মুক্তিযুদ্ধের গল্পমালা

[নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে কত গল্প যে আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে তার কী কোন শেষ আছে! একাত্তর নিয়ে কথা বলা মানেই আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর আগে এক নিমেষে সেই যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাওয়া। কিছু গল্প আছে আনন্দের, গৌরবের। আবার কিছু গল্প বেদনার রঙে আঁকা। লক্ষ্য করেছি, যিনি গল্পটি বলছেন তিনি যেন একাত্তরের সেই রণাঙ্গন থেকেই গল্পটি বলছেন। তাঁর চোখেমুখে, পুরো শরীরের ভাষায় তখন একাত্তরের উত্তাপ ফুটে ওঠে। আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যেমন যুদ্ধ করেছেন, ঠিক পাশাপাশি একজন খুব সাধারণ মানুষ যিনি অস্ত্র চালাতে জানেন না, তিনিও বিভিন্নভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সহযোগিতা করে যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের সেই অবদানকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। সে কারণে এখানে মুক্তিযুদ্ধে কার কত বেশি অবদান, সে প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। বরং যুদ্ধ চলাকালীন সেই সব লড়াকুর গল্প তুলে আনাই হবে কাজের কাজ।
নিনি ওয়াহেদ বাংলাদেশের একজন খুব পরিচিত প্রবীণ সাংবাদিক। দীর্ঘদিন তিনি দৈনিক সংবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর আরেকটি পরিচয়ও আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিজেও অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁরও অবদান রয়েছে। তাঁর কাছে যখন জানতে চাইলাম, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের একটি গল্প বলেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এখনো লেখা হয়নি। আমার এই কথা শুনে তিনি একটু চুপ হয়ে গেলেন। বেশ বুঝতে পারছিলাম তিনি হয়তো মনের অতলে ডুব দিয়ে সেই উত্তাল একাত্তরের অলিগলিতে ঘোরাফেরা করছেন। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে চশমার কাঁচটা শাড়ির আঁচল দিয়ে পরিষ্কার করে বললেন, একাত্তরের গল্পের কি কোন শেষ আছে? হ্যাঁ, আমার কাছেও একটা একাত্তরের গল্প আছে। এই গল্পটা মনে পড়লেই আমাকে সেই উত্তাল একাত্তরে নিয়ে যায়। তিনি তাঁর দেখা দুটি গল্প বলতে শুরু করেন। পাঠক, একাত্তরের সেই গল্পটি তাঁর মুখ থেকেই শুনি।]

গল্প-৫
আহসান ভাই ও গেন্ডারিয়ার লোহার পুল
আমরা তখন ছিলাম ৪৯ দীননাথ সেন রোড, ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এই বাড়িটা হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। মুক্তিযোদ্ধারা এই বাড়িতে এসে আশ্রয় নিতেন, আবার সময়–সুযোগ মতো চলেও যেতেন। বাড়িটা ছিল অনেক বড়। পেছনে অনেক বড় বাগান। আমি আর আমার বড় বোন জিয়াউন নাহার রোজি দুজনেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমরা দুজনেই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমার আপা ছিলেন সেই ১৯৬৮ সালে মহিলা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সেই সময় আমাদের পরিচিত এক বন্ধু ছাত্র ইউনিয়ন করতেন যাঁর নাম ছিল আহসান। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি অন্যদের মতো যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি পারিবারিকভাবেও আমাদের সবারই পরিচিত। থাকতেন কৃষক নেতা জিতেন ঘোষের সঙ্গে।
আহসান ভাই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছিলেন একজন কট্টর কমিউনিস্ট। তখন এপ্রিল মাস। রাত দশটার মতো বাজে। দেখি খুব গোপনে আহসান ভাই আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। পোশাক–আশাকে তাকে একদম চেনাই জানায় না। মুখটাও তাঁর খুব থমথমে। তাঁর চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম, কোন একটা অপারেশনে তিনি এসেছেন। পরে জানতে পারি, তিনি এসেছিলেন ঢাকায় অনুষ্ঠেয় মেট্রিক পরীক্ষা বানচাল করতে। তাঁর হাতে তখন দুটো বড় বড় চটের ব্যাগ। আমাদের কারওরই বুঝতে অসুবিধা হল না, ব্যাগের ভেতর কী আছে। এসেই তিনি আম্মাকে একটি ব্যাগ রান্না ঘরের গুদামে লুকিয়ে রাখতে বললেন। একটি আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে অন্যটি সঙ্গে নিয়ে মগবাজার যাবেন। কিন্তু আম্মা বিপদের গন্ধ পেলেন। রান্নাঘরে আমাদের চাল ডালসহ সব খাবার মজুত থাকে। তাই আম্মা খাবারের বস্তার সঙ্গে এই অস্ত্রের ব্যাগটিকে লুকিয়ে রাখতে চাইলেন না। তিনি তখন আমাদের পরামর্শ দিলেন, ব্যাগটি যেন আমরা বাড়ির পেছনে বাগানে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে রাখি।
আম্মার পরামর্শ অনুযায়ী, আমি আর রোজি আপা মিলে বাড়ির পেছনে একটা গর্ত করে ব্যাগটি লুকিয়ে ফেলি। এবার আম্মা আহসান ভাই যে ব্যাগটা নিয়ে বাইরে যাবেন, সেই ব্যাগটার ওপরের দিকে পুঁই শাকসহ নানা রকম শাক সবজি দিয়ে ঢেকে দিলেন। কেউ যাতে বাইরে থেকে ব্যাগটা নিয়ে কোন সন্দেহ করতে না পারে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। আমরাও নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম ব্যাগটা একটা শাক-সবজির ব্যাগ বলেই মনে হয়। এবার আহসান ভাই আমাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। হাতে তাঁর সেই সবজির ব্যাগ, যাবেন মগবাজারে। এক বিশেষ অপারেশনে।
গেন্ডারিয়ায় তখন একটি লোহার পুল ছিল। মগবাজারে যেতে গেন্ডারিয়া লোহার পুলটি পার হতে হবে। আহসান ভাই লোহার পুল পার হতে যাবেন, কিন্তু দেখলেন সেতুর দুই মুখেই পাকিস্তানির সেনারা চেকপোস্ট বানিয়ে রেখেছে। প্রতিটা চেক পোস্টে দুজন করে পাক সেনা টহল দিচ্ছে। আহসান ভাই চেক পোস্ট আর পাক সেনাদের টহল দেখে একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন। কিন্তু সময় নষ্ট করা চলবে না। তিনি খুব ভালো মানুষের মতো লোহার পুল পার হতে লাগলেন। হঠাৎ এক পাক সেনা আহসান ভাইকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিল, ‘রুখো!’ আহসান ভাই সমূহ বিপদের গন্ধ পেলেন। তিনি জানেন ব্যাগটি চেক করলেই ভেতর থেকে অস্ত্র আর গোলাবারুদ বের হয়ে আসবে। তিনি সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন না। পাক সেনারা কিছু বোঝার আগেই তিনি সোজা দৌড় দিলেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। তিনি যখন দৌড় দিচ্ছিলেন, তখন এক মেজর জিপ নিয়ে সেদিকেই যাচ্ছিল। আহসান ভাইকে পালাতে দেখে পাকিস্তানি সেনা তার জিপটি থামিয়ে খুব সহজেই তাকে ধরে ফেললে। আহসান ভাই ধরা পড়লেন এবং তাঁকে সূত্রাপুর থানায় নেওয়া হল। সূত্রাপুর থানার ওসি আমাদের পরিচিত ছিলেন। তিনিই আমাদের আহসান ভাইয়ের ধরা পড়ার খবরটা জানিয়েছিলেন। পরে জানতে পারি আহসান ভাইকে মিরপুর টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণত এই ধরনের সেলে নিয়ে গেলে কেউ আর ফিরে আসেন না। তারপর যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস আমরা আর আহসান ভাইয়ের কোন খবর পাইনি। আমরা ধরেই নিই, আহসান ভাইকে আরও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মতোই হয়তো মেরে ফেলা হয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হল। তখন একে একে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নিজেদের ঘরে ফিরছেন। কোন কোন বাড়িতে আনন্দের বার্তা আবার কোন বাড়িতে শোকের ছায়া। সম্ভবত সেই দিনটি ১৮ অথবা ১৯ ডিসেম্বর। রোজি আপা বাড়িতে বসে আছেন। এমন সময় দূর থেকে তিনি দেখতে পেলেন, আমাদের বাড়ির সামনেই ফটকের কাছে এক ফকির খালি গায়ে এসে হাজির। আপা দেখছেন ফকিরটা বাড়ির ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে। আপা ফকিরকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। কিন্তু সেই ফকিরের কণ্ঠ থেকে ক্ষীণ স্বর নেমে এল। ‘আপা, আমি আহসান।
আহসান? আপনি আহসান? আমাদের বন্ধু আহসান! আপনি বেঁচে আছেন? এই বলে আপা বিস্ফোরিত চোখে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আহসান ভাইকে সত্যি চেনাই যাচ্ছিল না। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে তাঁর পিঠের চামড়া উঠে গিয়েছিল। সেখানে দগদগে ঘা। সারা শরীরে শুধু অত্যাচারের চিহ্ন। নখ উঠিয়ে ফেলেছিল। গায়ে শক্তি বলতে কিছু নেই। বড় আপা তাড়াতাড়ি আহসান ভাইকে ঘরে নিয়ে এলেন। তাঁর সেবা শুশ্রূষা করা হল। আহসান ভাই বিশ্রাম নিলেন। তারপর সব কথা তার মুখ থেকে আমরা জানতে পারলাম। পরে তাঁকে সুস্থ করে তুলতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পার্টি অফিস থেকে পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হয়েছিল। ভাগ্য ভালো, আমরা আহসান ভাইকে ফিরে পেয়েছিলাম। আহসান ভাই এখনো বেঁচে আছেন।

গল্প-৬
সেই ক্ষতবিক্ষত লাশটির কথা মনে পড়ে
১৪ই ডিসেম্বর। পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে বিজয় অর্জনের দুই দিন আগের কথা। সেই দিন খুব ভোরে রাস্তার সামনে মানুষের জটলা। গেন্ডাারিয়ায় আমাদের দীননাথ সেন রোডের বাড়ির কাছেই চৌমাথাটায় একটা ক্ষতবিক্ষত একটা লাশ পড়ে আছে। সবার চোখে মুখে তখন আতঙ্ক! আমরা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে সেই লাশ দেখতে গেলাম। আহা! এই লোকটা! আমাদের সবার খুব পরিচিত। বয়স আর কত হবে? ২৫ কি ৩০ বছর? কোন এক মফস্বল এলাকা থেকে এসে তিনি আমাদের গেন্ডাারিয়ায় ব্যবসাপাতি নিয়ে জমিয়ে বসেছিলেন। নাহ! নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। বিশেষ কারণেই তাকে আমরা সবাই চিনতাম। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অন্যতম কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা। আমরা জানতাম, অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাঁর বাড়িতে থেকে বিভিন্ন অপারেশনেও অংশ নিয়েছিল। সেই লোকটাকে পাকিস্তানি হানাদাররা মেরে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা এভাবেই বাঙালিদের হত্যা করে সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করত। তাদের ধারণা ছিল এভাবে লাশ রাস্তায় ফেলে রাখলে বাঙালি ভীত হয়ে ঘরে বসে থাকবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। যত বাঙালি তারা খুন করল ততই যেন বাঙালি ফুসে উঠল। ১৪ ডিসেম্বর তারা আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল।
মনে পড়ে যুদ্ধের সময় আমাদের নাজিম উদ্দীন রোডের পাশেই নয়াবাজার পাকিস্তানি হানাদারেরা পুড়িয়ে দেয়। দাউ দাউ করে গোটা বাজার আগুনে তখন জ্বলছে। আগুনে পুড়ছে তখন আমার সোনার দেশ, আমার দেশের মানুষ। নয়াবাজারে সেই বীভৎস আগুনে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। তাদের অনেকের নামই এখনো অজানা। মনে আছে, বংশাল রোডে দৈনিক সংবাদ অফিসে যেদিন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল, সেদিন সংবাদের এক সাংবাদিক শহীদ সাবেরও সেই আগুনে পুড়ে মারা যান। সাবের মানসিকভাবে একটু অসুস্থ ছিলেন। তারাই ছিল দেশের জন্য প্রথম শহীদ। ঢাকার রাস্তায় যত্রতত্র তখন দেখতে পেতাম লাশ। লাশ পড়ে আছে নালায়। লাশ পড়ে আছে রিকশার পা-দানিতে। লাশ পড়ে আছে রাস্তার পাশে নালার ময়লা পানিতে উপুড় হয়ে। কারও হাত বাঁধা। কারও চোখ বিস্ফোরিত হয়ে আছে আকাশের দিকে।
রশীদ তালুকদারের তোলা সে ছবিটার কথা কখনো ভোলার নয়। একটা রিকশার পা-দানিতে অসংখ্য মানুষের লাশ। কারও হাত বাদুড়ের মতো ঝুলছে। কারও পা বাঁকা হয়ে মাটির সঙ্গে লেগে আছে। তারা সবাই ছিলেন খুব সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তারাও শহীদ। তাদের নিশ্চয়ই অনেক স্বপ্ন ছিল। হয়তো তাদের প্রিয়জনেরা তাদের জন্য অনেক দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন। হয়তো তারা সবাই অপেক্ষায় থাকতেন একটি প্রত্যাশার ভোর দেখবেন বলে। তারা অপেক্ষার প্রহর গুনতেন এই বুঝি তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষেরা এক ভোরবেলায় এসে বলবেন, ‘আমি বেঁচে আছি। আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি আবার তোমাদের মাঝেই ফিরে এসেছি।’ কিন্তু তাঁরা অনেকেই আর ফিরে আসেননি। তাঁদের আর ফেরা হয় না। আমরা কি তাঁদের সেই আত্মদানের খবরটা জানতে পেরেছি? জানা সম্ভব হয়েছে?