অবন্তি, আমি আর বাংলাদেশ

রাত ২টা। প্রতিদিনের মতো আজও মেসের ছাদে হাঁটাহাঁটি করছি। আমার মনে হয় হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকলে হয়তো প্রতিদিনকার আমার ছাদে এই হাঁটাহাঁটি নিয়ে কোন গল্প লিখে ফেলতেন। মেসের ছাদে পুলিশ, র‍্যাব চলে আসত। ছাদ থেকেই আমাকে ধরে নিয়ে রিমান্ডে যেত। কঠিন লেভেলের ডোজ দেওয়া হতো। আমাকে নিয়ে কি কি গল্প লিখতেন, তা ভাবার চেষ্টা করছি। আচ্ছা, রাতের বেলা একটু হাঁটলেই আর আবোলতাবোল চিন্তা করলেই মানুষ নিজেকে হিমু ভাবার চেষ্টা করে কেন? হিমুর কি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল? গল্পের বই পড়ার অভ্যাস আমার নেই। এত রাতে এই জিনিস জানতে ইচ্ছে করছে কেন?
আচ্ছা, অবন্তিকে এত রাতে খুদে বার্তা দিয়ে জিজ্ঞাসা করা কি ঠিক হবে, ‘অবন্তি, তুমি কি জানো হিমুর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল কি না?’ অবন্তির ‘হিমু’ চরিত্র ভীষণ প্রিয়। সে আমাকে আদর করে হিমু ডাকে। আমার আসল নাম হিমাদ্রী। হিমাদ্রী সরকার।
না অবন্তিকে এত রাতে খুদে বার্তা দেওয়া ঠিক হবে না। সকাল আটটার ক্লাস ধরার জন্য মেয়েটা হয়তো এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। মেয়েরা এত সময়সূচি মেনে চলে কীভাবে? সব মেয়েরাই কি এ রকম নাকি শুধু আমার অবন্তি। ওহ আচ্ছা, ‘আমার’ অবন্তি বলার কারণ হলো অবন্তির সঙ্গে রিলেশনের প্রায় আড়াই বছর হতে চলল। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে প্রপোজ করে পাক্কা এক বছর মেয়েটার পেছনে নাছোড়বান্দার মতো ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এক বছর পর তাঁর মন জয় করলাম। ক্লাসের পর দেখা করা আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস।
সকাল আটটার ক্লাসের পর বিরতিতে আমার ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা পড়ার প্রতিদিনের অভ্যাস। প্রতিদিন এই আশা নিয়ে পড়ি যাতে কোনো ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনার খবর পড়তে না হয়। তবে প্রতিদিনই পত্রিকার কোন কোনায় এসবের খবর পড়ে মনটা ভারী হয়ে যায়।
বিকেল চারটায় অবন্তির সঙ্গে দেখা। ১৭ সেপ্টেম্বর অবন্তির জন্মদিন। আমি জানি না বললেও অবন্তি সেদিন নীল শাড়ি পরে আসবে। আমি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি হলে নীল শাড়িতে অবন্তির ছবি আঁকতাম। ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টায় ধানমন্ডি লেকে আমাদের দেখা হবে।
অবন্তি মেয়েটা এত সারপ্রাইজ পছন্দ করে না। খুব সাদামাটা। তাও আমি অবন্তিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য সব পরিকল্পনা করে রাখলাম।
১৭ সেপ্টেম্বর। ‘হিমু, আমি রেডি হয়ে বের হচ্ছি। তুমি আধা ঘণ্টার মধ্যে লেকে চলে যাও। প্রতি জন্মদিনের মতো বইল না যে, সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে লেট হয়েছে। আমি আসছি।’
আজ আমার অবন্তির জন্মদিন। সারা জীবন যার সঙ্গে কাটাব তার জন্মদিন। সময়ের অনেক আগেই আমি সেখানে গিয়ে বসে আছি। অবন্তি আসছে। আচ্ছা, আমার সারপ্রাইজ দেখে সাদামাটা মেয়েটার রিয়েকশন কী হবে?
দুই, তিন, চার ঘণ্টা অবন্তি আসার নাম নেই। আচ্ছা, অবন্তি কি আমাকে উল্টা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ইচ্ছা করেই আসে নাই! পরের দিন এসে কী বলবে, ‘হিমু, দেখলে কেমনে তোমার পরিশ্রম, সারপ্রাইজ সব পণ্ড করে দিলাম।’ মেয়েটার এই অভ্যাস আমার ভালো লাগে না। ফোনটাও অফ করে রেখে দিছে। ওই দিন রাত পর্যন্ত অবন্তিকে ফোনে পাইনি। পরদিন পত্রিকা পড়ছি। ‘চলন্ত বাসে ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচতে লাফ দিয়ে বাসের নিচে পিষ্ট হয়ে তরুণীর মৃত্যু’—আমার পৃথিবী শূন্য হতে লাগল। এ যে আমার অবন্তির ছবি। নীল শাড়ি পরা আমার অবন্তি। নীল শাড়ি পরা আমার অবন্তি আজকে পত্রিকার শিরোনামে।
এ রকম শত শত অবন্তি প্রতিদিন পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। দিনের পর দিন বাংলাদেশে এই নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১৮ জন যাদের মধ্যে নারী ৯২ জন আর শিশু ২২৫ জন। ২০১৭ সালে ৭৮৩ জন, যাদের মধ্যে ২২৫ জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী আর শিশু ৫৫৩ জন। ২০১৬ সালে ৭৫৭ যাদের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ২৩২ আর শিশু ৫১১। ২০১৫ সালে ৭৮৯ জন। যাদের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ২৯৩ জন আর শিশু ৪৮৯ জন। আর সামাজিক ও ব্যক্তিগত ভয়ে কতগুলা ধর্ষণের রেকর্ড করা হয়নি তার হিসাব নাই।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলছে ধর্ষণের সংখ্যা। বাংলাদেশের রেকর্ড করা ধর্ষণের সংখ্যা ১১ হাজার ৬৮২ আর ভারতের ২২ হাজার ১৭২। ধর্ষণের পর হত্যার সংখ্যা আমাদের ৩ হাজার ৯৮৮ আর ভারতের ৪০ হাজার ৭৫২।
‘পশুত্ব ও পুরুষত্ব এক নয়, সত্যিকার পুরুষ ধর্ষণ করে না।’ শিশুরা হাসবে, খেলবে ধর্ষণের শিকার হবে কেন?
তাই প্রতিদিন এরকম শত শত অবন্তির ধর্ষণের শিকার হয়ে খবরের শিরোনাম হওয়া থেকে রক্ষার এখনই সময়। ‘আমার মা,আমার বোন ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।’