প্রেমে-অপ্রেমে বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে

হসপিটালের করিডরে প্রথম দেখা। শব্দ করে কান্না নয়, কিন্তু চকিত এক ঝলক দেখেই বুঝলেন ভদ্রমহিলা আগের মুহূর্তেও কাঁদছিলেন। কান্নার রেশটা এখনো লেগে আছে। খেয়াল করতেই বুঝলেন সামনের সারিবদ্ধ কেবিনগুলোর কোনো একটি থেকে ঝটিতি বেরিয়ে এসেছেন। আসলে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে এনেছেন কষ্টকাতর পরিবেশ থেকে। কষ্ট নিজের কারণে নয়। যাঁর কষ্ট চোখে দেখে সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে এলেন, তাঁর কারণে।
কয়েক সেকেন্ডে এত কিছু ভেবে বের করলেন। কেন করলেন, জানা নেই। এর একটি কারণ হতে পারে ভদ্রমহিলা একজন সংকটাপন্ন রোগীকে দেখে কেঁদে বেরিয়ে এলেন। তার মানে যিনি মুমূর্ষু রোগাক্রান্ত, হসপিটালের বেডে শয্যা নিয়েছেন কিছুকাল, তিনি এর খুব নিকটজন কেউ। এতক্ষণে উনি মুখোমুখি, সামনাসামনি প্রায়। এবার বুঝলেন উনি তরুণী ও সুন্দরী। তাঁকে নিয়ে প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, পরিবেশ সচেতন মানুষটি এত ভাবছেন কেন? আর মুখোমুখি হতেই তাঁর চাহনিতে কেঁপে উঠেছিলেন কেন? রূপসী ও তরুণী বলে? রূপসী তরুণী মাত্রই দেখা হতেই খুব পরিচিতজন মনে হয়। গণিতের খাতায় হিসাব কষা শুরু হয় কতটা আপন পর্যন্ত তাঁকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়া যায়! একঝলক। চোখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছিলেন গমন পথে। তিনি স্বাভাবিকতায় ফিরে আসেন। শিক্ষিত মানুষের পরিশীলিত মনের সংবিৎ ফেরান। নিজের গন্তব্যে এগিয়ে যান। আর কয়েকটা দোর পেরোলেই লাল রেড ক্রসের চিহ্ন বুকে ধরা সাদা পর্দা সরালেই দেখা যাবে একজন একদা বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দরী এখন ভয়ানক অসুস্থ, ফ্যাকাশে হলদেটে হয়ে আসা, রুগ্‌ণ, শীর্ণ একজন অকাল বয়স্কে পরিণত হওয়া মানবী সাদা ধবধবে বেডে নিঃসাড়, নিস্পন্দ শুয়ে আছেন। আজ ১৭ দিন। ১৭টি দিন, ১৭টি রাত। ৪০৮ ঘণ্টা। প্রায় সাড়াহীন। প্রাণ আছে, এটুকুই যেন বড় কথা। স্ট্রোক করে কোমায় চলে গিয়েছিলেন, আজ ক’দিন ফিরে এসেছেন। কিন্তু যে অবস্থায় আছেন, তাকে কি থাকা বলে? তবু চেষ্টার ত্রুটি নেই। ডাক্তাররা প্রাণমন দিয়ে করছেন। ভালোবাসা আর মমতা মাখা সর্বান্তকরণে যত্ন দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যতক্ষণ জীবন, ততক্ষণ আশা!
যিনি করিডর ধরে হেঁটে এখুনি পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং বেডের পাশে এসে চেয়ারটাতে বসলেন, তিনি ওই ক্লিষ্ট মানুষটির বেডের প্রান্তে শুয়ে থাকা হাতটা নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে খুব আদুরে কণ্ঠে ডাক দেন, “মিতু”। অনেক দূর থেকে কোনো ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে আসে যেন! স্পষ্ট কিছু নয়, কথা বলার চেষ্টা মাত্র। মানুষটি কণ্ঠে মায়া ঢালে, “মিতু দেখ, আমি এসেছি।” এবার পাশের শায়িত জনের একটু নড়াচড়া লক্ষ করা যায়। ডান দিকে মাথা কাত করে তাকে দেখে। চোখের পাপড়িগুলো বোধ করি নাচে। একটু যেন খুশির আভাস দেখা যায়। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝুলে থাকে, কিন্তু তাতে যেন বড় বেদনা মাখা। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। কিরণ হায়দার (ভদ্রলোকের ওটাই নাম) হাতটা ছাডিয়ে নিয়ে মিতুর কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মমতা ও মায়ার সঙ্গেই দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিতু ঘুমিয়ে পড়ে। এখন বেশ কয়েক ঘণ্টা সে একটানা ঘুমোবে। কিছুই করার নেই, তবুও কিরণ হায়দার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় বাইরের আঁধার নামানো আকাশ দেখেন। ফিরে বেডের পাশে নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা টেবিলটার পাশে দাঁড়ান একটুক্ষণ। মিতুর ব্যবহারের টুকিটাকি সামগ্রী, হসপিটাল থেকে দেওয়া মিতুর জন্য কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে রাখেন। মিতুর মাথার পাশে দাঁড়ান, একটু ঝুঁকে মিতুর কপালে ভালোবাসার স্বাক্ষর রেখে, চোখের কোণে জমা জল মুছতে মুছতে দ্রুত বের হয়ে ডিউটিরত ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। কিছুই নয়, ডাক্তার শীতল চোখে তাকান, ইশারায় বসতে বলেন। কোনো কথা হয় না দুজনের। আবার অনেক কথা হয়ে যায়, তাঁরা দুজনই শুনতে পান কেবল। কয়েক মিনিট। কিরণ সাহেব বের হয়ে হাসপাতালের সদর দরজা থেকে রিকশা ধরে বাসায় যান। এই চলছে আজ ১৭ দিন।
পরদিন কী মনে করে অফিস থেকে একটু আগে আগেই বের হন। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম থাকে, গাড়িতে দীর্ঘ সময় অযথাই নষ্ট হয় এবং তাঁর মেজাজ বিগড়ে যায় বলে তিনি হসপাতালে রিকশায় চলাচল করেন । মিতুর রুমে যান। মিতুকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ চেয়ারটায় বসে নার্সের সঙ্গে কথা বলে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা না করে নিচে নেমে গিয়ে রিসেপশন ডেস্কের সামনে পাতা অ্যাটেন্ডেন্ট ও ভিজিটরদের বসার জন্য দুই সারির চেয়ারে বাম দিকের সারির কোনার ফাঁকা চেয়ারটায় এমনভাবে বসলেন যেন যে কেউ ভেতরে আসতে চাইলে তাঁর চোখ না এড়ায়। অর্থাৎ তিনি কারও অপেক্ষায়। বিশেষ কাউকে দেখবেন বলেই এই তাড়া করে হাসপাতালে চটজলদি আসা। অপেক্ষার প্রহরগুলো বড় লম্বা। একসময় অপেক্ষার শেষ হয়। তিনি আসেন। গতকাল ফিরে যাওয়ার সময়ের তাড়াহুড়ো নয়, ধীরস্থির ভঙ্গিতে মুখ তুলে এগিয়ে আসছেন। সামনে এসে একটু যেন দাঁড়ালেন। মুখ তুলে চাইলেন। কিছু যেন বলতে গিয়েও বললেন না। চলে গেলেন রিসেপশন ডেস্কে। কিরণ হায়দারের মুখে অযথাই বেদনার ছাপ পড়ল। কিন্তু তিনি অভিমান করে চলে গেলেন না। স্থির বসে রইলেন। খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। মিনিট পঁচিশের ভেতরে তিনি ফিরে এলেন।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লেন। পাখির নিড়ের মতো চোখ মেলে তাকালেন। মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বললেন, “ভালো আছেন?” চোখ তুলে তাকালেন সরাসরি তাঁর চোখের দিকে। দু’জোড়া চোখ এক জোড়ায় স্থির হলো। কিরণ হায়দার ওদিকের চোখ দুটিতে জলের আভাস, কি কোল বেয়ে নামা গণ্ডদেশ দ্বয়ে কোনো শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুরেখা দেখতে পেলেন না। বরং আনন্দোচ্ছল চোখ দুটি ভিন্ন কথা বলতে চাইছে। সরাসরি চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “চলে যাচ্ছেন?” আবারও কাজল তোলা কালো চোখ নাচিয়ে চোখের হাসিতে বললেন, “হ্যাঁ, ও ঘুমোচ্ছে। তাই আজ আর না থেকে চলে যাচ্ছি। আপনি আজ ভেতরে গেলেন না ?” উনি উত্তর করলেন, “আমিও বসিনি তেমন। গিয়ে দেখি ও ঘুমোচ্ছে। নার্সের সঙ্গে কথা বললাম। নার্স ডাকতে মানা করলেন, তাই পাশে একটু বসে উঠে চলে এলাম।” “ও-ও” বলে একটু নীরব থেকে আবার কৌতূহল, “তা বাসায় না গিয়ে এখানে এই হাসপাতালে রোগী, ডাক্তার, নার্স, দালাল, ফিনাইলের তীব্র গন্ধ এসব নিয়ে কেউ থাকে?” একটু দম নিয়ে আবার কৌতূহল, “ আচ্ছা, উনি আপনার কে হন?” কিরণ সাহেব হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন।” হুঁ, কিছু বলছিলেন? “জানতে চাচ্ছিলাম, পেশেন্ট আপনার কে হন?” কিরণ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, খুব নরম স্বরে বলেন, “স্ত্রী”। একটু ক্ষণের জন্য সময় যেন স্থির হয়ে যায়। দুজনের মাঝে নীরবতার নদী বয়ে যায় ধীরে। ভদ্রমহিলা মুখ তুললেন, ভারী, ধরা কণ্ঠে বললেন, “কী হয়েছিল ওঁর?”
ভদ্রলোকের এতক্ষণে হুঁশ হলো যেন! বললেন, “সরি, আপনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, আমি দিব্যি বসে আছি, বিষাদ এমনভাবে মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, ভব্যতা, সৌজন্য বোধটুকুও কেড়ে নিয়েছে।” অপরপক্ষ কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, “না, না দোষটা আমারই। কথাগুলো এখানে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। পরিবেশটা আমিই ভারী করে ফেলেছি। সরি। আপনার আপত্তি বা অসুবিধা না থাকলে কাছাকাছি একটা ভালো কফি শপ আছে, আপনার তো বোধকরি বিকেলের চা-কফিটাও সারা হয়নি, যাবেন?” ওঁর সত্যিই হালকা কিছু স্ন্যাকস্ ও কফির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ডায়াবেটিস টাইপ-২ ধরা পড়ার পর থেকেই অসুবিধা হয়। তিনি সম্মতি জানালেন।
সেই শুরু। শেষ নয়। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে দুজন দুজনের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব জড়তা ছাড়িয়েছে। সভ্যতার শেখানো মেকি, মিথ্যা, গোপন করে রাখার কপট স্বভাব আড়ালে গেছে। দুজন দুজনকে নাম ধরেই ডাকে। কিরণ হায়দার জানেন, তনিমা হাদী তন্বীর স্বামী জাহিদ হাদীর ক্যানসার ধরা পড়েছে প্রায় দু’বছর। তারপর থেকেই চলছে দৌড়ঝাঁপ। জাহিদ সাহেব অনেক কষ্টে বছরখানেক নানাভাবে ম্যানেজ করে চাকরিটাকে ধরে রেখেছিলেন। তারপরে আর পারেননি। তনিমা সরকারি কলেজে পড়ান।
চাকরি করে, সংসার দেখে দৌড়ঝাঁপ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। জাহিদের শেষ দিন ঘনিয়ে আসছে। সঞ্চয় গেছে আগেই। দুজনেরই অফিস থেকে যেসব আর্থিক সুবিধা সহযোগিতা পাওয়ার, সেসব নেওয়া শেষ। শহরতলির দিকে একখণ্ড জমি নেওয়া ছিল বাড়ি বানানোর জন্য। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে তাও গেছে। এখন চলছে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে শোধ দেওয়ার আশ্বাসে ধার করে। এতসব চাপে তনিমা হাদী বড়সড় মানসিক বিপর্যয়ের মুখে প্রতিদিন। তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। মাঝে মাঝে শাওয়ার ছেড়ে হাউ মাউ কাঁদেন। কিরণ হায়দারের বাসায় তাঁর মা ও তাঁর সাত বছর বয়সী ছেলে আছে। মিতু অসুস্থ হয়ে পড়ায় মা-ই ঘর দোর সামলাচ্ছেন। আজ নিয়ে উনত্রিশ দিন। কিরণ সাহেব ভেতরে-ভেতরে হাঁপিয়ে উঠেছেন। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড়সড় কর্তা ব্যক্তি। পদ যেমন বড়, দায়িত্বও তেমনি বেশি। মাস খানিক ধরে যে ধকল যাচ্ছে, অফিস সামলে মিতুর দেখাশোনা করা টাফ হয়ে পড়েছে। মিতুরা উত্তরবঙ্গের। ওর মা-বাবারা সেখানেই থাকেন। প্রথম দিকে তিন দিনের মাথায় এসে দুদিন ছিলেন। তারপর মিতুর বাবা অফিসের অসুবিধা, মা সংসারের ঝামেলার কথা পেড়ে চলে গেছেন। আর আসেননি। দিন দুয়েক পর পর ফোন করে খবর নেন। কিরণ সাহেবের ছোট বোনটা এসে দু’দিন ছিল। তার নিজের সংসার, দুটো বাচ্চা, বরের চাকরি, নিজের চাকরি, সেও পেরেশান। মিতুকে তিনি অনেক ভালোবাসেন। মিতুকে ছাড়া তিনি তাঁর পৃথিবী, তাঁর জীবন ভাবতে পারেন না। কিন্তু গত এক মাসের টানাপোড়েন তাঁকে কাবু করে ফেলেছে অনেকখানি। সে ক্ষেত্রে তাঁর নিজের জন্য তন্বী আর তন্বীর জন্য তিনি একটা মস্ত রিলিফ।
আজ একমাস সাত দিন। প্রতিদিন তাঁরা রুটিন দর্শন, রুটিন কিছু কথা সেরে কেবিন থেকে বেরিয়ে এক সঙ্গে হন। এখন আর হাসপাতাল এলাকার কফি শপ নয়। একেক দিন এক এক নামী রেস্তোরাঁয় যান। বাসায় ফেরার আগে ডিনারটা বাইরেই সেরে নেন। মাঝে মাঝে একসঙ্গে থেকেই জরুরি কেনাকাটা সেরে নেন। পারস্পরিক সম্বোধনটাও তন্বী আর কিরণে এবং তুমিতে পৌঁছেছে। মাঝখানে একদিন তন্বী কিরণ সাহেবকে নিয়ে তাঁর স্বামীর কেবিনে গিয়েছিলেন। জাহিদ সাহেব তখন জেগেই ছিলেন। তন্বী পাশে গিয়ে তাঁর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে এক চিলতে হাসি দিয়ে প্রতিদিনের মতোই মিথ্যা আশার বাণী শোনালেন। তারপর বেশ উৎফুল্ল স্বরে মিথ্যা করে বলেছিলেন, “দেখো, উনি কিরণ হায়দার। আমাদের ব্যাংকেই আছেন, এজিএম, আমার বস, উনি তোমাকে দেখতে এসেছেন।” কিরণ সাহেব এগিয়ে আসেন বেডের কাছে। সালামের ভঙ্গিতে হাত ওঠালেন কপালে। জাহিদ সাহেব সালামের জবাব বা হাত নাড়ানো কিছুই না করে সোজা কিরণ সাহেবের চোখের দিকে তাকালেন। সে চোখে দপ্ করে জ্বলে ওঠা এমন ঘৃণার আগুন দেখেছিলেন যে, ভয় পেয়ে পেছনে সরে গিয়েছিলেন। “আমি আসছি” বলে বাইরে বেরিয়ে এসে অপেক্ষা করেছিলেন। কিরণ সাহেব চেয়েছিলেন তন্বীকে নিয়ে একদিন সুমির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন, কিন্তু এই ঘটনার পর তাঁর আর সাহস হয়নি। জাহিদ সাহেবের দৃষ্টির আগুন তন্বী ও কিরণ সাহেবের মেলামেশা, প্রণয়াসক্তি দমাতে পারেনি। বরং বাড়িয়েছে। কিরণ সাহেব জানেন তন্বীর পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিষয়গুলো। পরের দিন কিরণ কী পরবেন, কী কালারের স্যুটের সঙ্গ কোন কালারের শার্ট সঙ্গে কোন টাইটা ম্যাচ করবে তার সবই আগের সন্ধ্যায় নির্বাচন করে দেন তন্বী। ম্যাচিং টাই কিংবা শার্ট আছে কিনা ধন্দে পরলেই তৎক্ষণাৎ শপিং সেন্টার। এভাবেই কাটছে এঁদের দিন। এঁদের অর্ধাঙ্গ আর অর্ধাঙ্গিনী অন্য দুজন খুব কষ্টে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন হাসপাতালের বেডে। বড্ড অসহায়, ভয়ংকর নিঃসঙ্গ দিন-রাত্রি যাপনে।
তখনো দুপুরটা ঝুপ করে সূর্যটাকে বিকেলের দিকে নামিয়ে দিলেই গা শির শির করে। দিনমণি পাটে নামলেই ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে বসে। রাত গড়িয়ে সকাল পর্যন্ত। সূর্যটা এক লাফে একটু ওপরে উঠেই আলো ও তাপ একসঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ে। এমনই এক সকাল, ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৮ । হাসপাতাল থেকে জরুরি ফোন কল পেয়েই ছুটলেন কিরণ হায়দার। নয়টা বেজে বারো মিনিটে তিনি যখন পৌঁছালেন, ততক্ষণে সবই শেষ। ছোট বোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে কল করে জানিয়ে হাসপাতালের দায়দেনা পরিশোধ করে ডেথ সার্টিফিকেটসহ মরদেহ নিয়ে বেরোতে বেরোতে বেলা এগারোটা। সেদিনই দিন থাকতে থাকতে সবকিছু শেষ। রওশন আরা মিতু অতীত হয়ে গেলেন। রয়ে গেলেন কিছু মানুষের মনে কেবল স্মৃতি হয়ে। ওই দিন কিরণ সাহেবের আর হাসপাতালে যাওয়া হয়নি। পরদিন সকাল বেলাতেই তন্বী এসেছিলেন অনেক খাবারসহ কিরণ সাহেবের বাসায়। পরিশ্রান্ত ক্লান্ত কিরণ সাহেব তখনো ঘুমে। কিরণের মাকে সালাম করে খাবারগুলো তাঁকে দিয়ে চলে এসেছিলেন। কিরণ সাহেব সাঁঝবেলায় গিয়েছিলেন হাসপাতালে। তন্বী অপেক্ষায় ছিল। ভীষণ উদ্বিগ্ন। জাহিদের শারীরিক অবস্থা আনস্টেবল হয়ে পড়েছে। অবস্থা সংকটাপন্ন। ডাক্তার মন শক্ত করতে বলেছেন, যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে ঘটনাটি। সে রাতে তাঁরা দুজনেই হাসপাতালে থাকলেন। ভোর ৪:৫৫ মিনিটে চলে গেলেন জাহিদ, দীর্ঘ দুই বছর ধরে মৃত্যুর সঙ্গে অসম লড়াই শেষে। এভাবেই মিতু ও জাহিদের চির বিদায়ে যবনিকাপাত ঘটল মিতুর প্রাণের মানুষ তাঁর স্বামী হায়দার কিরণ এবং জাহিদের জগত সংসারে সবচেয়ে আপনার জন, একান্তজন, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী তনিমা হাদী তন্বীর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের। আবার নতুন করে আরেক জীবনের উদ্বোধন হলো কিরণ ও তন্বীর। স্বামী হাসপাতালে মাসের পর মাস থাকলেও বাসায় তন্বীর একা থাকতে কি ঘুমোতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মরে যাওয়ার পর থেকে তাঁর মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেতে শুরু করেছেন তিনি। একা থাকতেই পারছেন না। যদিও বাসায় বুয়াসহ জাহিদের এক চাচাতো বোন এখনো একই বাসায় তাঁর সঙ্গে থাকছেন। না, তিনি একা থাকতে পারলেন না। ভয় তাঁর গলা টিপে ধরতে আসে। সুতরাং বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বাসা ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে একেবারে চলে এলেন তাঁর কিরণের বাসায়। তাঁর ঘরের ঘরনি হয়ে।