বুদ্ধিদীপ্ত সমঝোতা

বিশ্বরোডের দুর্বিষহ যানজট পেরিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেল। আর কিছু দেরি হলে হয়তো ফ্লাইটের আশাই ছেড়ে দিতে হতো। হন্তদন্ত হয়ে এয়ারপোর্টে ঢুকেই শায়ের জানতে পারল ফ্লাইট ডিলেইড। কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ডিলে হওয়া এই দেড় ঘণ্টা সময় রিলাক্স করতে পারবে সে। সারা দিন দৌড়াদৌড়ি, সঙ্গে ঢাকা শহরের যানজট আর গরম তো ছিলই। সামান্য পরিমাণ বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না তার। ট্রলি হ্যান্ডব্যাগটা টেনে টেনে বাইরের গেটের দিকে চলে এল শায়ের। এই সুযোগে একটা সিগারেট টেনে নেওয়া যায়, মাথা কিছুটা হালকা হবে।
সিগারেট শেষ করে ভেতরের গেটের দিকে ঘুরতে গিয়েই টের পেল কেউ একজন যেন পেছন দিক থেকে তার ডান কাঁধে ঝাপটা দিয়ে ধরেছে। স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে লিলি ফুফু বলে উঠলেন, ‘তোর ভেতরে কি আমার জন্য একটুও দয়ামায়া অবশিষ্ট নেই শায়ের। নাকি ছিলই না কোনো দিন। আমাকে তুই চিনতে পারছিস তো, নাকি ভুলে গেছিস একেবারে, আমাকে তোর এখন অপরিচিত লাগছে না তো?’
হঠাৎ করে লিলি ফুফুকে দেখে শায়ের অনেকটাই হতবাক। অনেক দিনের জমে থাকা সব আবেগ যেন হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ফুফুকে দেখামাত্র। শায়ের কোনো কথা বলতে পারেনি, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তীব্র আবেগে ফুফুকে বুকে জড়িয়ে নিল। লিলি ফুফুর সঙ্গে শায়েরের শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে। প্রায় আট বছর পর, এখানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে কে জানত। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে শায়ের ফুফুর কপালে চুমু খেল। লিলি ফুফুও নিজের হারিয়ে যাওয়া সন্তান ফিরে পাওয়ার মতো করেই চোখ ভরে দেখছেন শায়েরকে আর বুকে হাত রেখে শায়েরের হৃৎস্পন্দন অনুভবের চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পরে ফুফুকে নিয়ে শায়ের গেটের ভেতরে চলে আসল। শায়ের এবং লিলি ফুফু দুজনেই রাতের ফ্লাইটে চিটাগাং যাচ্ছেন। এত দিন কেন যোগাযোগ রাখেনি, কেন শায়েরের এত রাগ, কেন এত দিন কোনো খোঁজ নেয়নি ইত্যাদি, শত ফরিয়াদের পরেও শায়ের কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না। শায়ের মনে মনে ভাবছে সত্যিকার অর্থে লিলি ফুফুর প্রতি তার কোনো অভিযোগ, অনুযোগ কিছুই ছিল না। কিছুটা অভিমান ছিল এটা সত্যি, কিন্তু অভিমানের কারণে সবার কাছ থেকে নিজে দূরে সরিয়ে রাখেনি শায়ের। হতাশা আর মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সে একা একা থাকত, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করত না, ভালো লাগত না তার। কিন্তু আজ হঠাৎ এভাবে লিলি ফুফুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে শায়েরের ভেতরে অন্যরকমের ভালো লাগা কাজ করছে। অতীতের সব ভালো লাগা স্মৃতিগুলোই একে একে মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে বিষণ্নতায় ডুবে থেকে ছয়/সাতটা বছর না কাটালেই মনে হয় ভালো হতো। বিষণ্নতার বয়স বছর খানেকের বেশি হতে দেওয়া উচিৎ নয়। বিষণ্নতায় কাটানো এতগুলা বছরের প্রতিটা মুহূর্ত শায়েরের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
লিলি ফুফু এখনো বোর্ডিং পাস নেননি, তাই ফুফুর সঙ্গে শায়েরও আবার লাইনে দড়িয়ে আছে। শায়ের ফুফুকে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে গত আট/নয় বছরে লিলি ফুফুর বয়সটা একটু বেড়েছে, আর সবকিছু আগের মতোই আছে। সেই সাদা ফিনফিনে টপস, হালকা খয়েরি রঙের লিপস্টিক, ভারসাচি এরোজ পারফিউম, স্টাইলিশ হাতব্যাগ, সবকিছুই সেই আগের মতোই আছে। শুধু লিলি ফুফুর সেই রে-বেন সানগ্লাসটা আর আজকে তাদের সঙ্গে ফারাবীর চঞ্চল দুষ্টুমিটা নেই। শেষবার শায়ের যখন ফারাবীকে লিলি ফুফুর বাসার দরজায় রেখে এসেছিল, সেদিনও ফারাবীর চঞ্চলতা, দুষ্টুমি কিছুই ছিল না। নিষ্ঠুর-নিস্তব্ধ এক নীরবতায় ভরে গিয়েছিল করিডরের পুরোটা পরিবেশ। ফারাবীর কপালে শেষ চুম্বনের শব্দটাও যেন শুষে নিয়েছিল সেই নীরবতা। শায়ের সেদিন দরজার ভেতরে কেন যেতে চায়নি এটা যেমন লিলি ফুফু জানেন না, তেমনি শায়েরও জানে লিলি ফুফু সেদিন কতটা কষ্ট বুকে চেপে রেখে দরজা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
লিলি ফুফু শায়েরের রক্তের কেউ না হলেও অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ফারাবীর মাধ্যমেই লিলি ফুফুর সঙ্গে শায়েরের পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, আত্মীয়তা, ভালো লাগা, আহ্লাদ, শ্রদ্ধাবোধ আর অগাধ বিশ্বাসের জন্ম। মূলত লিলি ফুফু হচ্ছেন ফারাবীর বাবার মামাতো বোন। লিলি ফুফু আর ফারাবীদের বাসা পাশাপাশি হওয়ায় নিয়মিত আসা-যাওয়া আর ফুফুর উদার মানসিকতা খুব সহজেই আকৃষ্ট করেছিল শায়েরকে। বন্ধুসুলভ আর দায়িত্বশীল আচরণের কারণে ফারাবী-শায়েরের প্রেমের প্রতিটা পদক্ষেপের কথা তারা নির্দ্বিধায় ফুফুকে জানাতো, পরামর্শ নিত, সময়ে-অসময়ে অনেক সাহায্যও নিত। এত বছর পরে হঠাৎ ফুফুকে পেয়ে শায়েরের স্মৃতি পটের প্রতিটা দরজা যেন দমকা হাওয়া লেগে এক এক করে খুলে যাচ্ছে। লিলি ফুফুর জীবন কাহিনিটাও খুবই অসাধারণ। শায়েরদের কাছে ফুফু তাঁর নাটকীয় জীবনের প্রায় সব গল্পই করেছিলেন। লিলি ফুফু আজীবনের একজন স্মার্ট, সুন্দরী ও শিক্ষিত একজন মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স পাস করার পর শখের বশে চাকরি নিয়েছিলেন ফ্লাইট ক্রু হিসেবে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের চাকরির সুবাদে অনেক দেশেই ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল তাঁর। যদিও লিলি ফুফুর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাই পাকিস্তানি এয়ারলাইনসে তাঁর বোনের চাকরি করাটাকে সমর্থন করতেন না। তাই বলে তো আর নিজের সুশিক্ষিতা বোনকে জোর করাটাও সমীচীন হয় না। তবে ফুফুও তাঁর ভাইকে কথা দিয়েছিলেন, কিছুদিন চাকরি করে, ছোটবেলার বিমানবালা হওয়ার শখটা মিটে গেলেই এই চাকরি তিনি ছেড়ে দেবেন।
সাধের বসনা পূর্ণ করতে গিয়ে খুঁজে পেলেন আবেগের বন্দনার। ইন-ফ্লাইট সার্ভিসে ৩/৪ বার দেখা হওয়ার পর খুব সাবলীলভাবে পরিচয় হয় ড্যানের সঙ্গে। ড্যানের পুরো নাম ড্যানিয়েল শ্নেখ, অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। যেমন সুদর্শন তেমনি মেধাবী ও অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ড্যানের সঙ্গে পরিচয়টা পরবর্তী সময়ে বাগদান ও পরিণয় পর্যন্ত গড়ায়। ফ্লাইট ক্রুর চাকরি ছেড়ে দিয়ে লিলি ফুফু পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। এডিলেড শহরে ড্যানের নিজস্ব বাড়িতে সংসার সাজানোর কয়েক মাসের মধ্যেই লিলি ফুফু স্থানীয় একটি প্রতিবন্ধী-উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি নেন। এদিকে ড্যান তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নিজস্ব একটা ব্যবসা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছিলেন। বেশ সাজানো-গোছানো নিরবচ্ছিন্ন সুখের পরিবেশ ছিল তাদের সংসারে। কিন্তু বিধিবাম; হঠাৎ করেই একদিন লিলি ফুফুর ভাবি কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই পরলোকে চলে গেলেন। লিলি ফুফুর যুদ্ধাহত ভাই আর শয্যাশায়ী মাকে দেখাশোনা করার মতো আপন কেউ নেই তাদের পরিবারে।
একদিকে যেমন অসুস্থ মা আর পঙ্গু ভাইকে নিয়ে নিজের কাছে রাখা সম্ভব না, ঠিক অন্যদিকে ড্যানের পক্ষেও বাংলাদেশে এসে অনুন্নত একটা প্রাচীন শহরে এসে সংসার করাটাও বাস্তবসম্মত না। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লিলি ফুফু তখন আলোচনায় বসলেন ড্যানের সঙ্গে। সব আলোচনা/পর্যালোচনা করে দুজনে মিলে একটা সিদ্ধান্তে আসলেন। নিজেদের ভালোবাসা পুরোটুকুই অটুট রেখে ভাগ্যের পরিণতিকে গ্রহণ করে নিলেন। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমেই ডিভোর্সের পথ বেছে নিলেন। কারণ ড্যানের বয়স তখনো খুব বেশি ছিল না। জীবন ধারণের নিমিত্তেই ড্যানের একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হবে। রাষ্ট্রীয় আইনের কারণে ড্যানকে তিনি একাকিত্বের ভুক্তভোগী করতে চাননি। ড্যানের পক্ষ থেকে শুধু একটা কঠিন শর্ত ছিল এই সমঝোতায়। আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য ডিভোর্স দলিলে তাঁরা দুজনেই সই করবেন ঠিকই, কিন্তু লিলি ফুফুর সঙ্গে আজীবন যোগাযোগ রাখার মানবিক দাবি অবশ্যই মানতে হবে। কারণ ভাগ্যের পরিহাসে সংসার জীবনের ইতি ঘটলেও তাঁদের ভালোবাসা বিনষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁদের ভালোবাসা থাকবে অটুট, অমর, অবিনশ্বর।
লিলি ফুফু দেশে চলে আসার পর ড্যান নিয়মিত ফোন করে, চিঠি লিখে ফুফুর খোঁজ-খবর নিতেন। এমনকি মাঝেমধ্যে লিলি ফুফু ও তাঁর মা-ভাইয়ের জন্য বিভিন্ন উপহার সামগ্রীও পাঠাতেন। ফোনে কথা বলার পর লিলি ফুফু প্রায়ই ড্যানকে বিয়ে করে নতুন বউ আনার জন্য তাগাদা দিতেন। তাঁদের ডিভোর্সের প্রায় চার বছর পরে ড্যান আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। নতুন সঙ্গিনীর কাছে লিলি ফুফু সম্পর্কে এবং তাঁদের অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া পরিণতির কথা সবকিছু খোলামেলাভাবে বিস্তারিত বলেন। একবার নতুন বউকে নিয়ে ঢাকায় এসে লিলি ফুফুর সঙ্গে সাক্ষাৎও করিয়ে দেন। এ ধরনের সমঝোতা মানব সমাজে সত্যিই খুব বিরল। এই সমঝোতা হচ্ছে শিক্ষিত, সভ্য, দায়িত্বশীল ও ভদ্র মানুষজনের বুদ্ধিদীপ্ত সমঝোতা।আমাদের বর্তমান সমাজে এ রকম তো দূরের কথা, কোনো সমঝোতা করার মানসিকতার লেশমাত্রও নেই। সবদিকে শুধু অবজ্ঞা, অধৈর্য আর গোঁয়ার্তুমি। সন্দেহের বশেই হোক আর চারিত্রিক দুর্বলতার কারণেই হোক, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলেই সব শেষ। সমাজ, সংসার, পরিবার সবখানে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে। সমঝোতার কোনো কথাই কেউ মাথায় নিতে নারাজ। কেউ স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলছেন, কেউ বা তার স্বামীকে বিশ খাইয়ে মেরে ফেলছেন, কেউ বা আবার আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। নিজেদের খেয়াল-খুশি মতোই সব করে নিচ্ছেন। আর এসব করে দুটি পরিবারের বাকি সবাইকে দুর্বিষহ বিড়ম্বনার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন। সামাজিক সম্পর্কের পরিমণ্ডলে অবিশ্বাসের বীজ বপন করে যাচ্ছেন। শুধু নিজের খেয়ালে, গোঁয়ার্তুমি করে, অপরিশোধিত দেন মোহরের দায় এড়াতে কিংবা পাওনা আদায় না হওয়ার শঙ্কায়, ‘লোকে কী বলবে’ তা নিয়ে চিন্তা করে সীমাহীন বিড়ম্বনা সৃষ্টি করতে কেউ কোথাও আটকায় না।
প্রথমে লিলি ফুফুর ভাই ও পরবর্তী সময়ে মা, একে একে দুজনে পরলোকে চলে গেছেন। কিন্তু পৃথিবীর বুকে লিলি ফুফু সমঝোতার এক অবিনশ্বর দৃষ্টান্ত হয়ে আজও টিকে আছেন। নিজের অপরিমেয় ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে, পরিবার-পরিজনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ত্যাগী মানবী লিলি ফুফু যেন তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত সমঝোতার আলো দিয়ে দূর করে দিয়েছিলেন তাঁর পরিবারের অমাবস্যা। তিনি মহিমান্বিত রূপসী তারা হয়ে অমলিন থাকবেন মানব সমাজের দায়িত্বশীল প্রেরণায়।