সংস্কৃতি ও আমরা

‘মম তুমি কি জানো, আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের নিজস্ব কোনো কালচার (সংস্কৃতি) নেই’। এ কথা বলে যদি কোনো বাচ্চা মেয়ে জ্ঞানী ভাব নিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়ে, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
‘সত্যিই তো! মম তুমি হাসছ কেন’? গত ২০০ বছর ধরে শ্বেতাঙ্গরা অন্যদের সংস্কৃতি আপন করার চেষ্টা করছে। তারা অন্যদের সংস্কৃতি ধার করেই চলে। তারা রান্না করে না। এটাও তাদের সংস্কৃতিতে নেই। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে রেস্তোরাঁর খাবারই খায় তারা। জানো, তাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো তাদের ঠোঁট নাই, যা আছে তা একমাত্র একটা লাইন, মানে রেখা’। এ কথা বলে সে একটা ক্রূর হাসি হাসল। এ সংক্রান্ত জ্ঞান আজকাল মেয়ে আমাকে দিচ্ছে। সে এসবের ওপর কিছু একটা প্রকল্প তৈরি করবে বলে পড়াশোনা করছে। নতুন কিছু জানলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমাকে শেয়ার করছে।
যাক মেয়ের সংস্কৃতি সংক্রান্ত এহেন আলোচনার কারণে অবচেতন মনে ক্লিক হওয়া কিছু বিষয় মনে হলো। কয়েক দিন আগে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সংষ্কৃতি নিয়ে পরিবারগুলোর কিছু বিষয় সামনে এল, তখন দেশের কিছু স্মৃতির নস্টালজিক করছিল আমাকে। মেলাচ্ছিলাম মনে মনে অনেক হিসাব। ৬ ডিসেম্বর ঊর্মির প্রথম সার্জারির পর, বিকেলের দিকে সবাই বিদায় নিলেও আমি ছিলাম। দশম তলায় রিকভারি রুমগুলোর পাশে বেশ বড় বড় ওয়েটিং রুম আছে। ও যেহেতু নর্থ সাইডে, আমি নর্থ সাইডের রুমে বসলাম। বেশ কিছু সোফা, চেয়ার টেবিল রাখা। এখানে আসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, শুধু স্টেট আইডি দেখিয়ে পাস নিতে হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এহেন মানবিক সভ্যতা আমার ভালো লেগেছে, মুগ্ধ করেছে। শুধু ওয়ার্ডে দুজন রোগীর কারও সমস্যা হয় কিনা, এ কারণে বেশি রাতে লোক থাকলে, তারা হালকা-পাতলা অনুরোধ করে।
যাই হোক, সে কক্ষে আমি এসেছি সন্ধ্যার দিকে, এর আগে লবিতেই বসে ছিলাম। আমার সামনে স্প্যানিশ এক পরিবার বেশ বড় বড় হটপটে খাবার নিয়ে বসেছে, সঙ্গে ওয়ান টাইম প্লেট-গ্লাস। তারা বেশ আয়েশ করেই খাচ্ছে আর কথা বলছে রোগীর অবস্থা নিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে ধকল গেছে, খাওয়া–দাওয়া হয়নি। বামপাশে চীনা একটি পরিবার বিশাল আয়োজন নিয়ে বসেছে। তাদের এ আয়োজন তখন আমাকেও প্রাচ্যের সংস্কৃতির এ দিকটা যে আমাদের আন্তরিকতার অঙ্গ, সেটি মনে করিয়ে দিয়েছিল। একটি দেশের সংস্কৃতি সেই জাতির পরিচয় বহন করে। এশিয়ার মানুষের সংস্কৃতি প্রায় এক। তাদের কোনো একজন আত্মীয় খাবার নিয়ে এসেছেন। চিকেন–বিকেন, পিংপুং করে এসব বলছিলেন।
স্প্যানিশ, ডমিনিকান মানুষেরা এসব ব্যাপারে যে আন্তরিক, সে পরিচয় আমি বিমানবন্দরে পেয়েছি। এদের এসব দেখে আমার খালাম্মার কথা মনে হলো। উনি মারা গেছেন প্রায় দুই বছর আগে। হাসপাতালে কেউ ভর্তি হলে তাঁর বাসা থেকে বড় বড় টিফিন ক্যারিয়ার ভরে খাবার নিয়ে আসত। আমার চোখে সেই টিফিন বাটিগুলো বারবার ঘুরেছে। সেটাও অনেকটা উৎসবের মতো একটা ব্যাপার ছিল, যা এই মুহূর্তে ওরা করছে। সেই সঙ্গে তাদের আয়োজন আমাকে বুভুক্ষু করেছে। আমাকে এই মুহূর্তে ওরা সাধলে হালাল–হারাম বেছে একটা কিছু খেয়ে নিতাম। কিন্তু এরা সাধছে না। তারা এখানে আমেরিকান সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছে।
আমরা যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছি, জাতিগত ধর্মগত বৈষম্যগুলো যেন আরও প্রকট হচ্ছে। অথচ কিছু মানুষের ব্যবহার মুগ্ধ করে। হিন্দু-মুসলিম সব ছাপিয়ে মানবতা বড় হয়ে ওঠে। যদিও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা আমাদের সংস্কৃতি ভুলতে বসেছি আর পশ্চিমারা আমাদেরই আন্তরিকতা নিজেদের করে নিচ্ছে। এহেন কিছু কথাও বলছিল মেয়ে। যাই হোক, ছোট পরিসরে কিছু কথা না বললেই নয়। যে শহরে সময় বিক্রি হয় পয়সা দিয়ে, সে শহরে যখন কেউ এগিয়ে আসে তাকে বড় করে দেখতেই হয়। অনেকেই এসেছেন হাসপাতাল এবং তাদের মধ্যে মালবিকা আমার বন্ধুর বউ। হঠাৎ একদিন নিউজার্সি থেকে ফোন দিল যে, সে আসবে উর্মিকে দেখতে। আসার আগে সে আবার ফোন দিল,‘আপা একটু ভাত নিয়ে আসতেছি আপনাদের জন্য। আশ্চর্য হয়েছি যদিও, কামরানের কথা ভেবে আমি আর না করিনি। হাসপাতালে বেশির ভাগ সময় থাকার কারণে আমাদের রান্নাবান্না করা হচ্ছে না। অবাক হয়েছি শুধু যে, ওদের সঙ্গে আমার তেমন কোনো কথাও হয়নি। সেই ভাত আমরা ভাইবোন সেই ওয়েটিং রুমে বসে তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি। চীনা, স্প্যানিশ পরিবারকে দেখে নস্টালজিক হতে হতে নিজের হারানো সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবিত হলো যেন। তার সেই একটু ভাতে মাছের তরকারি আর ভর্তার পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, আমি পরদিন রাত সাড়ে এগারোটায় গিয়ে তা খেয়েছি। আমার কাছে এ শুধু খাবার ছিল না, ছিল এক খণ্ড প্রেম যা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। এসব কি এখনো বেঁচে আছে দেশে ঠিক আগের মতো? কত কিছু মুছে যাচ্ছে। আগে হঠাৎ করে মেহমান এলে আমরা খুশি হতাম, এখন হই অপমানিত। ভাবি, না বলে এসে কী সমস্যায় ফেলল! এ সংস্কৃতিগুলোও উঠে যাচ্ছে।
সংস্কৃতি বা কৃষ্টি শব্দের আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। সংস্কৃতিকে ইংরেজিতে বলা হয় Culture, এ শব্দটি ল্যাটিন Colere থেকে এসেছে। ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়।
বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাকাইভার সংস্কৃতি সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন—Culture is what we are or have। আমরা অথবা আমাদের যা কিছু আছে তাই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মূল কথা নিজেকে সুন্দর করা, সভ্য করা। প্রেম ও সৌন্দর্য সংস্কৃতির মূল আশ্রয়। এ থেকে বিচ্যুত হলে সংস্কৃতি ধ্বংস হয়। বিদেশ বিভুঁইয়ে এহেন সংস্কৃতির বেঁচে থাকা আমাকে মুগ্ধ করেছে।