ্রাম করে পরদিন কলেজে গেছি, রিকশা থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি তিনটা না চারটা স্টেপ, একটা নিরীহ গোছের ছেলে আমাকে ডাকল, স্যার আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। ডেকে নিয়ে সে আমাকে বলল, স্যার কালকে দেখলাম যে আপনি টিভিতে একটা অনুষ্ঠানে বেশ জমকালো একটা পাঞ্জাবি পরে উপস্থাপনা করছেন। আমি বললাম, দেখ ওটা তো একটু অন্য জগৎ, কলেজ তো একটু আলাদা জায়গা...ওটা অন্য জগৎ ওটারও তো একটা দাবি আছে। তখন সেই ছেলেটা আমাকে বলল, তাহলে স্যার আপনি ওখানেই থেকে যাবেন, আমাদের সামনে আর আসবেন না। আমার কান লাল হয়ে…! শেষ পর্যন্ত আমি টেলিভিশনে গিয়ে বললাম, আমি আর অনুষ্ঠান করব না। আমার ছাত্রের কাছে নিজেকে ছোট করতে পারব না। খালেদা ফাহমি তখন ডিরেকটর প্রোগ্রাম। উনি বহু বোঝাতে চেষ্টা করলেন। এর কয়েক সপ্তাহ পর নিউ মার্কেটে এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন আপনি টেলিভিশনে যে প্রোগ্রামটা করতেন, সেটা ছেড়ে দিলেন কেন? আমি বললাম, দেখেন আমি তো মাস্টারি করি। আমার পক্ষে ঠিক ওই পরিস্থিতিটা রাখা সম্ভব না। আমি বুঝিয়ে বললাম, আমি এজন্য অনুষ্ঠান করা ছেড়ে দিয়েছি। উনি তো বললেন, আপনি তো মাস্টারির জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি যে এখনো প্রত্যেক বুধবারে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসি। মনে হয় আপনি আসবেন! তখন আমার মনে হলো, এই মানুষটারও তো একটা দাবি আছে, আমার ছাত্রের যেমন দাবি আছে। ওই মানুষটা যে আমাকে ভালোবাসে বা কোনোভাবে একটা ভালোবাসা তাঁর মধ্যে আমার প্রতি জন্ম নিয়েছে। এটাকে তো আমি অপমান করতে পারি না। তখন আমি আমার শিক্ষকতা এবং টিভি এই দুটোকে কম্বাইন্ড করার চেষ্টা করলাম। আমার ধারণা, এই কম্বিনেশনটা খারাপ হয়ি! কারণ দেখতাম, টেলিভিশনের দর্শকেরাও দেখত আর আমার ছাত্ররাও কলেজ ছেড়ে আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য খুব একটা কিছু করে নাই!