সেলফি বনাম নার্সিসিজম

আয়নায় সবাই নিজেকে সুন্দর দেখে। সুন্দর দেখা আয়নার সেই দায়িত্বটা আজকাল মুঠোফোনের ক্যামেরা নিয়ে নিয়েছে। নারীরা সহজে আর কিটি ব্যাগ খুলে আয়না বের করেন না। মোবাইলের ক্যামেরায় দেখে নেন সাজগোজ ঠিক আছে কিনা? টাচ আপের কাজটাও করে নেন। তারপর একটা সেলফি তুলে পোস্ট দিয়ে যদি ক্যাপশনটা হয় ‘আজ আমাকে বেশ সুন্দর লাগছে’ তাহলে এটা আত্মবিশ্বাস। কিন্তু যদি হয় ‘আমার থেকে বেশি সুন্দরী কেউ নয়’ তাহলে সেটা হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা, নার্সিসিজম।

সেলফিপ্রেমীরা এখন অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক আক্রমণের শিকার। সরাসরি কিছু না বললেও সামাজিক মাধ্যমে আকার-ইঙ্গিতে-স্ট্যাটাসে-মন্তব্যে অনেকে সেলফিপ্রেমীদের আঘাত করেন—এমন মানসিকতার মানুষের অভাব নেই। বলে নেওয়া ভালো, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরাই এখন বড় গিনিপিগ। যত রকম তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণা প্রয়োজন—তার সবই আমরা সামাজিক মাধ্যম থেকে জোগান দিচ্ছি। অনেকেই সেলফিপ্রেমীদের নার্সিস মনে করেন। অতি সহজে প্রাপ্ত এসব মাধ্যম আমাদের মহাজ্ঞানে জ্ঞানী করছে যে, আমরা না বুঝেও এখন জ্ঞানী। ‘নার্সিস্টিক’ এবং ‘নার্সিসিজম’ শব্দ আজকাল অনেক ব-কলমও জানেন। এ দুটো বিষয় কী তা গভীরভাবে না জানলেও ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে অনেকে অনেক কিছু ব্যাখ্যাও করছেন। মনোবিদেরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা পরিমাপ করেন। কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বে নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার বা অতি আত্মপ্রেমজনিত আচরণগত বিচ্যুতি আছে কি না, সে সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে অল্পবিস্তর জ্ঞান ছিল। তবে আমি চেষ্টা করছি অতি সাধারণ দিকটা তুলে ধরার।

সবার আগে জানা দরকার নার্সিসিজমটা কী? শুধু যে সেলফিই নার্সিসিজম তা নয়, মানুষের আচরণগত কিছু বিষয় এর আওতায় পড়ে। যেমন, যারা মাত্রাতিরিক্ত আত্মকেন্দ্রিক ও নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে, তারা সব সময়ই অন্য সবার চেয়ে নিজেকে বেশি যোগ্য মনে করে এবং সেটা দেখানোর কোনো সুযোগ ছাড়ে না। তারা মনে করে, সম্মান জোর করে আদায় করে নিতে হয়।

নার্সিসিজম রোগের নাম ‘নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার’ বা ‘এনপিডি’। বাংলায় বলা যেতে পারে, ‘অতি আত্মপ্রেমজনিত ব্যক্তিত্বের আচরণ বিচ্যুতি’। মানুষের প্রধান তিন ধরনের নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের (triad) অন্যতম হলো এই নার্সিসিজম। নার্সিসিস্টিকদের মধ্যে পরিলক্ষিত লক্ষণ হচ্ছে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আত্মকেন্দ্রিকতা, টেকসই সাবলীল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা, মনস্তাত্ত্বিক সচেতনতার অভাব, অন্যের অনুভূতির বিষয়ে যৌক্তিক ধারণার অভাব। নিজেকে অন্যের তুলনায় সর্বদা উচ্চতর অবস্থানে দেখা। যেকোনো অবমাননা বা কল্পিত অবমাননার প্রতি অতি সংবেদনশীলতা। অপরাধবোধে নয়, বরং লজ্জায় বেশি কাতরতা, অসৌজন্যমূলক এবং অবন্ধুসুলভ দেহভঙ্গি। নিজের প্রশংসাকারীদের তোষামোদ করা, নিজের সমালোচকদেরকে ঘৃণা করা, কিছু না ভেবে অন্যদের দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেওয়া, যতটা না তার চেয়ে নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা, আত্মম্ভরিতা করা (সূক্ষ্মভাবে কিন্তু প্রতিনিয়ত) এবং নিজের অর্জনকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা, নিজেকে বহু বিষয়ের পণ্ডিত মনে করা। এ ধরনের মানুষ অন্যের দৃষ্টিকোণে বাস্তব পৃথিবী কেমন, তা অনুধাবনে অসামর্থ্য। অনুতাপ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সব সময় তারা অস্বীকৃতি প্রকাশ করে।
মার্কিন মনোচিকিৎসক এবং মনোবিশ্লেষক ড. স্যান্ডি হচ্‌কিসের মতে একজন নার্সিসিস্টের সাত ধরনের আচরণগত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে যেগুলোকে তিনি ‘ডেড্‌লি সিন্‌স’ বা ভয়াবহ পাপ নামে অভিহিত করেছেন। এগুলো হলো লজ্জাশূন্যতা, আধিভৌতিক ভাবনা, ঔদ্ধত্য, হিংসা, বশ্যতা প্রাপ্তির উচ্চাভিলাষ, ঠকবাজি, সীমাহীন অধিকারবোধ।

তবে নিজের প্রতি সম্মানবোধ বা নিজের পারদর্শিতার ওপর আস্থা কিংবা নিজের অর্জনের প্রতি ভালোবাসাজনিত সাধারণ যে অহম যা প্রত্যেকেরই থাকে এবং থাকা উচিত, তা কিন্তু নার্সিসিজম তথা এনপিডি নয়। এই অক্ষতিকর ব্যক্তিত্ববোধকে ফ্রয়েড নাম দিয়েছেন প্রাথমিক নার্সিসিজম। এবার আসা যাক ‘হেল্‌দি নার্সিসিজম’ প্রসঙ্গে। হেল্‌দি নার্সিসিজম হলো নিজের সত্তার এক সুস্থিত সত্য বা সত্যোপলব্ধি, নিজের প্রতি নিজের এবং অন্য বস্তুর আনুগত্য অর্জন, সত্তার স্বাভাবিকতা এবং পরম অহংবোধের সুসংহত অবস্থা এবং প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ও উম্মত্ততার মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য। এটি ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের অপরিবর্তনীয়, বাস্তবধর্মী স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা এবং পরিণত লক্ষ্য ও বিশ্বাস আর সেই সঙ্গে বস্তু-কেন্দ্রিক সম্পর্ক গঠনের সক্ষমতা তৈরি করে। এটি অনেকটা অনিরাপত্তা ও অপর্যাপ্ততা প্রতিরোধী একধরনের আত্মবিশ্বাস। মানুষের স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে স্বাস্থ্যপ্রদ নার্সিসিজম অত্যাবশ্যকীয়। এতে আত্মপ্রেম অবশ্যই আছে, তবে তা চারপাশের বাস্তবতাকে লীন করে এককেন্দ্রিকতা দেয় না। তাই এটি রোগের কোনো লক্ষণ নয়। এটি মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক।

আমেরিকান অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড্যানি ডেভিটো ইউরোপে তাঁর এক সাক্ষাৎকারে সেলফি প্রসঙ্গে খুব সুন্দর একটা বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘সেলফি ডায়েরির কাজ করে, এখন আলাদা করে কেউ ডায়েরি লেখে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখন হয়তো কোথাও গেছি এবং একটা সেলফি তুলে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করলাম বা নিজের কাছেই রেখে দিলাম, যা বছর ঘুরে আমার কাছে এক মধুর স্মৃতি।’ তিনি ভারতে ভ্রমণকালে তাজমহলের সঙ্গে শুধু তাঁর পায়ের একটি ছবি তোলেন, তিনি ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, ছবি যেন বলে দেয় একদিন ওইখানে তাঁর পদচিহ্ন পড়েছিল। এটাকেই তিনি মূলত জীবন্ত ডায়েরি হিসেবে গণ্য করেছেন।

আধুনিক প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সঙ্গে কেউ থাকলেও সেলফি তুলতে পছন্দ করে। কারণ, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিক মানুষই সেলফি তোলে। এ প্রসঙ্গে নিজস্ব দুটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। যেমন, একবার বিমানবন্দরে একঝাঁক তরণী সেলফি তুলছে, তাদের পাশে বসা বয়স্কা এক ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই বললেন, উনি তাদের ক্যাপচার করবেন। কিন্তু মেয়েটি হাসি মুখে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল। মনে হলো, সত্যিই তো আধুনিক মানুষ সেলফি তোলে। আমার তো ছবি তুলতে সব সময় ভালো লাগে, সে হোক নিজের বা অন্যের বা আকাশের। আমি যখন সাজগোজ করে মেয়েকে বলি, ‘মার ছবি তুলে দাও’; সে আমাকে উপদেশ দেয়, ‘মম টেক সেলফি, মডার্ন পিপল টেক সেলফি।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরেও পরিবর্তন ঘটে। পূর্ব অবস্থানের সঙ্গে ব্যবধানটা সেলফিবন্দী করে রাখার মধ্যে অবশ্যই আনন্দ আছে।

বলিউড অভিনেতা সালমান খান, বিপাশা বসু, সোনম কাপুর, আলিয়া ভাট সেলফিকে বর্ণনা করেছেন ক্যামেরার সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব হিসাবে। এরা সকালবেলা তাদের শারীরিক কসরতের সঙ্গেই সেলফি বন্দী হন। আমারও মনে হয়, ঘুম থেকে উঠে সতেজভাবে নিজেকে দেখা নতুন করে বাঁচার প্রেরণা জোগায়। তাই আত্মপ্রেম ও আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি জীবনে অবশ্যই প্রয়োজন। সেই বিশ্বাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে কিছু মুহূর্তে নিজেকে বন্দী করা সুস্থতারই লক্ষণ।

সামাজিক মাধ্যমে একজন গৃহিণী সুনিপুণভাবে সপ্তাহে একবার দুবার নিজেকে প্রকাশ করেন সেলফির মাধ্যমে যা সত্যিকার অর্থে দৃষ্টিকটু নয়। কিন্তু তিনি যেহেতু গৃহিণী বা কয়েকটা সন্তানের মা, তাই তাঁকে সহজেই কটাক্ষ করা হয় যা আসলে কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। হয়তো একজন সেলিব্রেটি প্রতিদিন তাঁর শত শত ছবি নিজেই প্রকাশ করছেন, যা তাঁর কর্মের সঙ্গে একটা সমালোচনামূলক সূত্র তৈরি করে দেয়। অথচ তাঁর ছবিগুলো যখন তাঁর ভক্তরা পোস্ট করেন তা ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। অনেকে আবার অন্যকে বিরক্ত করার জন্য একাধিক সেলফি পোস্ট করেন, যা অনেকটা অসুস্থ মনোভাব। অন্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজে যে একটা অসুস্থ কাজ করছেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। এটা নার্সিসিজম।

সেলফিপ্রেমী নার্সিসিজমে ভুগছে কিনা, তা বেরিয়ে আসবে একজন মানুষের আচরণে। মূলত তাঁর ক্যাপশন ও অঙ্গভঙ্গিতে আসক্তিজনিত মনোভাব থাকলে এবং ঘণ্টায় ঘণ্টায় বা দিনে অযথা অসংখ্য ছবির পোস্ট করলে, অবশ্যই তা নার্সিসিজম। কিন্তু স্বাভাবিক মাত্রায় আত্মবিশ্বাসজনিত সেলফি অবশ্যই স্বাস্থ্যকর। অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব তাঁরাই করেন, যারা নিজেকে ভালোবাসতে পারেন না। তাই আগে নিজেকে ভালোবাসুন, তাহলে অন্যের প্রতি সহজেই ভালোবাসা জন্মাবে। সে হোক সেলফিপ্রীতি বা অন্য কিছু।