অরিত্রী ও আমাদের শিক্ষক সমাজ

অরিত্রী অধিকারী
অরিত্রী অধিকারী

হায়! এখনো কোন অলস দুপুরে যখন অফিসের টেবিলে কফি মগে চুমুক দিতে দিতে ছেলেবেলার কোন স্কুলশিক্ষকের কথা স্মরণ করি, তখন কারও কারও কথা মনে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা যেমন নুয়ে আসে। আবার কারও কারও দানবের মতো চেহারা মানসপটে ভেসে উঠলে ভয়ে শিউরে উঠি। যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন ভিকারুননিসা নুন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা নিয়ে চারপাশে সরব আলোচনা হচ্ছে, পত্রিকার পাতায় প্রধান খবর হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে জোর আলোচনা–সমালোচনা চলছে, হরতাল হচ্ছে, প্রতিবাদ সভাও হচ্ছে।
যদি ধরে নিই, অরিত্রী আত্মহত্যা করেননি। তাহলে কী হতো? এই বাস্তব ঘটনাটি নিয়ে হয়তো কেউ কোনো কথাই বলতেন না। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম জনগণের নাকের ডগায় চলে আসার কারণে এসব বিষয় মানুষ জানতে পারছে। অথচ আমাদের দেশে একজন শিক্ষক একজন ছাত্রকে বেত্রাঘাত করবেন, কানে ধরে ওঠবস করাবেন, কান মলে লাল করবেন—এটাতো খুব স্বাভাবিক এক ঘটনা। তাই নয় কি? শুধু আমাদের দেশ নয়, গোটা উপমহাদেশেই এই চর্চাটি যেন যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে।
কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, স্কুল জীবনে কোন শিক্ষকের হাতে তিনি কখনো শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিপীড়নের শিকার হননি? আমাদের দেশে ছাত্র পেটানোর বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল আছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, শিক্ষকেরা তাঁর ছাত্রদের পিটিয়ে সম্ভবত একরকম আত্মিক সুখ উপভোগ করতেন। আমি যে স্কুলে পড়েছি (সংগত কারণে স্কুলের নামটি প্রকাশ করছি না) সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার আপন বড় চাচা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কিছু স্কুলশিক্ষক আমার পিঠেও বিভিন্ন কায়দায় তাদের জৌলুশে ভরা বেতটি ওঠাতে কখনোই কার্পণ্য করতেন না। চলুন এবার একজন একজন করে আমাদের সেই অত্যাচারিত শিক্ষকদের চেহারা একটু স্মরণ করি।

‘দিজে’ স্যার
সপ্তম শ্রেণি। ইংরেজির শিক্ষকের নাম ‘দিজে’ স্যার (পুরো নাম গোপন করলাম কারণ তাঁদের শিক্ষক বলে এখনো হয়তো সম্মান করি)। তাঁর সঙ্গে পরিচয় সেই সপ্তম শ্রেণিতেই। ছাত্রদের তিনি এক অভিনব কায়দায় পেটাতেন। কোন কারণে স্কুলে পড়া না পারলে তিনি সেই অসহায় ছাত্রকে তাঁর ডেস্কের সামনে আসতে বলতেন। তারপর বলতেন, মাথা নত করে (যেভাবে ছাগল বলি দেওয়া হয়) তার টেবিলের ওপর রাখতে। তিনি তখন সেই ছাত্রটির ঘাড়ে হাত মুঠ করে কিল ঘুষি মারতেন। একদিন আমার ভাগ্যেও ঠিক এমন একটি লজ্জাজনক ঘটনা ঘটল। আমি লজ্জায় অপমানে ক্লাস থেকে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে সেকি কান্না! আমার কান্না দেখে আব্বা পুরো ঘটনা জানতে চাইলেন। আব্বা ছিলেন পাশের একটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। স্থানীয় হিসেবে তাঁর বেশ সম্মান ও নামডাক ছিল। আমার কাছে পুরো ঘটনা শুনে তিনি আমাকে নিয়ে চললেন স্কুলে। আব্বা দ্রুত পায়ে হাঁটছেন আর আমি ঠিক তার পেছন পেছন হাঁটছি। আমার কাছ থেকে শুধু জেনে নিলেন শিক্ষকের নামটা। তিন দাঁত কটমট করে উচ্চারণ করলেন ‘দিজে’। তিনি সোজা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকলেন। প্রধান শিক্ষক যেহেতু আমার বড় চাচা, তাই তিনি আমাকে আর আব্বাকে এভাবে আসতে দেখে একটু অবাক হলেন। আব্বা চাচাকে খুব সম্মান করতেন। কিন্তু সেদিন দেখলাম আব্বার চোখ রেগে লাল হয়ে আছে। আর তিনি রাগে কাঁপছেন। চাচাকে বললেন, ‘আপনি স্কুলে এসব শিক্ষক নামের কী পুষছেন? ওই.....টাকে এক্ষুনি এখানে ডাকেন। ওকে আর এই স্কুলে রাখা যাবে না...।’
আব্বা তখন খুব উত্তেজিত। চাচা সব কথা শুনলেন। আব্বাকে শান্ত হতে বললেন। আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। পকেট ভরে লজেন্স দিলেন। শিক্ষক ‘দিজে’ চাচার কক্ষে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আব্বা চিৎকার দিয়ে পুরো বিষয়টার জন্য তাঁকে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। চাচা এবার আব্বাকে আবারও শান্ত করলেন এবং পুরো বিষয়টা তাঁর ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য আব্বাকে অনুরোধ করলেন। চাচাই সেই শিক্ষককে আমার সামনেই অনেক কড়া কড়া কথা শোনালেন। আমরা বাড়ি ফিরলাম। পরবর্তীতে এই শিক্ষক আমাকে কোনো দিন ক্লাসে আর কোন ঝামেলা করেননি বা করার সাহস পাননি। বলা যায়, সেটি ছিল আমার জীবনের এক বড় রকমের বিজয়।

‘সিরা’ স্যারের চাবুক
স্যার নিজেই তাঁর ছাত্র পেটানোর পদ্ধতিকে নামই দিয়েছিলেন ‘চাবুক’। তিনি গর্ব করে বলতেন, ‘আমার একটি চাবুক তোদের মেট্রিক পরীক্ষায় ৫ নম্বর বাড়াবে’। তার মারার কায়দা ছিল একটু ভিন্ন। ছাত্রকে একটু মাথা নত হয়ে কুর্নিশ হতে বলতেন। ছাত্রটি একটু বাঁকা হতেই তিনি তাঁর হলুদ আর কালো ডোরাকাটা বেতটা সপাং করে পিঠে চাবুকের মতো বসাতেন। ব্যাস! সেই মার এত শক্ত ছিল যে, সেই বেতের দাগ সপ্তাহ খানিক পিঠে জ্বল জ্বল করে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করত।
একদিনের ঘটনা।
সারাক্ষণ শুধু এই ভয়েই সময় কাটতো, এই বুঝি ‘সিরা’ স্যারের চাবুক পিঠে পড়ল! একদিন ক্লাসে আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু নাম অ (আসল নাম গোপন) স্যারের কুনজরে পড়ল। ‘অ’–কে স্যার ইচ্ছামতো বেত দিয়ে পেটালেন। বেত ভেঙে গেল। অফিস থেকে আরেকটি নতুন বেত আনা হলো। আরেক দফা পেটানো হলো। সেই বেতটিও ভেঙে গেল। আমার বন্ধুটি কান্নায় তখন গোঙাতে লাগল। আমি বসেছিলাম ঠিক তার পাশেই। কয়েকটি বেতের বাড়ি আমার গায়েও এসে পড়েছিল। আমরা ক্লাসের সব ছাত্র তখন ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। পরে বন্ধুটির বাবা স্কুলে এসে তার ছেলের টিসি নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করালেন। সেই স্কুল-বন্ধুটিকে আমরা হারালাম। পরে সে এসএসসিতে অনেক ভালো ফল করল। এখন সে বিমানবাহিনীর খুব সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত। আজকে কেন জানি, আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধু ‘অ’–কে খুব মনে পড়ছে। তাকে আমার অভিবাদন।

‘রুস্ত’ স্যার
আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। এই স্যারের একটাই সমস্যা। তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে। না পড়লে ‘খবর আছে’। বিষয়টা আমাদের জানা ছিল। তিনি পড়াতেন ইংরেজি। ইংরেজি ব্যাকরণ। স্কুলে পড়াতেন খুব কম, কারণ ক্লাসেই যদি সব পড়ানো তাহলে ছাত্ররা তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়তে যাবে কোন দুঃখে? আমি ছেলেবেলায় ইংরেজিতে খুব একটা খারাপ ছিলাম না। তা ছাড়া আমার বাবা কলেজে ইংরেজি পড়াতেন। তাই ইংরেজিতে প্রাইভেট পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।
একদিনের ঘটনা।
আমি তখনো ‘রুস্ত’ স্যারের প্রাইভেট কোম্পানিতে নাম লেখাইনি। প্রাইভেট না পড়ার কারণে তিনি মনে মনে আমার প্রতিও ক্ষুব্ধ! সে কথা বেশ বুঝতে পারছিলাম। একদিন বলা নেই, কওয়া নেই, তিনি ইংরেজি ব্যাকরণ নিয়ে একটু কঠিন প্রশ্ন করলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি সেই প্রশ্নের ‍উত্তর দিতে পারিনি। আর কি! স্যার আমাকে পেয়ে বসলেন। বললেন, এক্ষুনি যেন ক্লাস থেকে বের হয়ে যাই। আমি রাগে–দুঃখে–অপমানে ক্লাস থেকে বের হয়ে ক্লাসের পুরোটা সময় নদীর পারে বসে রইলাম। ক্লাস শেষ হলো। এবার ক্লাসে এসে দেখি, আমার বই খাতা কিছুই নেই। বই খাতাও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। আমার খুব কান্না পেল। কিন্তু ‘রুস্ত’ স্যার জানতেন না, তিনি যেই স্কুলের শিক্ষক সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার বড় চাচা। আমি কাঁদতে কাঁদতে চাচার অফিসে হাজির হলাম। চাচা আমাকে বরাবরই খুব স্নেহ করতেন। আমার কান্না দেখে তিনি আমাকে তার কক্ষে সস্নেহে বসালেন। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই আমি বললাম, ‘চাচা, আমার বই–খাতা সব এই রুস্ত স্যার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আর ক্লাস থেকে আমাকে বেরও করে দিয়েছেন।’ সব শুনে চাচা রুস্ত স্যারকে আমার সামনেই পিয়ন দিয়ে ডাকিয়ে আনলেন। তিনি এসে আমাকে দেখতে পেয়েই যেন চোখে সরষে ফুল দেখলেন। চাচা তাঁকে আমার সামনেই আমার বই খাতাপত্র নিয়ে আসতে বললেন। মনে আছে, চাচার কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে আদর করে রুস্ত স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাপু, আগে বলবা না, তুমি আমাদের স্যারের ভাতিজা!’ বলা বাহুল্য, সেই রুস্ত স্যার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন আমাকে আর কখনোই কোনো যন্ত্রণা দেননি।
নির্দ্বিধায় এই তালিকা আরও লম্বা হতে পারে। জানি, এই তালিকা শুধু আমার নয়, বরং এটি আপনারও। কিন্তু আমাদের সেই সময়ের তালিকা লম্বা করে কী লাভ? আমাদের ছেলেবেলায় এই মারমুখো শিক্ষকদের অত্যাচার আমরা বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা চোখ বুজেই মেনে নিয়েছিলাম। আমাদের তখন ধারণা ছিল, শিক্ষকেরা তো ছাত্রদের ভালোই চান, অতএব তাঁরা একটু আধটু মারবেন, শাসন করবেন—এটাইতো স্বাভাবিক! আমাদের সেই ছেলেবেলায় গণমাধ্যম এতো শক্তিশালী ছিল না, প্রযুক্তি ছিল না, ফেসবুক ছিল না, ছিল না কোনো সামাজিক মাধ্যম। শত শত অপরাধ সবার অজ্ঞাতে সমাজের অতলেই তলিয়ে যেত।
অরিত্রীর মতো হাজারো অরিত্রীরা খুব নীরবে হয়তো কাঁদত, হয়তো অপমানের জ্বালায় তাদের সুন্দর নির্মল মনে এক ভয়াবহ দানব এসে বাসা বাঁধত। কিন্তু সে খবর কে রাখতেন? এখন গণমাধ্যম অনেক শক্তিশালী, অনেক ব্যাপৃত। যেকোনো অপরাধ এখন সামাজিক মাধ্যমে চোখের পলকেই ভাইরাল হয়ে যায়। পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ও লক্ষ্য করার মতো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। এতে বোঝা যায়, সমাজ এখন অনেক দূর এগিয়েছে। মানুষের বিবেক এখন অনেক বেশি সচেতন, আত্মমর্যাদাবোধ অনেক বেশি জাগ্রত। অরিত্রীর আত্মহত্যা সে কথাটিই যেন আমাদের বারবার বলে যায়।