সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল মা-বাবার চ্যালেঞ্জ

সন্তান কার সঙ্গে মেশে জানতে হবে
সন্তান কার সঙ্গে মেশে জানতে হবে

যৌন পরিপক্বতার জন্য শরীরে যেসব পরিবর্তন আসে আক্ষরিক অর্থে বয়ঃসন্ধি সেটাকে বলতে বোঝায়। বয়ঃসন্ধিকালের উন্নতিতে মনোসামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। শৈশব ও সাবালকত্বের মধ্যবর্তী একটি মানসিক ও সামাজিক ক্রান্তিকাল এটি। বয়ঃসন্ধি সাধারণত পুরুষের ৫৫ কেজি এবং মেয়েদের ৪৭ কেজি ওজনে শুরু হয়। শরীরের ওজনের এই পার্থক্যের কারণ ছেলেদের জন্য ১২/১৩, মেয়েদের ১০/১১ বছর শেষে যৌনতার বিকাশ ঘটে, মেয়েদের ১৮ ও ছেলেদের ১৯ বছর পর্যন্ত এটা চলতে থাকে। এ সময়টিকে আমরা টিন এজ সময় বলে থাকি।
বাঙালিদের জন্য যৌন-সম্পর্কিত বিষয়টি এত কুসংস্কার ও নিষেধের বেড়াজালে ঘেরা যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের মানসিক, আচরণে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আমলে আনেন না। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বয়ঃসন্ধিকালের নানা পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা তেমন হয় না। কিন্তু এ দেশের পাঠ্যপুস্তকে যৌনশিক্ষার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রাধান্য পায়। এ দেশের শিশুদের স্কুল থেকেই যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা দিয়ে থাকে। যৌবনে পদার্পণের পর দৈহিক ও মানসিক যে পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারে আগে থেকে তাকে শিক্ষা না দিলে, তাদের ভেতর আচরণে অস্বাভাবিকতা আসতে পারে।
সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার বান্ধবী তমা ‘জরুরি কথা আছে’ বলে বাসায় ডাকলে আমি তার ওখানে যাই। তমার কাছে জানতে পারি, তার ১২ বছরের মেয়ের ছেলে বন্ধু আছে এবং তারা শারীরিক সম্পর্ক করে। কথা বলতে বলতে তমার আকুল কান্নায় আমিও কাঁদতে থাকি। তমা তার স্বামীকে বিষয়টি জানাতে চায় না। আমি বললাম, না জানানোটা অন্যায় হবে। ও জানাল, ওর স্বামী জানলে নাকি, তাকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়েকে জবাই করে ফেলবে। এ দেশে বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তমা মেয়েকে মেরেছে। বান্ধবীকে কি পরামর্শ দেব বুঝতে না পেরে এক বুক কষ্ট নিয়ে নিজের মেয়ে দুটির কথা ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরলাম। যদি এরাও এমন কিছু করে, তাহলে কী করা যাবে! তমা নিজেই মেয়েকে রোজ রাতে দুধের সঙ্গে পিল গুলিয়ে খাওয়ায় আর কাঁদে।

টিনএজ ছেলেমেয়েদের সময় দিতে হবে 
টিনএজ ছেলেমেয়েদের সময় দিতে হবে 

এটাকে কি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায়? আমরাও কি তমার মতো ভীত নই? আমেরিকার মতো দেশে আমরা ১০ থেকে ১৮ বছরের ছেলেমেয়ের মা-বাবারা কজন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি? আমরা এ দেশে এসে ডলারের পেছনে দৌড়াই, অনেকেই আছি নিজের ঘরের দিকে নজর দিই না। আর যখন দিই তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। এ জন্য ছেলেমেয়েদের যৌবনে পদার্পণের আগে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেওয়া উচিত এবং এ শিক্ষা ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান হওয়া দরকার। অভিভাবকেরা পারিবারিকভাবে ছেলেমেয়েদের যৌবনে পদার্পণের আগমনের আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারলে ভালো হয়। উঠতি বয়সী মেয়েদের সঙ্গে মায়েরা বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করা উচিত আর ছেলেদের সঙ্গে বাবারা।
এই বয়সী ছেলে-মেয়েদের আলাদা কিছু পছন্দ থাকে। কারও হয়তো কেনা-কাটায় খুব আগ্রহ আছে, কারওবা একটু বাড়তি সাজগোজ পছন্দ, কেউ আবার বেশি বেশি বাইরে ঘুরতে যেতে চায়, আবার কেউ দেখা যায় একা থাকতে চাইছে, বাইরের কারও সামনে অনেকে আসতে চায় না—সবকিছুতেই অভিমান করে। এ সময়ে তাদের কেউ কেউ নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখতে চায়। কারণে বা অকারণে রাগ করে, সামান্য কথাতেই রাগ করে রুমের দরজা বন্ধ করে ফেলা, কোন কিছু ছুড়ে মারা—আচরণে এমন সব পরিবর্তন দেখা যায়।
ছুটির দিনটাতে সারা দিন খুব কাছে থেকে ওদের লক্ষ্য রাখা ও কৌশলে মনের খবর নেওয়া খুবই দরকার। অন্যান্য দিন এক বেলা বাচ্চাদের সঙ্গে খাবার খাওয়া যেতে পারে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তারা সারা দিন কে কি করল, খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। মাঝে মধ্যে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করে ছেলেমেয়ের আপডেট নেওয়া দরকার। বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জগৎ। প্রত্যেক মানুষকেই এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এ সময় ছেলেমেয়েদের মন মেজাজ খুব ওঠানামা করে। খুব ধৈর্য সহকারে মা-বাবাকে এদের মনের ভেতরে ঢুকে পড়তে হবে।

টিনএজ ছেলেমেয়েদের সময় দিতে হবে 
টিনএজ ছেলেমেয়েদের সময় দিতে হবে 

৮ থেকে ১৯ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। কারণ এই সময়ে ওদের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক, মানসিক এবং হরমোনের পরিবর্তন হয়। এই সময়ে ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চতার ২০ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্ক ওজনের ২৫ শতাংশ লাভ করে। তাই এদের খাবার দিতে হবে পুষ্টিসমেত। তাদের বেড়ে ওঠার জন্য দরকার যেমন কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফ্যাট সম্মৃদ্ধ খাবার, যা শরীরের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। সেই সঙ্গে আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিনের প্রয়োজন হয়। সন্তানের এই বড় হওয়ার মাঝখানে একটা বিশেষ সময়ে বাবা-মায়ের অসাবধানতা কিংবা অসচেতনতার কারণেই সন্তান জড়িয়ে পড়তে পারে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে, যা ঠিকমতো বোঝার আগেই ভেঙে ফেলতে পারে মা-বাবার বা পরিবারের এত দিনকার স্বপ্ন।
আমেরিকার মতো দেশে যেখানে সবকিছুই ‘ওপেন’, আমরা চাইলেও এর পরিবর্তন করতে পারব না। ওদেরকে মুঠোফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট দিতে হবে। স্কুলে ছেলেমেয়ে মিশবেই। মেয়ে ও ছেলের মধ্যে বন্ধুত্ব হবে। আমদের না মেনে উপায় নেই। তবে আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ শেখাতে হবে। এ বয়সের কিশোর-কিশোরীরা কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো মনমরা হয়ে থাকে। এ ছাড়া আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব এ বয়সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এসব আবেগ কখনো কখনো সংঘাতের রূপ নেয়। দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে অনেক কিশোর-কিশোরী অনেক সময় অসহায় বোধ করে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার এদের উপযুক্ত মর্যাদা দেয় না। আবার কোন কোন সময় পরিবারের সদস্যদের বকাবকি ও নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে কিশোর-কিশোরীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। হঠাৎ করে এরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। অনেক সময় মা-বাবার আদেশ-উপদেশও গ্রাহ্য করতে চায় না। কোনভাবেই অতিরিক্ত শাসন করা যাবে না। অন্য বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। বয়ঃসন্ধিকালের বিমূর্ত ধারণাকে কেন্দ্র করে সেন্টিমেন্ট ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে।
এ বয়সের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বন্ধু নির্বাচন। মা-বাবার চেয়ে বন্ধুদের কথাকেই বেশি মূল্যবান মনে করে। কখনো কখনো হতাশা কাটাতে মাদকদ্রব্য, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও পর্নো ছবিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, এদের অনেকেই অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। ফলে পড়ালেখার চরম অবনতির পাশাপাশি পুরো জীবনটাই সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেঙে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। ধ্বংস হয়ে যায় সম্ভাবনাময় একটি কিশোর বা কিশোরীর জীবন। সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাবা-মাকে যে কারণে হতে হবে ধৈর্যশীল ও বাস্তবমুখী।