আমেরিকায় 'পঞ্চকবির কন্যা'

ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের নামকরা অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তাঁর নাম দিয়েছেন ‘পঞ্চকবির কন্যা’। কিন্তু কেন? কেউ রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে, কেউবা নজরুল গীতি; বাংলা গানে আরও অনেক অসামান্য গীতিকবি রয়েছেন, যারা থেকে যান উপেক্ষিত। এই বিষয়টা উপলব্ধি করে ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের পাশাপাশি অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান করতে শুরু করেন। এ পাঁচ কবির গানের কথা-সুর উঠে আসে ঋদ্ধির কণ্ঠে। এক সঙ্গে এই পঞ্চকবিকে নিয়ে ২০১১ সাল থেকে কাজ করছেন তিনি। আর এ কারণেই তিনি ‘পঞ্চকবির কন্যা’।
ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখাদেখি এখন অনেকেই দুই বাংলায় পঞ্চকবির গানের চর্চা শুরু করেছেন। এমনকি আটলান্টিকের এ পাড়েও এই ঢেউ আছড়ে পড়েছে। আর হবেই বা না কেন! ঋদ্ধি নিজে এসে অনুশীলন করাচ্ছেন এ দেশে বড় হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের। মুখে বলেন, ‘এই পর্যায়ে এসে বলতে পারি, আমি যথেষ্ট সফল হয়েছি। আমার ওপর গুরুদের আশীর্বাদ আছে।’
ঋদ্ধিকে বলা যায়, রূপে লক্ষ্মী, আর গুণে সরস্বতী। সৃষ্টিকর্তা যেন সবকিছু উপুড় করে দিয়েছেন তাঁকে। ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছিল নাটকের গান দিয়ে। এখন পঞ্চকবির গান ও এর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত এ শিল্পী। বাবা অধ্যাপক সত্যপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়, আর মা স্কুলের প্রধান শিক্ষক রমা চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র সন্তান ঋদ্ধি লেখাপড়াতেও ছিলেন মেধাবী। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন। ইতিহাস নিয়ে ভর্তি হন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন তিনি। ঋদ্ধির বাবা ফরিদপুরের, আর মা রংপুরের মানুষ। সেই হিসেবে নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ মনে করেন।
এই ‘পঞ্চকবির কন্যা’ এখন আমেরিকায়। ২৩ আগস্ট আমেরিকায় আসেন ঋদ্ধি। ২৬ আগস্ট ডেনভারে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে নজরুল সম্মেলন ও ১৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে একক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। হার্টল্যান্ড অ্যাভিনিউতে ইস্ট কোয়েস্ট দুর্গা পূজা অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত তাঁর একক সংগীতানুষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে ‘জলসাঘর’। অতীতে আমেরিকায় এসে বঙ্গ সম্মেলন-ফোবানাতে গান করেছেন তিনি। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ঋদ্ধির ২০টি অ্যালবাম। রজনীকান্ত সেনের ওপর রচনা করেছেন প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘রজনীকান্ত’।
পঞ্চকবির গান শুধু নয়, পুরোনো বাংলা গান ও বাংলা নাটকের গানও পরিবেশন করেন ঋদ্ধি। নর্থ ক্যারোলাইনাতে একটা একাডেমিতে এবার এসে ক্লাস নিয়েছেন তিনি, যেখানে নিউইয়র্ক-ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অনেক শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিল। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ঋদ্ধি বলেন, ‘অনেক কবি, গীতিকার ও সুরকারকে আমরা তাঁদের মৃত্যুর পর ভুলে গিয়েছি। আমি চাই তাঁদের গানকে দর্শক-শ্রোতার মাঝে ফিরিয়ে আনতে। এ জন্য আমি পঞ্চকবি ছাড়াও হিমাংশু দত্ত, পুরাতনী টপ্পা, আমার গুরু শ্রীমতি মঞ্জু গুপ্ত, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, সুশীল চট্টোপাধ্যায় ও চণ্ডীদাস পালের গান করি। গানগুলোকে নতুন প্রাণ দেওয়া, বাঁচিয়ে রাখাই আমার উদ্দেশ্য, যাতে মৃত্যুর পরও তাঁদের গান নতুন প্রজন্মের মধ্যে টিকে থাকে।’
পুরোনো দিনের গান নতুন প্রজন্ম কি শোনে? ঋদ্ধি উত্তর, ‘আমি কথা ও সুর অক্ষুণ্ন রেখে কিছুটা আধুনিকতা আনার চেষ্টা করি। হারমোনিয়াম-তবলার বাইরে আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গের সংযোগ ঘটাই। তবে অনেকে আধুনিক করতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রবীন্দ্রসংগীত করে; আমি তেমনটা করি না।’
ভবিষ্যতে একটি অপেরা আয়োজনের পরিকল্পনাও রয়েছে ঋদ্ধির। এর আয়োজন করবে ঋদ্ধি মিউজিক একাডেমি। তাঁর এই একাডেমির বিশাল আর্কাইভে অসামান্য সব সংগ্রহ রয়েছে। ঋদ্ধি মিউজিক একাডেমির সংগ্রহশালায় রয়েছে ৩০ হাজার দুষ্প্রাপ্য বই ও ১৫ হাজার গানের রেকর্ড। রবীন্দ্রনাথ-অতুল প্রসাদের নিজের গলায় গাওয়া গান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বরিশালে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া রজনীকান্তের বক্তৃতা ও গানের রেকর্ড। ঋদ্ধি জানান, ‘রজনীকান্তের নিজের কণ্ঠে গান ও বক্তৃতার রেকর্ড এই মুহূর্তে আর কোথাও নেই। তাই তাঁকে নিয়ে কেউ গবেষণা করতে চাইলে আমাদের কাছে আসতে হবে।’
এ বছর ২৯ মে সংগীত জীবনের কুড়ি বছর উদ্‌যাপন করলেন ঋদ্ধি। এ উপলক্ষে কলকাতার ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন, গৌতম ঘোষের মতো নামকরা ব্যক্তিত্ব। শুধু গান নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নানা কার্যক্রম রয়েছে ঋদ্ধির। এরই অংশ হিসেবে কলকাতার সোনাগাছিতে পতিতাপল্লীর ছেলেমেয়েদের গান শেখান ঋদ্ধি; পুরোনো দিনের নাটকের গান শেখান তাদের। বিনোদিনী, কানন দেবী, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালাদের গান শেখে ছেলেমেয়েরা। কারাবন্দী নারীদেরও গান শেখান তিনি।
ঋদ্ধির স্বামী ড. দেবজিৎ বন্ধ্যোপাধ্যায় বাংলা নাটকের গানের একজন পথিকৃৎ। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বরা তাঁরও ঘনিষ্ঠ। গানের জন্য ঋদ্ধি বেলুড় লালবাবা কলেজে অধ্যাপনা থেকে ইতি টেনেছেন। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ১৯ বছর বয়সী ছেলে জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করছেন।