উৎসব যেন নীলকণ্ঠ পাখি

আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্পর্শ, প্রথম অনুভূতি ও প্রথম নিষ্পাপ আকাঙ্ক্ষার নাম মা এবং মাতৃভূমি। কিছু কিছু ভালোবাসার প্রতিদান এক জীবনে কোনো কিছুর বিনিময়ে পরিশোধ করা যায় না। আজকের আপাদমস্তক এই আমি সবটাই মায়ের প্রতিবিম্ব। হাঁটি হাঁটি পা পা করে মায়ের কোলে মাতৃভূমির আলো-বাতাস, কাঁদা-জলে একটু একটু করে বেড়ে উঠেছি। জননী ও মাতৃভূমির কাছে আমি আজন্ম ঋণী। প্রিয় মা ও মাতৃভূমি ছেড়ে জীবনের প্রয়োজনে বিদেশের মাটিতে পা দেওয়ার পর থেকেই কঠিন জীবনসংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছি। ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার সঙ্গে পথ চলতে চলতে ক্লান্ত আমি প্রতি রাতে চোখ বুজবার আগে ক্যালেন্ডারের পাতায় দিন, মাসের ওপর চোখ বুলিয়ে নিতাম। দেশে যাওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় দিন, মাস, বছর গুনতাম। দেশে যাওয়াটা তখন ছিল উৎসবের মতন। ডাকযোগে প্রায় প্রতি সপ্তাহে মা-বাবার চিঠি পেতাম। সব চিঠিতে প্রশ্ন একটাই, কবে দেশে আসবি? তখন মুঠোফোন বেশ দুর্লভ ছিল। এখনকার মতো সবার হাতে হাতে মুঠোফোন এমন সহজলভ্য ছিল না।
দেশে যাব শুনলেই মায়ের বিরাট আয়োজনের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে যেত। আমার প্রিয় নারিকেলের চিড়া, সন্দেশ, আমসত্ত্ব, জলপাই আচার, শুকনো শিমের বিচি, খেজুরের গুড়, চালের গুঁড়ো, হাতে বানানো নানা রকমের পিঠা—সব মা তাঁর আলমারিতে তুলে রাখতেন। আলমারির চাবি থাকত মায়ের কাপড়ের আঁচলে। সাত রাজার ধনের মতো মা সে চাবি সযত্নে আগলে রাখতেন। পুকুরের বড় মাছ, খোঁয়াড়ে মুরগি, খোঁপে কবুতরের বাচ্চা, ঘরে বড় পাতিলে শিং, মাগুর, কই মাছ পানি দিয়ে জিইয়ে রাখা—সবই ছিল দেশে যাওয়া উপলক্ষে আমার জন্য মায়ের মহা আয়োজনের অংশ।
জুলাই মাস। ছোট ভাই ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করতে দেশে যাচ্ছে। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় দিয়ে শূন্য চোখে ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলাম। মনের ভেতর বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল মায়ের আকুতি মেশানো কথাগুলো। ‘সাজুর সঙ্গে তুইও দেশে আয়। আমাকে দেখে যা। একবার দেশে এসে ঘুরে যা। ঘরের সামনের দরজা খুলি না অনেক দিন হয়ে গেল। এত বড় ঘরের পেছনের দরজায় আমার দিন কেটে যায়। তোর বাবা নেই বলে আমার কাজের ব্যস্ততাও কম। এত বড় বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। এবারের রমজান মাসের ঈদে সাজুর সঙ্গে তুইও আয়। তোরা সবাই আসলে বাড়িটা অনেক দিন পর এবারের ঈদ উৎসবে মুখরিত হবে।’
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মায়ের অনুরোধ রাখতে পারিনি। আমি সেবার ঈদে বাড়ি যাইনি। মাকে কথা দিয়েছিলাম, আর কটা মাস অপেক্ষা করেন। আগামী বছর বাড়ি আসব। ছোট ভাই বাড়ি যাওয়ার এক সপ্তাহ পর শবে কদরের দিন সকালে ফজরের নামাজ শেষে বিশাল বাড়ি-ঘর ছেড়ে মা মাটির ছোট্ট ঘরে চলে গেলেন।
বাবাকে হারিয়ে মা ছিল সুখ–দুঃখের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ইচ্ছা ছিল, দেশে গিয়ে মায়ের হাতে মাখানো ভাত খাব। প্রাণভরে মায়ের গায়ের গন্ধ নেব। হঠাৎ দেশে গিয়ে মায়ের প্রিয় মোটা পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি পরে পেছনে থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে চমকে দেব। শাড়ি পরলে মা খুব খুশি হতেন। ইচ্ছা ছিল, মায়ের বুকের ওমে হাত-পা গুটিয়ে সারা রাত ঘুমাব। সুখ স্বপ্নে বিভোর হব।
হল না, কোনো ইচ্ছাই পূর্ণতা পেল না। দুহাত বাড়িয়ে আমার অপেক্ষায় দেশে পথ চেয়ে এখন আর মা নেই। আমিও এখন আর ক্যালেন্ডারের পাতা দেখি না। দেশে যাওয়ার উৎসবের বন্যায় ভাসি না। দিন, সপ্তাহ, মাস শেষে বছর গত হয়, গতানুগতিক সকাল, বিকেল, দুপুর হয়। দিন শেষে শ্রান্ত, নির্ঘুম আমি অসহায়ের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, এত এত অন্ধকার পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটে মাকে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলব, আগে তো জানতাম না।
ঈদুল ফিতরের দুদিন আগে মা চিরতরে আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। মা যেবার চলে গেলেন, সেবারের ঈদুল ফিতরের দিনের কথা আমার মনে নেই। পরের বছর থেকে রমজান মাসে শবে কদরের পর থেকে ঈদের উৎসবে যখন চারপাশ মুখরিত, তখন আমি শরীরে একধরনের খিঁচুনি বোধ করি। ছোটবেলায় নানুর মুখে শুনেছি, আমার গায়ের বর্ণ নাকি হলুদাভ। মা মারা যাওয়ার পর থেকে ঈদ উৎসব যত কাছে আসে, কষ্টে আমার শরীরের বর্ণ ততই যেন নীলচে হয়ে আসে। অনুভূতিরা নির্বোধ হয়ে থাকে। উৎসবের কোনো রং আমাকে টানে না। চেষ্টা করেও ঈদ উৎসবে আনন্দ করতে বা হাসতে পারি না। আজও নতুন জামা পরতে পারি না। কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে না। মায়ের ডাকে মায়ের বুকে ছুটে যেতে না পারার কষ্টে বুকের গহিনে প্রচণ্ড একটা অপরাধবোধ কাজ করে। আমি নিজেও আজ মা। তাই বুঝতে পারি, সন্তানকে কাছে পাওয়ার জন্য মায়ের বুকের তীব্র হাহাকারের ব্যথা।
ঈদের দিন ভোর হলেই আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, মায়ের অজু করার কলের জলের শব্দ। সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গেই শুনতে পাই, সেমাই রান্না করতে নারিকেল তুলে দিতে মা আমাকে নাম ধরে ডাকছেন। বেলা বাড়তেই মায়ের হাতে ঘি দিয়ে রান্না করা পোলাও, জর্দার সুঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করে।
কিছু কিছু অনুভূতি আছে যা শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় বোঝানো যায় না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এখানেই ভাষার সীমাবদ্ধতা। এতটা জীবন্ত আর স্বচ্ছ আমার অনুভূতিগুলো, যা শুধু আমিই অনুভব করতে পারি। মা বিদায় নেওয়ার পর আমার জীবনের বর্ণিল উৎসবগুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
মা ও মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকার তীব্র যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে বিদেশে প্রতিনিয়ত পথ চলি। অবাক পৃথিবী তার চেয়েও বেশি অবাক করা পৃথিবীর মানুষ প্রজাতি। মানুষ যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। জগতের মিথ্যা কথাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মাকে বলেছি, আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচব না। অবধারিত মৃত্যু যেন আপনার আগে আমার হয়। সে আমি দিব্যি বেঁচে আছি। বিচ্ছেদের সঙ্গে পথ চলতে চলতে এখন আর কোনো কিছুতেই কান্না পায় না। ভেঙেও পড়ি না। শুধু বুক ব্যথা করে। চোখ পুড়ে যায়। যান্ত্রিক এই শহরে উৎসবগুলোকে মনে হয় সোডিয়ামের নীল আলোয় মোড়ানো নীলকণ্ঠ পাখি।