অ্যালান টুরিং: এক হারিয়ে যাওয়া কিংবদন্তি

আমি এক কিংবদন্তির কথা বলছি। সেই কিংবদন্তির নায়কের নাম অ্যালান ম্যাথিসন টুরিং। গল্পটি এভাবে শুরু করলে কেমন হয়? ১৯৮৩ সালে লেখক অ্যান্ড্রু হজ অ্যালান টুরিং: দ্য এনিগমা নামে টুরিংয়ের জীবনীগ্রন্থটি প্রকাশ না করলে হয়তো মানুষের কাছে টুরিংয়ের গল্প কখনোই পৌঁছাতো না। তিনি নিজেও একজন গণিতবিদ এবং এলজিবিটি রাইট মুভমেন্টের (সমকামী অধিকার আন্দোলনের) সমর্থক। তাই সংখ্যাতত্ত্বের জাদুকর সমকামী টুরিংকে নিয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি।
টুরিং সমকামী ছিলেন এবং সুইসাইড করেছিলেন! এই চটকদার খবরটি চোখের পলকে জানাজানি হয়ে গেল। অ্যান্ড্রু হজ টুরিং-এর জীবনের অনেক তথ্যই তুলে আনেন বইটিতে। তাই মানুষ তখন টুরিং-এর অবদানের কথা সবে জানতে শুরু করেছিল। টুরিং সম্পর্কে এর আগে এত বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল। নাৎসি কোড ভাঙাটা খুবই জরুরি। কিন্তু পারা যাচ্ছিল না। পারলেন শেষ পর্যন্ত অ্যালান টুরিং। ব্রিটিশ সরকার আইন করে তাদের নাৎসি কোড ভাঙার এ তথ্য সারা পৃথিবীর কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিল। তাই পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় টুরিং ও তাঁর দলের এ অসাধ্যসাধনের গল্পটি পৃথিবীর মানুষের অগোচরে রয়ে গেছে।
আসলে কিংবদন্তির নায়ক, অসাধারণ এক মানুষ, বিস্ময় মানব এ বিশেষণগুলো যখন কারও নামের আগে বসিয়ে দিই, তখন সংশ্লিষ্ট মানুষটি সাধারণ মানুষের থেকে অনেক দূরে সরে যান। তখন আমরা আমাদের বিশেষণেই বিশাল হয়ে ওঠা মানুষটির দিকে সভয়ে তাকাই, বিস্মিত হই, কিন্তু আপন করতে পারি না। তাই টুরিংয়ের দিকে আমরা সাধারণভাবেই তাকাব। দেখব তাঁর জন্ম, ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা এবং অবশ্যই একজন অ্যালান টুরিং হয়ে ওঠার পথটা।
টুরিং-এর জন্ম ১৯১২ সালে লন্ডনে। তাঁর বাবা জুলিয়াস টুরিং ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্ট। তাঁরা তাঁদের সন্তানকে ইংল্যান্ডে জন্ম দিয়ে সেখানেই বড় করতে চেয়েছিলেন। সুতরাং তাঁরা টুরিংয়ের জন্মের আগেই ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ছয় বছর বয়সে টুরিং সেন্ট মাইকেলস স্কুল ও ১৪ বছর বয়সে ডরসেটের শেরবোর্ন পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। অঙ্কে চৌকস হয়েও টুরিং স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক কারও কাছেই জনপ্রিয় হতে পারেননি। কারণ তখন গ্রিক, রোমান ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্য পড়াকেই আসল ‘শিক্ষা’ মনে করা হতো।
চুপচাপ স্বভাব, ভাবুক, নিজের কাজে মগ্ন ছেলেটি উচ্চতর ক্যালকুলাস সমাধানেই সব সময় ব্যস্ত থাকত। গণিত আর বিজ্ঞানই ছিল তাঁর উপাস্য। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে স্বাধীন পড়াশোনায় সময় দিতেন বেশি। তাই সবার কাছেই দুর্বোধ্য, খাপছাড়া একজন মানুষ হিসেবে হাসির পাত্র হয়ে উঠেছিলেন টুরিং। এদিকে মায়ের ইচ্ছে ছিল, টুরিং যেন পাবলিক স্কুল থেকে পড়াশোনাটা শেষ করেন।
এক সময় ক্রিস্টোফার মরকম নামের ওপরের ক্লাসের এক ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় টুরিংয়ের। নিঃসঙ্গ, অপমানিত, অবহেলিত টুরিং ক্রিস্টোফারের একান্ত বন্ধু হয়ে উঠল। ক্রিস্টোফারই ছিল টুরিংয়ের প্রথম ভালোবাসা। ‘ক্রিস্টোফার টুরিংকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সংখ্যাতত্ত্ব, ক্রিপ্টোগ্রাফি, অ্যাস্ট্রোনমির মতো বিষয়ের সঙ্গে। টুরিং বুঝতে পেরেছিলেন একমাত্র ক্রিস্টোফারই তাঁকে বুঝতে পারেন, আর তিনিও ক্রিস্টোফারের সঙ্গে সমানতালে রেজোনেট করতে পারেন। দুজনই দুজনার কাছে হয়ে উঠেছিলেন পরম নির্ভরতার জায়গা।’
কিন্তু ক্রিস্টোফারের অকাল মৃত্যুতে টুরিংয়ের জগৎ এলোমেলো হয়ে যায়। ভেঙে পড়া টুরিং শোক ভুলতে ডুবে যান পড়াশোনা আর তাঁদের পড়ে থাকা অসমাপ্ত কাজের মধ্যে। ক্রিস্টোফারের মাকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘বেঁচে থাকলে ক্রিস্টোফার আমাকে এসব কাজের মাঝেই দেখতে চাইতো।’
টুরিং কিংস কলেজ থেকে গণিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে অনার্সে উত্তীর্ণ হন এবং ফেলোশিপ পান। তাঁর মতে, ‘যেকোনো গণনাযোগ্য গাণিতিক সমস্যাই সমাধানযোগ্য। যদি তা এলগরিদমে দেওয়া হয়’। এই সমাধানের জন্য তিনি ‘ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিন’ নামে একটি ‘হাইপোথেটিক্যাল’ যন্ত্র তৈরি করেন। এই মেশিনের আধুনিক রূপই হচ্ছে আজকের কম্পিউটার। প্রিন্সটন থেকে পিএইচডি করার সময় টুরিং ‘ক্রিপ্টোলজি’ নিয়েও পড়াশোনা করেন।
টুরিং তখন ব্রিটিশ কোড ব্রেকিং সংস্থায় কাজ করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। আক্রান্ত পোল্যান্ড তখন বাধ্য হয়েই সাহায্যের আশায় উদ্ধার করা জার্মান এনিগমার তথ্যাবলি ব্রিটিশদের সরবরাহ করে। এনিগমা হলো একটি গোপন বার্তা প্রেরণকারী যন্ত্র, যার মাধ্যমে জার্মানরা রেডিও সংকেত দিয়ে দুর্বোধ্য কোডে সৈন্যদের কাছে আক্রমণের দিক নির্দেশনা পাঠাত। কোডগুলো মিত্রবাহিনী পেলেও তা ভাঙতে পারছিল না ব্রিটিশরা।
ক্রিপ্টোবিশেষজ্ঞ টুরিংকে যুদ্ধকালীন কোড ব্রেকিং কার্যালয়ে এনিগমার গোপন বার্তা উদ্ধারকাজে ডাকা হলো। এনিগমার কোড ভাঙার জন্য যে ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্রের প্রয়োজন, সেই ‘বোম্বা’ নামের যন্ত্রটি পোলিশদের কাছ থেকেই পাওয়া। টুরিং ভাবলেন, ‘মানুষের দ্বারা এনিগমাকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং একটি যন্ত্রের পক্ষেই সেটি সম্ভব। টুরিং ও গর্ডন ওয়েলচের যৌথ চেষ্টায় ‘বোম্বা’কে ভিত্তি করে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক যন্ত্র তৈরি হলো। যন্ত্রটির নাম ‘বোম্বে’। অনেকের মতে টুরিংয়ের বন্ধুর নামে এটির নাম রাখা হয় ‘ক্রিস্টোফার’। ‘বম্বে’ এনিগমার সব কোডের ভেতর পরিচিত শব্দ খোঁজার চেষ্টা করত। এভাবেই জার্মান এনিগমার গোপন তথ্য উদ্ধার করে ক্রিপ্টোগ্রাফি জগতের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন টুরিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ‘বোম্বে’ একে একে জার্মান সেনাবাহিনীর সব এনক্রিপ্টেড তথ্য ভাঙতে শুরু করে। আটলান্টিকে নাৎসিদের হেরে যাওয়ার ঘটনাটিও ঘটে বোম্বের অভাবনীয় সাফল্যের কারণেই।
ক্রিস্টোফার তৈরির সময় হাট-৮-এর একমাত্র নারী সহকর্মী জোয়ান ক্লার্কের সঙ্গে সমকামী টুরিংয়ের বন্ধুত্ব হয়। ধীরে ধীরে মেয়েটির সঙ্গে এক অভিনব সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন টুরিং। টুরিং ও জোয়ান দুজনেই বুঝতে পারলেন, এই একত্রে কাজ করার মধ্যে তাঁরা একধরনের আনন্দ পান। জোয়ানের মেধা টুরিংয়ের মেধার সঙ্গে সমান গতিতে কাজ করে। জোয়ান টুরিংকে ভালোবেসে ফেলেন। টুরিংয়ের সমকামিতার কথা জেনেও চেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গী হয়ে, একই ছাদের নিচে পাশাপাশি থাকবেন। জুটি বেঁধে একসঙ্গে কাজ করবেন। কারণ তত দিনে দুজনেই বুঝতে পেরেছিলেন পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের কাজের দক্ষতা শতগুণ বেড়ে যায়। তাঁদের এই ভালোবাসা বাগদান পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু পরে টুরিং নিজেই সরে যান।
১৯৪৮ সালের দিকে টুরিং ‘টুরিং টেস্ট ও যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। টুরিং টেস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল অনুলিপিকরণ পরীক্ষা; অর্থাৎ ‘ইমিটেশন গেম’। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পাশাপাশি দুটি রুমের কথা। এর একটিতে একজন মানুষ, আরেকটিতে রয়েছে একটি যন্ত্র। ঠিক করা হয় বৌদ্ধিক বিভিন্ন প্রশ্ন লিখে পাঠালে এর জবাব ওই দুই রুম থেকেই লিখিতভাবে আসবে। কোনো শব্দ বা কণ্ঠের ব্যবহার করা যাবে না। যন্ত্রটির উত্তর মানুষের কাছাকাছি হলেই বুঝতে হবে তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে।
আমরা প্রতিনিয়তই এই টুরিং টেস্টের মুখোমুখি হচ্ছি। যেমন ক্যাপচা রিকগনিশন করার সময় আমরা রোবট না মানুষ, তার পরীক্ষা হয় এ টুরিং টেস্টের মাধ্যমেই। যন্ত্র বা রোবট ক্যাপচার অক্ষরের ক্যাপিটাল লেটার, স্মল লেটার যাচাই করতে পারে না। একটি যন্ত্র বিভিন্ন ট্রিকি প্রশ্নের, অর্থাৎ যেখানে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন পড়ে, সেসব উত্তরগুলো দিতে পারে না। যদি জানতে চাওয়া হয়, প্রথম প্রেমের অনুভূতি কেমন? তবে যন্ত্রের পক্ষে এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এ টেস্টের উদ্দেশ্য ছিল, কোনো যন্ত্র কী চিন্তা করতে পারে?— এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। একটি যন্ত্র বা রোবট কখনোই তার সঠিক অনুভূতির উত্তর লিখতে পারবে না। এর মাধ্যমেই মানুষ থেকে যন্ত্রের পার্থক্য করা সম্ভব। টুরিং টেস্ট সে হিসেবে আজও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো যন্ত্র পায়নি।
টুরিং ছিলেন একজন পাকা দৌড়বিদ। দৌড়ানোকে তাঁর কাছে অবসাদ মুক্তির রাস্তা বলে মনে হতো। যখন অবসাদে ভুগতেন, তখন দৌড় তাঁর জন্য টনিকের মতো কাজ করত। টুরিং ওয়ালটন অ্যাথলেটিক ক্লাবের সদস্য থাকাকালে বিভিন্ন দৌড় প্রতিযোগিতায় অনেকগুলো রেকর্ডও তৈরি করেন। টুরিং কথা বলার সময় খানিকটা তোতলাতেন। অ্যান্ড্রু হজের মতে, টুরিং কথা বলার সময় উপযুক্ত শব্দ খোঁজার জন্যই একটু ধীরে কথা বলতেন, যাকে কখনো কখনো তোতলানো বলে মনে হতো।
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ান বন্ধু আর্নল্ড ম্যুরের সঙ্গে টুরিংয়ের সমকামিতার সম্পর্ক ছিল। তথ্যটি প্রকাশিত হলে টুরিংকে আইনের আওতায় এনে সমকামিতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারে শাস্তি হিসেবে জেল নয় তো সমকামিতার চিকিৎসার জন্য অ্যাস্ট্রোজেন ইনজেকশন নিতে বলা হয়। তিনি শাস্তি হিসেবে অ্যাস্ট্রোজেন গ্রহণ মেনে নিলেন। কারণ তিনি জেলের বাইরে থেকে তাঁর কোয়ান্টাম ফিজিকসের গবেষণার কাজগুলো শেষ করতে চেয়েছিলেন। সে সময় সমকামিতাকে রোগ মনে করা হতো। এর চিকিৎসা ছিল হরমোনাল থেরাপি। থেরাপিটি ‘রোগীর’ যৌন ক্ষমতাকে কমিয়ে দিত, যাতে সে অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট না হতে পারে। থেরাপিটি টুরিংকে ‘নপুংসক’ করে দেয়। সমকামিতার দরুন তাঁকে সরকারি গোপনীয় কাজ থেকেও বাদ দেওয়া হয়। সে সময় তাঁকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে জেনে টুরিং খুব কষ্ট পান। তাঁর মানসিক সমস্যাসহ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। খবর পেয়ে জোয়ান তাঁকে দেখতে এসেছিল। এটাই ছিল তাঁদের শেষ দেখা।
অ্যালান টুরিংকে ১৯৫৪ সালের ৮ জুন, তাঁর ৪২তম জন্মদিনের ১৬ দিন আগে, নিজ বাসায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে সায়ানাইড পয়জনিংয়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। টুরিংয়ের মাথার কাছে ছিল একটি আধ-খাওয়া আপেল। আপেলটিতে সায়ানাইডের উপস্থিতির পরীক্ষা করা না হলেও সন্দেহ করা হয় যে, তাতেই সায়ানাইড মেশানো ছিল। যদিও তাঁর পাকস্থলীতে কোনো আপেলের অংশ পাওয়া যায়নি। টুরিংয়ের মৃত্যু নিয়ে পর্যাপ্ত তদন্ত হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য অ্যান্ড্রু হজ অবসাদগ্রস্ত টুরিংয়ের মৃত্যুকে আত্মহত্যাই মনে করেন। টুরিংয়ের প্রিয় ফেয়ারি টেইল ছিল ‘স্নো হোয়াইট’, যা থেকে আপেলে বিষ মেশানোর আইডিয়া পান বলে তাঁর বিশ্বাস। একটি মজার প্রচলিত মিথ আছে যে, এই আধ-খাওয়া আপেলটিকেই স্টিভ জবস তাঁর কোম্পানির লোগো হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কম্পিউটারের জনক টুরিংকে সম্মান জানানোর এটি একটি প্রয়াস ছিল বলে সবাই ধারণা করলেও এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
টুরিংয়ের জীবন ও তাঁর সাফল্যের কথা গোপন নথিপত্রেই বন্দী ছিল দীর্ঘ দিন। তাঁর নাৎসি কোড ভাঙার কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা দুই বছর কমে গিয়েছিল। এটা সম্ভব না হলে মারা যেতে পারত আরও ১৪ মিলিয়ন মানুষ। বহু বছর পর ব্রিটিশরা বুঝতে পারল, তাঁরা শুধু ভুলই নয়, অন্যায় করেছে। রানি এলিজাবেথ ২০১৩ সালে রাজকীয় ক্ষমার দলিলে সাক্ষর করেন। ২০১৪ সালে অফিশিয়ালি ভুল স্বীকার ও ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে ইতিহাসের দায়মুক্তি ঘটে। মুক্ত হয় দলিল-দস্তাবেজ। এর পর ব্রিটিশরা সমকামিতার জন্য পূর্বে শাস্তিপ্রাপ্তদেরকেও ‘টুরিং আইন’-এর আওতায় ক্ষমা করে।
টুরিংয়ের মৃত্যুকালে সাধারণ জনগণের কোনো ধারণাই ছিল না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী অসামান্য অবদান রেখে গেছেন এ মানুষটি। তথ্য প্রযুক্তিতে টুরিংয়ের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন তাঁর সমকক্ষ মানুষদের থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে। তাই কম্পিউটার জগতের নোবেল পুরস্কারটি টুরিংয়ের নামেই নামকরণ হয়েছে ‘দ্য টুরিং অ্যাওয়ার্ড’।
২০১৪ সালে ‘দ্য ইমিটেশন গেম’ নামে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল টুরিংয়ের এনিগমা মেশিনের নাৎসি কোড ভাঙার কাহিনি নিয়ে। পরিচালক মরটেন টেইল্ডাস তাঁর প্রথম ছবিতেই গল্পের চরিত্রগুলোর জীবন, কাজ, আনন্দ ও হতাশাকে দুর্দান্তভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ টুরিংকে সিনেমার পর্দায় জীবন্ত করে তোলেন। লেখক অ্যান্ড্রু হজের লেখা বই আর ‘দ্য ইমিটেশন গেম’ চলচ্চিত্রটি টুরিংকে যেন আবার মানুষের সামনে ফিরিয়ে এনেছে।
সমাপ্তির আগে ছোট্ট একটু কথা বলেই আমি আমার কিংবদন্তির গল্পটি শেষ করব। টুরিংয়ের মতো এমন হাজারো মানুষ আমাদের এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে, করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। সবাই হয়তো টুরিংয়ের মতো জিনিয়াস হয়ে জন্মায় না। কিছু মানুষ জন্ম নেয় প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু অসামঞ্জস্যতা নিয়ে। হয়তো হরমোনের গরমিল, এক্স-ওয়াই ক্রোমোজমের রহস্যময় আচরণ, অথবা সৃষ্টিকর্তার গূঢ় কোনো ইচ্ছাপূরণের শিকার এরা। এটা এদের নিজস্ব কোনো অভিলাষ নয়। এই কথাগুলো আমরা যত দ্রুত বুঝতে ও বিশ্বাস করতে পারব, ততই মঙ্গল।