সম্পর্ক এবং পরিবার

‘এ হেম মে আ কর ইনসান কাভি কাভি গলতি কর বেটতাহ, অর ইসছে রিস্তেতো টুট নেহি যাতা? ইস সময় পর আপ কো উহা হোনা চাহিয়ে।’
এই হিন্দি কথার অর্থ হলো, ‘অহংকারের জন্য মানুষ কখনো কখনো ভুল করে বসে, তাই বলে তো সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না? এই দুঃসময়ে তোমার তো ওই বাড়িতে থাকা উচিত।’
বিখ্যাত কালজয়ী উপন্যাস দেবদাস থেকে নির্মিত হিন্দি সিনেমার সংলাপ এটি। রোমান্টিক ছবি হলেও এটা একটা পারিবারিক দুঃসময়ের মুহূর্ত। এক সময়ের অতি আপনজন সেখানে থাকবে না, অভিমান বুকে নিয়ে বসে থাকবে?
আমার যতটা মনে পড়ে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বইটি পড়েছি। কিন্তু আমার দেখা হিন্দি সিনেমার সংলাপটাই মাথায় গেঁথে আছে। আজ অনেক ভাঙন দেখি, তাই মনে করা। শরৎ বাবু পারিবারিক সম্পর্ক জোড়া লাগাতে ঠিক কীভাবে এটি বাংলায় ব্যবহার করেছিলেন আমার মনে নেই। গল্পের কাহিনি প্রেম বিরহ হলেও এটা ছিল মায়ের প্রতি পার্বতীর সংলাপ। জমিদার নারায়ণ মুখার্জি মারা যাচ্ছেন, এমন সময় পার্বতী ফেরা যাত্রায় এসে দেখলেন, মা সেই বাড়িতে যাননি। মায়ের মনে কষ্ট, কারণ পারু দেবের বিয়েতো মানেননি বরং মধ্যরাতে পার্বতী যখন দেবদাসের ঘরে গিয়েছিল, মেয়েকে তিনি বেশ্যা বলেছিলেন।
এ রকম মান-অপমান, অভিমান-দুঃখের ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটছে আপনার-আমার ঘরে। ভুল মানুষের হয়ে যায় অনেক সময়, তাই বলে কীভাবে সম্পর্ক সত্যিই শেষ হয়ে যায়? আরও বেদনাদায়ক হয় যখন রক্তের মাঝে ফাটল ধরে। এ জিনিসটা আমাকে কষ্ট দেয় খুব যখন শুনি বা দেখি, কোনো ভাই তার বোনের সঙ্গে কথা বলে না বা কোনো বোন কথা বলে না। সত্য বলতে খুব কাছের মানুষদের মাঝেও এ রকম দেখেছি, দেখছি। খুব মায়া-মমতা দিয়ে যে সম্পর্কগুলো জন্মের আগে থেকে বাঁধা আছে, তা পারিবারিক দ্বন্দ্ব, মান-সম্মান, ছুরির ফলার মতো কথার আঘাত বা ভুল বুঝে অন্য কারও প্ররোচনায় নিমেষে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ প্রতিনিয়ত তার আবেগের গলা টিপে নিজের অনুভূতিকে হত্যা করছে। ছোট বোনের ভুলের জন্য এক ভাই ভুলে যায়, সে তার পুতুলের মতো বোনের হাত ধরে একদিন চানরাতে ঈদের জামা কিনতে শপিংয়ে যেতো। বোন ভুলে যায়, এই ভাই–ই তার সব আনন্দ কিনে দিত। এগুলোকে পেছনে ফেলে ঘৃণা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে! আসলে ভালোবাসা মায়া-মমতাগুলো বড়, ঘৃণা কখনোই বড় হতে পারে না।
বহু বছর আগে আমার ছোটবেলার স্কুলজীবনের এক বান্ধবী, তার পরিবার ও তার চাচার পরিবারের সঙ্গে আমার আলাদা আলাদা সখ্য ছিল। কিন্তু তারা যে আপন চাচাতো বোন আমি জানতাম না। এতে তাদের দোষ নেই। তাদের বাবা-চাচা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতেন না। বিষয়টা জেনেছি অনেক বছর পর আমার চাকরি জীবনে এবং আমি সত্যিই মর্মাহত হয়েছি, কী করে এটি সম্ভব? তাঁরা কেউই এখন বেঁচে নেই। হয়তো কোনো অভিমান, কোনো স্বার্থ দেয়াল তুলে দিয়েছে রক্তের ভাইদের মধ্যে। অথচ এ রকমই এক ভাই, আরেক ভাইকে ফাঁসি থেকে বাঁচাতে গিয়ে খুনের দায় দিয়েছিলেন ছোট বউয়ের ওপর। মনে আছে আপনাদের রবীন্দ্রনাথের শাস্তির সে সংলাপ?
‘বউ মরলে বউ পাওয়া যাবে, ভাই তো পাওয়া যাবে না!’
লেখক, সাহিত্যিকেরা যুগে যুগে ন্যায়-অন্যায়ের চরিত্র দিয়ে হলেও পারিবারিক বন্ধনগুলোকে জুড়ে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু সময়ে সময়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে সব। কবে এ ক্ষত রোধ হবে? আমার এই লেখাও কাজে আসবে কীভাবে, জানি না। কোন পরিবারের দ্বন্দ্ব কীভাবে কমবে? কোন বড় ভাই তার বোনের কষ্টের সময়, অভিমান ভুলে মাথায় হাত রাখবে কিনা জানি না। না কীভাবে দূর থেকে শুধু অভিমান জমা করে বলবে—
‘আহা পারতাম, যদি পারতাম,
আঙুলগুলো ছুঁয়ে থাকতাম ।
বিষাদেরই জাল, টালমাটাল,
এ কোনো দেয়াল, এ কোনো আড়াল’
এই অভিবাসী আমেরিকান ভাই তার ছোট বোনটাকে খুব ভালোবাসে। ওই যে লিখেছি, চাঁন রাতে জামা কিনে দেওয়ার ভাইবোন এরা। এখান থেকে গিয়ে ঘরে পৌঁছেই সে বোনকে নিয়ে শপিংয়ে যেতো। আমি নিজেই এদের সে দিন ব্লু ওয়াটার শপিং মলে পেয়েছি। সে বলেছিল, তার বোনটিকে আমেরিকায় নিয়ে আসবে এবং নিয়ে এসেছিলও। তার সে ছোট বোন আস্তে আস্তে বড় হলো, এত বড় হলো যে একদিন তার হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। সে ভুলে গেল কাজ শেষ হলে এই ভাই তাকে বরফ ঢাকা পথে গাড়িতে করে ঘরে নিয়ে আসত। স্বাধীন হওয়ার স্বপ্নে এত বিভোর হলো যে, সে উড়তে শুরু করল। নিজের স্বপ্ন, ভুল পথ, নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে একাই পথ চলতে শুরু করল। ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা তো দূরে থাক, কখনোই অনুতাপ অনুশোচনা বা ভুলের জন্য ভাইয়ের কাছে ক্ষমাও চাইত না। তাকে বোঝানোর পরও যেন মাথা নত করতে রাজি নয়। পাঁচ বছর হয়ে গেছে অভিমানী ভাইটাও আর কখনো ফিরে দেখেনি। সে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে যে, তার কোনো বোন ছিল। দেখা না গেলেও এক অদৃশ্য দেয়াল উঠে গেছে। কিন্তু রক্তের বন্ধন মুছে ফেলার ইরেজার বিধাতা দেননি। তাই দূর থেকে মানুষ বলে অমুকের বোন, তমুকের ভাই।
তারপর সব চলছিল সুন্দরভাবে, তাদের পৃথক পথে। কিন্তু প্রকৃতির কাছে এ সুন্দর সুন্দর নয়। সে আকাশে ওঠার সিঁড়ি দেয় সত্য। কিন্তু কখন জানি নিদারুণভাবে নিচেও ফেলে দেয়। হয়তো সে অসামঞ্জস্য সইতে পারে না। মায়ার বন্ধনগুলো এভাবে ছিন্ন হোক আমরা মানলেও প্রকৃতি মানে না। হয়তো তাই প্রকৃতিও মানুষের সঙ্গে এক খেলা খেলে।
পঁচিশ বছর বয়সী নবযৌবনা বোনটি হঠাৎ কঠিন অসুখে পড়েছে। অসুখটা মারাত্মক! চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে, এডিনয়েড সিস্টিক কার্সিনোমা (Adenoid Cystic Carcinoma)। মেয়েটার খুব দ্রুত একটা অস্ত্রোপচার করতে হবে। ভাই খবর পেয়ে নিশ্চয় ছুটে আসবে, এটা আমার বিশ্বাস। বোনের আঙুলগুলো আবারও হয়তো মমতায় ছুঁয়ে দেবে। সব আড়াল দূর হবে। প্রকৃতি খুশি হবে, আমরাও খুশি হব। একটা বড় পরিবারের বড় আনন্দ, আবার বড় হবে। বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে, সে তার আশীর্বাদে মানুষকে নবজীবন দেবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদের সঙ্গে প্রিয়জনের আশীর্বাদ যোগ হলে বিধাতাও নিশ্চয় মুখ ফিরিয়ে থাকবেন না। একটা দৈবাৎ কিছু ঘটবে! তারা আবার এক সঙ্গে ঈদের জামা কিনবে। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখবে। প্রকৃতি তাকে ক্ষমা করে দেবে, ভাইও দেবে। মেয়েটি আবারও শিশুর মতো নতুন জীবন পাবে ।
অবশেষে বলতে চাই, পথ চলতে আমরা জীবনে বন্ধু-বান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী অনেককে পাব। কিছু সম্পর্ক দৃঢ় হবে, কিছু হয়তো মুছে যাবে। কিন্তু ভাইবোন, ছেলেমেয়ে, মামা-খালা, চাচা-ফুফু সম্পর্ক কখনো মুছে যায় না। আমাদের বন্ধু উজ্জ্বল দাস মাঝেমধ্যে এ যুগের প্রজন্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে, তাদের মধ্যে আমাদের মতো বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই। আমি ইতিবাচক মন্তব্য করে না মানলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি যে খুব ঠিক। আমাদের সময় বড়রা কথা বললে, ছোটরা কথা বলা ছিল বেয়াদবি। কিন্তু আজকাল অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মা–খালাদের আলাদা করে দেয়। আমার মা-খালাও অভিমান করতেন কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস আমাদের হতো না, কথা বলা তো দূরের কথা!
পারিবারিক সম্পর্কগুলো এক অমূল্য সম্পদ যা কখনো হারিয়ে যেতে দিতে নেই। মায়া–মমতা শ্রদ্ধা ভালোবাসায় বেঁধে রাখতে হয়। আরেকটি কথা, বাবার রক্ত হোক আর একই মায়ের নাড়িতে হোক তারা কোনো না কোনোভাবে বাঁধা। তাই সৎ ভাই-বোন বলেও কিছু নেই। অনেক সৎ ভাই-বোনের মধ্যেও গভীর মমতা দেখেছি। সেই বোন আর ভাইটিও দুই মায়ের সন্তান। কিন্তু তাদের চোখে কখনো ভিন্ন মাত্রা দেখিনি, সেই অভিন্ন মাত্রায় সব ভাইবোন পরিবার বাঁধা থাকুক।