সোনার মাকড়ি

তিস্তা নদীর পার ধরে গুটি কয়েক গ্রাম। গ্রামের নাম দুনাই। গ্রামে কয়েক ঘর মানুষের বসত। এই গ্রামের বাসিন্দা জবির মৃধার ছেলে হবিবর মৃধা দশ বছর আগে আদিতমারী গ্রামের ফজলু শেখের মেয়ে মজিরনকে বউ করে নিয়ে আসে।
এক দিন সকালে বাজারে মাইকিং শুনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বাড়ি আসে মজিরন।
-ও সখিনার বাপ বাজারত মাইকিং করেছে চ্যংরালা। তামন মানুষক উচা ডাঙাত যাবার কয়েছে। তুমি গরু-ছাগল ধরি যান। মুই আইসোছো এলা।
-তাড়াতাড়ি বাইর হ সখিনা। ভাইর হাতত ধরি দৌড়ি যা, বাঁধের উপরত যা। হবিবর গরু, আর ছাগলটাকে নিয়ে বাঁধের দিকে দৌড়াতে থাকে। তার পিছু পিছু আরও মানুষ। সবাই প্রাণ নিয়ে ছুটছে। তিস্তায় পাহাড়ি ঢল, আর স্লুইস গেট খুলে দেওয়া পানি দ্রুত বেগে নেমে আসছে।
তাদের পাঁচ বছরের ছেলে সবুজ চৌকির ওপর শুয়েছিল। মায়ের কথা শুনে দৌড় দিতে গিয়ে বলে
-ও মা তুই? তুই যাবি না?
আট বছরের সখিনা এখন প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস টুতে পড়ে। সখিনা বলে, মা তুইও চল কেনে। তুই কী করেসিত? তোক ছাড়ি মুই না যাইম।
-আমি চাইলের ব্যাগখান ধরি এলায় আইসোছো। তোরা দৌড়াও। তোর বাপের সাথত যা মাও। সবুজক হাতখান ধরি রাখেক।
-ও হামিদের মা, হামিদরে নিয়া বাঁধের উপরত যা। বাঁচতে চাইলে দৌড়াও। তামন মানুষ দ্যাখেক অত্তি যায়ছে।
চালের মটকার ভেতরে জমানো কয়টা টাকা আর সোনার মাকড়ি রেখেছিল মজিরন। এবার সেগুলো নিয়ে বাইরে এল সে। টাকা আর সেনার মাকড়ি জোড়া শাড়ির আঁচলে গিঁট দিয়ে রাখে। দশ বছর আগে মজিরনের বিয়ে হয়। বউ হয়ে আসে এই গ্রামে। তখন ছিল খড়ের ঘর। এখন সে জায়গায় দুটো টিনের ঘর বানিয়েছে। বাড়ির পাশে খেতি জমি, গরু-ছাগল। হবিবর আগে ঢাকায় দারোয়ানের কাজ করত। উত্তরার ‘ডোমিনোস’-এর এক ছয়তলা বিল্ডিংয়ে দারোয়ান ছিল সে। বেতনের টাকা দিয়েই বেশ চলে যায়। কিন্তু বিয়ে করা বউ থাকে গ্রামে, আর সে থাকে ঢাকায়। মাঝে-মধ্যে ছুটিতে বাড়ি আসত। প্রথমবার বউ পোয়াতি হলে মন টিকতো না। বেশ কয়েকবার ছুটি নিল। তখন ওর চাকরি চলে গেল। হবিবর গ্রামে ফিরে এল খুশি মনেই।
-কিষাণের বেটা মুই। খেতি করব এলা। চাকরি করা হামার পোষায় না।
গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে হালচাষ করা শুরু করল। বাপ বেঁচে ছিল তখনো। বাপও খুশি। আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়ে চাষবাস করে দিন গুজরান করছিল। বাবা মারা গেছে চার বছর আগে। মজিরন তখন দ্বিতীয়বার পোয়াতি। সেইবার সবুজের জন্ম হলো। এক ছেলে, এক মেয়ে ওদের। ওরা স্কুলে যায়। স্কুলে এখন বই ফ্রি। দুপুরবেলা টিফিনও দেয়। ছেলে-মেয়ে দুটো লেখাপড়ায় বেশ ভালো। মজিরন আর হবিবর স্বপ্ন দেখে ছেলে বড় ডাক্তার হবে। মেয়ে হবে শিক্ষক। ওদের দোচালা ঘরের জায়গায় দোতলা বাড়ি হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া বাঁধের এই পাড়ে বিশ-পঁচিশ ঘর মানুষের বাস। সবাই চাষি। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে। অর্ধেক ফসল ওরা পায়। এই অঞ্চলে বলে আধিয়ার। এখন বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। কলেজের ছেলেরা মাইকিং করছে—
‘ভাইসব সকল গ্রামবাসীকে বাঁধের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে পানি অসম্ভব দ্রুত আর অবিশ্বাস্য তীব্র স্রোত নিয়ে আসছে। বাচ্চা-বৃদ্ধ সবাই জান নিয়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেন।’
মজিরন সকালবেলা বাজারে গিয়েছিল। মাইকিং শুনে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি আসে। সবাই দৌড়াচ্ছে। মমিনের মা বিছানায় শয্যাশায়ী। মমিন কীভাবে মাকে বের করবে তা-ই ভাবে।
-ও মমিন তোর মাক বাইর করবার পারবি? পলোখান উল্টাপাকত ধরি ওর মধ্যি খড় বিছি দিয়া ক্যাথার উপর ওমাক শোতে দে। দুই পাকে দুইজন ধইল্যে বুড়িক নিবার পাইরবেন।
হাজেরার বাচ্চা হয়েছে তিন দিন হয়।
-তুই একটু পা চালা হাজেরা। পানি বলে আসি গেইলো। ছাওয়াটাক ধরিয়া তোর সোয়ামি দৌড় ধইচ্ছে। এলা তুই পা চালা বইন।
হাজেরাকে নিয়ে জোরে হাঁটে মজিরন আর কথা বলে। মজিরনকে সবাই ভালোবাসে। হাসিখুশি, পরোপকারী স্বভাবের। কেউ ডাকে বুজি। কেউ ডাকে ভাবি।
-এন্ডিয়ার নদীত বান ডাইকছে। বুজলু? এলা তামন স্লুইস গেইট খুলি দেইছে এন্ডিয়া। ঢলের পানি বলে আইসেছে হু হু করি। বেবাক ভাসে দিয়া হামার এত্তি বাঁধ ভাঙি গেইছে। পানি আইসেছে। আকাশের গতিকও ভালো নো হায়। শিম শিম করি পানি হয়্যেছে সারা দিনটায়।
দিগন্তরেখার দিকে চোখ যেতেই হা হয়ে গেলো দৃষ্টি। বিশাল উঁচু ঘোলা পানি ছুটে আসছে তীব্র বেগে।
-ও আল্লা বাঁচাও। ও আল্লা...
হাজেরাকে গাছ জড়িয়ে ধরতে বলে নিজেও গাছটা আঁকড়ে ধরে। বেজায় তোড় পানির। ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে আসছে। নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকতে থাকে। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য মুখ বের করতেও পারে না। চালের বস্তা ছেড়ে দেয়। চাল ভিজে ভারী হয়ে গেছে। পানির এত তোড় গাছটাই একসময় উপড়ে গেল। গাছসহ ওদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে পানি। নাক-মুখ-কান সব দিক দিয়ে পানি ঢুকছে। পানি খেতে খেতে স্রোতের ঠেলায় ভারী কোনো বস্তুর সঙ্গে মাথায় আঘাত লাগল। নেতিয়ে পড়ল শরীর।
পানি নেমে গেছে। পুরা গ্রাম লন্ডভন্ড। গরু, ছাগল, মানুষ, হাঁসমুরগী, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, সব এক ভয়ংকর অবস্থার সাক্ষী। কালভার্টের কাছে পাওয়া গেল মজিরন আর হাজেরার লাশ। পাশেই ছাগল আর তার বাচ্চা।
সবুজ আর সখিনা কাঁদছে...
-মা, মা রে, তুই ক্যান চাইলের জন্যি দেরি কললি? তুই ক্যান হামাক আগত পঠে দিলু....
মজিরনের শাড়িতে গিটঠু দেওয়া ছিল এক হাজার টাকা, আর সোনার মাকড়ি জোড়া।