কারি এনেছে সিলেটের জৌলুশ

ইমরান আহমেদ চৌধুরী
ইমরান আহমেদ চৌধুরী

ইংরেজি ভাষায় একটা অতি প্রাচীন প্রবাদ আছে, ‘ভিকটিম অফ অওন সাকসেস’। ঘটনা অনেকটা তাই। গ্রেট ব্রিটেন বলতে যা বোঝায় ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের এমন কোনো নগরী, বন্দর, শহর, গ্রাম নেই যেখানে বাংলাদেশিদের রেস্তোরাঁ নেই। বাংলাদেশিরাই একমাত্র সম্প্রদায় যারা ব্রিটিশ জাতিকে উপহার দিয়েছে একটা ‘জাতীয় কারি’ যার নাম ‘চিকেন টিক্কা মসল্লা’।
৩-৪ বছর বয়সী শিশুরাও জানে ‘জাতীয় কারি’ চিকেন টিক্কা মসল্লার নাম। ব্রিটেনের গত ২ হাজার বছরের ইতিহাসে অন্য কোনো অভিবাসী সম্প্রদায় এমন ইউনিক কিছু করতে পারেনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সর্বজনস্বীকৃত এমন কিছু প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। যুক্তরাজ্যের অভিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এটি অনেক বড় একটি স্বীকৃতি।
যুক্তরাজ্যের আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই কারি রেস্তোরাঁ ও টেকওয়ে ব্যবসার বিশাল প্রসার হয়েছে। বাংলাদেশিদের জন্য রেস্তোরাঁ ব্যবসা বিরাট এক সামাজিক প্রতিপত্তির উদাহরণ। অক্লান্ত পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ফসল পেয়েছে বাঙালিরা। বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে তাঁদের ব্যবসায়িক গুণাবলি ও উৎকর্ষ।
কথায় বলে, গ্রেট ব্রিটেনের সাম্রাজ্যে একদা সূর্য অস্ত যেত না—এতই বিশাল ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। যার ফলশ্রুতিতে এই দেশে বর্তমানে বসবাস করে সেই সব উপনিবেশের বিশাল জনগোষ্ঠী। অন্য কোনো কলোনির অধিবাসীরা আজও অর্জন করতে পারেনি বাঙালিদের মতো অবস্থান। এটা যে কী গর্বের বিষয়, তা ব্রিটেনে বসবাস বা পর্যটক হিসেবে না আসলে দুর থেকে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী ব্রিটেনে বাংলাদেশি মোট অভিবাসী জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যার ০ দশমিক ৭ শতাংশ মাত্র। কিন্তু ওই ০ দশমিক ৭ শতাংশ জনগণ ব্যবসায়িকভাবে ১০০ শতাংশ জায়গায় বিদ্যমান। একবার ভেবে দেখুন, কি বিশাল এই ব্যবসায়িক সাফল্য!
এই ব্যবসার সাফল্যের প্রমাণ স্বচক্ষে অবলোকন করতে কেউ উৎসাহী হলে, যেতে হবে ব্রিটেন বা আমেরিকা থেকে যথাক্রমে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার ৮০০ মাইল দূরে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক নিসর্গ ঘেরা সিলেট অঞ্চলে। খাসি পাহাড়ের ছায়ার চাঁদরে ঢাকা, নীলাভ হাওরের জলে, সবুজ চা গাছের মসৃণ পাতার প্রতিচ্ছবির প্রতিবিম্ব ঘেরা এলাকায়। স্বচক্ষে দেখা যাবে উন্নয়নের ফিরিস্তি, অট্টালিকা ঘেরা সবুজ গ্রাম, প্রাসাদসম বিশাল নব্য রাজার রাজবাড়ি। গ্রামে-গঞ্জে চোখে পড়বে ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্র, উন্নত মানের চিকিৎসালয়, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমারোহ—যেন একটি প্রতিপত্তি-উন্নয়নের মহামেলা। জাফলং থেকে চুনারুঘাঁট, জকিগঞ্জ থেকে দিরাই, সুনামগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গল—এসব এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের ভেতর এক অন্য দেশ। এক কসমোপলিটন সিলেট, ভিন্নরূপী এক জনপদ। আর এসবের অর্থের প্রধান ও একমাত্র উৎস ব্রিটেনের কারি ব্যবসা।
প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত, ১৯৬০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এসব কারি ব্যবসায়ী কম করে হলেও বাংলাদেশে ৫ হাজার কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে পাঠিয়েছেন। কারি ব্যবসার অবদান বাংলাদেশের তথা ব্রিটেনের অর্থনীতিতে রেখে আসছে এক বিশাল অবদান।
অথচ এখন অনন্য এই কারি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই কারি ব্যবসা নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে এক অনিবার্য অনিশ্চয়তায়। দিনে দিনে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে বাঙালির এই অর্জিত গৌরব। অনেক কারি ব্যবসা আজ বন্ধের উপক্রম। কিন্তু কেন? কারি ব্যবসার সমস্যা আর সংকটের গল্প আমরা শুনব অন্য একদিন।

লেখক: যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পাবলিক স্পিকার ও কমিউনিটি লিডার।