উথাল-পাতাল জীবনের গল্প

বিষণ্নতার চাদরে আড়াল করা শরীর টেনে নিয়ে মানুষটি রোজ পারসন্স বুলেভার্ড হয়ে রুজভেল্ট অ্যাভিনিউতে হেঁটে যায়। কখনো প্রত্যুষে সঙ্গী হয় তাঁর স্কুলব্যাগ কাঁধে দুরন্তপনা শিশুটি, কখনো অফিস থেকে ফিরতি পথে বাজারের ব্যাগ। এই পথ তাঁর খুব চেনা। এই পথ আগলে রেখেছে তাঁর বহু বছরের বিবর্ণ সময়, অন্তরালের নিশ্বাস চাপা অস্ফুট গোঙানি! কে জানত, প্রথম দিনের পারসন্সের ওপর পড়ে থাকা হরেকরঙা পাতাগুলো দেখে যে কিশোরী আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল, আজ সেই কিশোরী তিরিশোর্ধ্ব নারী, ঝরে পড়া শীর্ণ পাতা ছুঁয়ে যে বেঁচে থাকার উপকরণ খোঁজে প্রতিদিন। সেদিনের অবুঝ কিশোরী যার খাতার পাতা জুড়ে ছিল সমান্তরল ধারা সূত্রের সমাধান, আজকের এই নারী মাস শেষে বাড়ি ভাড়া, বিল, চাল, ডাল, লবণ, তেল, মাছ-মাংসের হিসাব সামলাতে হিমশিম খায়। সেদিনের স্বপ্নমনা সেই কিশোরীই আজকের তিরিশোর্ধ্ব নারী—নসিমন।
নসিমনের সামনে তখন ভয়াবহ অন্ধকার। সন্তানটিকে নসিমনের কাঁধে ফেলে হুট করে স্বামী চলে গেল। তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি, কারেন্ট বিল, টিভি-নেট, ফোন, ক্রেডিট কার্ড সব বাকি। নসিমন তখন সবে মাস্টার্স শুরু করেছে। কোর্ট মার্শাল এল বাড়ি খালি করার নোটিশ নিয়ে। ইকেলট্রিসিটি, নেট, টিভি, ফোন সব লাইন কেটে দিল বকেয়া পরিশোধ না করার দায়ে। একদিকে সংসার ভাঙার শোক, অন্যদিকে উঠে দাঁড়ানোর তাড়া! পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে স্টুডেন্ট লোনই সেবার তাঁর শেষ রক্ষা করেছিল। নসিমন বলেন, ‘শেষ রক্ষা হল কই দিদি? শেষ রক্ষার জন্য তো এখনো ছুটছি! ওই যে দেখ ওপরে, ঈশ্বর আমায় মুক্ত আকাশে ঘুড়ি বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। নাটাই সুতো তিনি খেয়াল খুশিমতো ছাড়েন, মন চাইলেই হ্যাঁচকা টানে আকাশ সীমায় পৌঁছানোর আগেই গুটিয়ে নেন। তিনি বড় রহস্যময় দিদি, বড় রহস্যময়!’
পথে হেঁটে যাওয়া পথিক যখন ছুঁয়ে দেখে বৃক্ষরাজি, সবুজের ওপর বিছিয়ে থাকা কচি পত্রপল্লব, চিত্তাকর্ষণে মুগ্ধতা নিয়ে পথিক যখন জেনে নেয় গোলাপের রং বড় সুন্দর, বেঁচে থাকা প্রাপ্তির অভিলাষ—ঠিক তখন একই পথে হেঁটে যাওয়া নসিমন খুঁটিয়ে দেখে জীবনের বৈরিতা। ছুঁয়ে দেখে ঝরে পড়া পাতা কেমন বিরহ শোকে বিছিয়ে থাকে বৃক্ষতলে। ফুল ছেঁড়ার বাসনা নয়, কাঁটাসহ ঢালটি স্পর্শের ভয় তাকে ঘিরে থাকে অনন্তকাল।
যে কিশোরী ছিল একদিন একদম অগোছালো, বাবার সোহাগী আর মায়ের আহ্লাদীপনায় স্বৈরী বাতাস, আজ সে ‘আটটা-চারটা’ অফিস করে, সন্তান পিঠে বেঁধে হরদম যুদ্ধ করে জীবনের বৈরিতার সঙ্গে। আজ সে সন্তানের সুরক্ষায় চতুর শৃগালিনীর মত গন্ধ শুঁকে শুঁকে পথ চলে। আজ নসিমন স্বৈরী হয় না, স্বৈরী বাতাসের সঙ্গে লড়াই করে। নির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে এই লড়াই নয়—সমষ্টিগত পরিবার, সমাজ, সংস্কার, রীতিনীতির বিরুদ্ধে এই লড়াই। এই লড়াই তার একার। নসিমন জানে, বৃক্ষের মত শিকড় মাটিতে পুতে দেওয়ার সংসারী জ্বালা। সে জানে, প্রবল বর্ষণে কীভাবে দেহের উত্তাপ নিভিয়ে দিতে হয়। সে জানে, আটপৌরে শাড়ির আঁচলে কীভাবে সংসারের দেনা-পাওনার হিসাব কষতে হয়। দায়বদ্ধতার শিকলে ভালোবাসার প্রার্থনা যে নিছক বোকামি; তাও সে জানে।
নসিমন ভাবে, এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়! একদিন ছেলে বড় হবে। নিজের মত করে ছেলে তার চেতনায় স্বপ্নপুরী সাজাবে। সেখানে তার স্ত্রী, কন্যা, পুত্র থাকবে। হয়তো নসিমনও থাকবে! কিন্তু নসিমনের চেতনায় কে থাকবে? তার স্বপ্নপুরীতে কেউ কি থাকবে? অসুখ করলে মাথার পাশে একটি সহানুভূতির হাত থাকবে কি? কিংবা অবসন্ন ক্লান্ত রাতে ঘুম পাড়ানি গল্প বলার মত কেউ থাকবে কি? মানুষ বলেই হয়তো বাস্তবতার কঠিন সীমারেখা ভেদ করে কোন এক মধ্যনিশিতে হাহাকার ঢুকে পড়ে নসিমনের অবচেতন মনে; বুকের ঠিক মধ্যখানে। এ হাহাকার কোন সীমারেখা মানে না, নিয়ম-রীতি কিচ্ছু মানে না।
রুজভেল্ট থেকে অল্প কিছু দূরে পারসন্স বুলেভার্ডের থার্টি এইট কর্নারের বড় গাছটির নিচে বসতে নসিমনের খুব ভালো লাগে। ঘরে-বাইরে সামলে রোজ রাতে নসিমন এই একটা জায়গায় এসে বেশ কিছুক্ষণ বসে। রাতের আঁধারে মৃত এই শহরের আকাশ কখনো কখনো হুট করে কেঁদে উঠে। নসিমন এক চুলও নড়ে না। বৃষ্টির সঙ্গে আঁধার, আঁধারের সঙ্গে ধূসর বিবর্ণ স্মৃতির অদ্ভুত এক যোগসূত্র রয়েছে। এমন রাতে নসিমন বড় উদাসী হয়! এমন রাতে নসিমন ভাবে, বৃষ্টির তোড়ে মনের সব গ্লানি, ক্লান্তি, অভিলাষ, শোক সব যদি আচমকা মুছে যেত! যদি টিকে থাকা আরও কিছু সহজ হতো! চাইলেই কি সব হয়? জীবন চলে জীবনের নিয়মে। ভাবনার সঙ্গে জীবনের বোঝাপড়া কালও হয়নি, আজও হওয়ার নয়।
উত্থান-পতনের গল্পগুলো এমনই, দৃশ্যপট একই থাকে। শুধু অবস্থান ও জীবন চিত্র বদলে যায়।