জমে থাকা বরফের দিন

গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য পৃথিবী জুড়ে ক্রমশ আবহাওয়ার বদল চলছে। আপাতদৃষ্টিতে গত পাঁচ বছরের বিশ্লেষণেই দেখা যায় পরিবেশের অনেক তারতম্য হচ্ছে। আমেরিকায় জানুয়ারি মাসের শুরুতে অন্তত দুটো তুষার ঝড় হয়ে যেত। সে তুলনায় এ বছর অনেক ভালো। হঠাৎ করেই পুরোনো এক তুষার ঝড়ের ঘটনা মনে হলো।
তখন দুই মাসের নতুন আমেরিকাবাসী। ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি দুপুর থেকে ঝড় শুরু হয়ে চলবে পরদিন পর্যন্ত। পথ খুব একটা চিনি না। একটা চাকরি খুব দরকার। প্রথম ডাক এল মিডটাউন ম্যানহাটনের একটি মোবাইল স্টোর থেকে। এদিকে আবহাওয়ার সতর্ক বার্তা চলছে, তুষার ঝড় হবে। ৩ জানুয়ারির তুষার ঝড়ে প্রথম দিন হিল সাইড অ্যাভিনিউ থেকে পা ফসকে অনেক দূর গড়িয়ে পড়েছিল। শুধু আমার না, স্নো দেখলে প্রথম প্রথম সবারই ভাব, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো। বলা যায় উত্তেজনায় হুঁশ থাকে না। তবে বেহুঁশ হওয়ার মতো তেমন কিছু করিনি। তবু বের হয়েছি ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য।
সকালে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে এসেছি। বাচ্চাদের মানে ঈশায়া আর তিয়াস। ওই বাঙালি পরিবার মিলে আমরা এক সঙ্গে থাকতাম। স্কুল বাসার পাশেই। এরপর গেছি ম্যানহাটন। অধিকাংশ সময় দুটোর মধ্যে চলে আসি। না পারলেও সমস্যা নেই, তিয়াসের আম্মু নিয়ে আসে। সেদিন ইন্টারভিউ শেষ করে ট্রেন উঠতেই দেড়টা বেজে গেছে। ঝড় সম্ভবত ১২টা থেকে শুরু হয়েছে। ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে তাই তুষারের তীব্র আঘাতও আনন্দের মনে হচ্ছে। তবে ভেতরে-ভেতরে মেয়ের জন্য অস্থির লাগছে। অন্য স্টেটে স্কুল বন্ধ দিলেও নিউইয়র্কে খুব একটা হয় না। এর একটা মানবিক কারণ আছে। সেটা হচ্ছে স্কুলের বাচ্চাদের জন্য সকাল ও দুপুরে যে খাবার সরবরাহ করা হয় সেটা। এখানকার পাবলিক স্কুলে অনেক বাচ্চা আছে যাদের পরিবারে খাবার থাকে না, তাদের জন্য স্কুলের এ খাবার অনেক কিছু। ঝড়-তুফান মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত কাপড়ের ব্যবস্থা এ দেশে সবারই কম বেশি হয়ে যায়। পথে অনেক মা স্ট্রলারে বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছেন। শরীরে গরম কাপড় যেমন আছে তেমন ওপরে পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়েছেন চেয়ারে। বৃষ্টি পড়ুক, স্নো পড়ুক তাঁরা উদ্বিগ্ন নন মোটেও। এখানকার শিশুরা জন্মের পর থেকেই অভ্যস্ত। তাই খুব বড় কিছু না হলে সহজে স্কুল বন্ধ হয় না।
ঘড়ির কাঁটা পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। নতুনদের জন্য আপ-টাউন ডাউন-টাউন ট্রেন যেন এক বিশাল পাজল গেমের মতো। একটু অন্যমনস্ক হলেই ভুল ট্রেনের খেসারত অনেক বড় হয়ে যায়। তখনো ভুল হয়নি সিক্স ট্রেন বদলে ই ট্রেনে উঠেছি এবং এটা বদলে এফ-এ উঠতে হবে। পাতালরেল থেকে ঝড়ের গতি বোঝা না গেলেও মানুষের চেহারা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে। এ দিকে টেনশন ক্রমশ বেড়ে চলেছে। একটা স্টপেজে আসতেই মিসড কল পেলাম তিয়াসের মা, ফরিদ ও শারমিনের। সিগন্যাল নেই, তাই কল করতে পারলাম না। নার্ভাস হয়ে পড়লাম।
সন্তানের অমঙ্গল চিন্তায় চোখে জল আসে আসে। ই ট্রেন বদলাতে ভুলে গেলাম। জ্যামাইকা জে এফ কে আর্চার অ্যাভিনিউয়ে নেমে রীতিমতো চোখে অন্ধকার দেখছি। এমনিতেই এটা একটু অন্ধকার এবং টানেলের মধ্যে তৈরি সাবওয়ে স্টেশন। কোথায় মিলবে এফ ট্রেন? একমাত্র এফ ট্রেনই আমার বাসার কাছে যায়। মাথা কাজ করছে না। ভাবলাম পেছনে যাই, একটু পরে একটা ই ট্রেন উঠলাম। পেছনে গেল না। এগিয়ে গেল। নামিয়ে দিল একেবারে জ্যামাইকা সেন্টারে। ওপরে দেখলাম লেখা ‘পারসন্স বুলেভার্ড’। একটু স্থির হয়ে ওপরে উঠে এলাম। একজন ভদ্রলোককে পিএস ৮৬ পারসন্স বুলেভার্ড কোন দিকে জিজ্ঞেস করতেই, একেবারে এস্কেলেটরে উঠে দেখিয়ে দিলেন, সোজা হাঁটতে।
ভয়ে ভয়ে এগোলাম। মনে হলো যেন অসীম সমুদ্রের ফেনার মধ্যে হাঁটছি। মেয়ের চিন্তায় চোখ ভিজে যাচ্ছে। স্নো পড়ছে। পা ফেললেই হাঁটু পর্যন্ত গেড়ে যাচ্ছে তুষারে। ফোনে সার্ভিস পেয়ে ফরিদকে কল করলাম। সে বলল, ‘খালা আমি ঈশায়া আর ওই মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি কোথায়?’ এর মধ্যে চলে এসেছি ৮৯ অ্যাভিনিউয়ের কাছাকাছি। চার্চের পাশ থেকে স্কুলের উঁচু অংশ দেখতে পাচ্ছি। যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। তিয়াসের মাকে কল দিলাম, ফরিদ তাঁর মেয়েকে আনলে সে কোথায় ? রীতিমতো দৌড়ে পৌঁছে গেলাম স্কুল আর বাসার চৌরাস্তায়। সে ফোন ধরেনি। ফরিদ তো তাহলে বাসায় তালা দেওয়া পাবে। যাক আমি পথেই পেয়ে গেলাম ওদের।
ফরিদ কীভাবে জানল যে আমি বাসায় নেই? পরে শুনলাম স্কুল থেকে ফোন দিয়েছে বলেই সে গিয়েছে। কিন্তু সে অফিসে না বলতে পারছে ক্লাস না তার শিক্ষকের নাম। তাই সে স্ত্রী শারমিনকে ফোন করেছে। শারমিন জানে ফেসবুকে সপ্তাহখানেক আগে আমি তার শ্রেণি শিক্ষকের ছবিসহ একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখান থেকে শ্রেণি শিক্ষক মিস মিলারের নাম নিয়েছে এবং তাঁর নম্বর থেকে ফোন করে বলেছে ওদের দিতে। আমার পরেই সে ছিল অভিভাবক। তিয়াস ঈশায়ার কাজিন এটা নিজে বলে তবে আসতে পেরেছে। এ দিকে তিয়াসের মা ফোন দিয়েছে, সেও অস্থির মেয়ের চিন্তায়। কারণ আমাকেও পাচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী দুজন পথে আটকা পড়েছে। ওজোন পার্কে মামার বাসায় গিয়েছিল, মামা গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দেবেন। অর্ধেক পথ আসার পর গাড়ি আর চলে না। তাঁদের আশ্বস্ত করলাম, আমি আছি।
নিউইয়র্ক টাইমসে এ খবরগুলো বেশ বড় করেই ছাপানো হয়েছিল। সব পথচারী এবং মা-বাবার জন্য সেটা ছিল একটা ভয়াবহ দিন।
আমেরিকানরা বলে, ‘It’s horrible. Snow is cute for only a little bit”. কথাটা মিথ্যা নয়। এর মধ্যে স্কুলের এতটুকু পথ আসতেই তিয়াস ঈশায়া দুজনেই পা পিছলে পড়েছে। স্নো গালে লেগে ফোসকার মতো হয়ে গেছে। দুহাতে ফ্রস্ট বাইট! দুজনকে হট শাওয়ার দিয়ে পরে অতিরিক্ত রুম হিটার অন করে দিলাম। মধু, গরম তেল সব চলল। ঠান্ডার মাত্রা ছিল -১৫°ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকেলে দিকে তুষারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। ঘণ্টায় এক ইঞ্চি করে জমেছিল।
যাই হোক, পরদিন মেয়র স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিলেন। সারা রাত চলল তুষার বর্ষণ। সকালে উঠে দেখি চারদিক যেন সাদা চাদরে মোড়া। জমে থাকা স্নো নিষিদ্ধ প্রেমের মতোই যেন কাছে টানে। পর দিন স্নো ম্যান তৈরি করতে আমরা ভুলি নি।