ফিরে পাওয়া সেই নদী

সাবিহা শাহনাজ স্বপ্নীল
সাবিহা শাহনাজ স্বপ্নীল

প্রথম যেদিন এই দেশে পা রেখেছিলাম, গাছগুলো ছিল কেমন বিবর্ণ। পাতা নেই, ফুল নেই—শুধু এলোমেলো বাতাস বইছে। দেশ ছেড়ে আসার কষ্টে ভেতরটা কেমন জানি হুহু করত সারাক্ষণ। বিষণ্নতার ছোঁয়া বোধকরি প্রকৃতিতেও লেগেছিল। কোন সুখের আশায় দেশ ছাড়লাম? এই দেশ তো আমার না, আমি কি করে এখানে থাকব? কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়েছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। আসলে আমেরিকার কোন কিছুই আকর্ষণ করত না দেশের মতো।
আমি থাকি নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটিতে। বিশাল ব্যস্ততম এই শহরে সময়ের বড়ই অভাব। সবাই ছুটছে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। বাস্তবতা এখানকার মানুষকে কঠিন থেকে কঠিন করে তুলেছে। কারও কাছেই যেন দুদণ্ড সময় নাই নিজের জন্য অথবা অন্য কারও জন্য। অনেকের মুখেই শোনা যায়,‘টাইম ইজ মানি’। আসলে এটাই কঠিন বাস্তবতা, কারণ বিশ্বের উন্নত দেশে টিকে থাকতে হলে একটু হিমশিম তো খেতেই হবে। এ দেশের আলো–বাতাস এবং নিয়ম–কানুনের সঙ্গে আমি জন্ম থেকে পরিচিত নই, একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছি। এখানে কারও মন খারাপ অথবা সুখ–দুঃখ শোনার সময় কারওরই নেই।
এই ভিনদেশে শুধু একজন আছে, যে আমার সব কথা শুনেই যায়, কিন্তু বলে না কিছুই! সৌভাগ্যক্রমে সে আমার খুব কাছাকাছি থাকে, আমার দীর্ঘশ্বাস, আমার চোখের জল, আমার মা, মাটি, দেশকে ছেড়ে আসার দুঃখ–বেদনা, অথবা পাওয়া না–পাওয়ার কষ্ট তার কাছেই বলি এবং কিছু সময়ের জন্য হলেও বুকে শান্তির পরশ নিয়ে আসি...। সে আমার প্রিয় ইস্ট রিভার। ইস্ট রিভারের পাড়ে স্নিগ্ধ সুন্দর মনোরম পরিবেশে আমার মেয়ে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ায় আর আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনার জগতে ভেসে যাই...। মনে হয় যেন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা অথবা কর্ণফুলী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি আর ছোট–বড় নৌকা, পাল তোলা নৌকা, মাছভর্তি জেলেদের নৌকা ভাসছে নদীর বুকে।
ছইওয়ালা নৌকায় করে নতুন বউ বাপের বাড়ি নাইওর যায়, কত সুখের স্বপ্ন তার চোখেমুখে খেলে যায় আর বেরসিক মাঝি গান ধরেছে, ‘আর কতকাল ভাসব আমি দুঃখের সারী গাইয়া, জনম গেল ঘাটে ঘাটে আমার জনম গেল ঘাটে ঘাটে ভাঙা তরী বাইয়া রে, আমার ভাঙা তরী বাইয়া’। আর আমি নদীপাড়ের টঙ্গ দোকানটায় বসে গরুর দুধের চায়ে নাবিস্কো বিস্কুট চুবিয়ে চুবিয়ে চা খাচ্ছি আয়েশ করে ...আহা কল্পনায়ও যে এতো সুখ আছে, তা আমার মতো কয়জনে অনুভব করতে পারে? হয়তো পারে, না–হলে শত শত বাঙালির ভিড় কেন ইস্ট রিভারের পাড়ে?
কল্পনার এই সুখ খুঁজতেই আমার মতো অনেকেই হয়তো এখানে আসে। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠে মায়ের জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য! বিদেশে না আসলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না, নিজের দেশের প্রতি এতটা টান, মনে পড়ে এই দেশে আসার পর প্রথম ১৬ ডিসেম্বরে একটা অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতে অংশগ্রহণ করেছিলাম—‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। পরের অংশটুকু আর বলতে পারিনি, কেঁদে–কেটে বুক ভাসিয়েছিলাম। বাঙালি মানুষ দেখলেই উসখুস করি কথা বলার জন্য, প্রায় সবাইকে একই কথা জিজ্ঞেস করি। কত বছর হলো এখানে আছেন? এ দেশে আপনার কে আছে? দেশের জন্য মন কাঁদে না? কত বছর পর পর দেশে যান? একেকজনের উত্তর একেক রকম, শুধু একটি উত্তরই মিলে যায় সবার সঙ্গে। তা হচ্ছে, দেশের জন্য ভীষণ মন কাঁদে কিন্তু কি করব উপায় নেই। ছেলেমেয়ের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বেঁচে থাকার তাগিদে এই ভিনদেশকেই আপন করে নিয়েছি আমরা। আহা কত মানুষের বুকে কত না–বলা বেদনা লুকিয়ে আছে তা একমাত্র ইস্ট রিভারই জানে।
বাংলাদেশ থেকে কেউ একজন আসার সময় আমাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিল, কী আনবে আমার জন্য। আমি বলেছিলাম এক মুঠো মাটি নিয়ে এসো। কত বছর দেশের মাটির ঘ্রাণ পাই না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সারি বেঁধে রিকশা টুং টুং শব্দে ছুটেছে গন্তব্যের দিকে, রিকশার নিচে হারিকেন বাতিগুলো টিপ টিপ করে জ্বলছে আর চোখের জলে তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে...। নদীর ওপারে ম্যানহাটনের উঁচু দালানগুলোতে একসঙ্গে সব বাতি জ্বলে উঠেছে, ঝলমল করছে নিউইয়র্ক নগর। নিউইয়র্ক তো ঘুমায় না, ঘুম পাড়ানো মাসিপিসি যে এখানে আসে না...। আমার মেয়ের আজকের মতো ইস্ট রিভারের পাড়ে খেলা শেষ। সে আমার আঙুল ধরে টানছে আর বলছে, ‘মাম্মি গো হোম, আই এম সো...টায়ার্ড’। সে জন্মসূত্রে আমেরিকান, তার এই দেশটাই নিজের দেশ। এখানেই স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হবে সে, এটাই স্বাভাবিক। আমার মতো করে না হলেও আমি চাই, আমার মেয়ে যেন তার দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমার দেশকে কিছুটা হলেও ভালোবাসতে পারে।