রুমি ও সুফিবাদ

আমেরিকায় রুমি এখনো সর্বোচ্চ বিক্রীত। জালালুদ্দিন রুমির ৫০টি কবিতা আমি বাংলায় ভাষান্তর করেছিলাম বছর তিনেক আগে। বইটি প্রকাশ করে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। কিছুদিনের মধ্যেই দেখি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন বই বিক্রেতা রকমারির সর্বোচ্চ বিক্রীত তালিকায় বইটি উঠে এসেছে। এখনো রোজই কেউ না কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ করেন, আমি যেন আরও কিছু কবিতা অনুবাদ করে এর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করি। ৮০০ বছর আগের কবি কেন আজও এত জনপ্রিয়? আমাদের বড় কবিরা বলে থাকেন, কবিতায় ধর্ম লেগে গেলেই জাত যায়, কবিতা আর কবিতা থাকে না, নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে কি রুমির কবিতায় ধর্ম নেই? নাকি ধর্মের স্পর্শে কবিতা নষ্ট হয়ে যায় যারা বলেন তাঁরাই ভুল বলেন? রুমির কবিতার কেন্দ্রে যা আছে, তা হচ্ছে সুফিবাদ।
জালালুদ্দিন রুমির সাহিত্যকর্ম, যা মূলত কবিতা, নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই জেনে নিতে হবে সুফিজম বা সুফিবাদ কি? রুমিকে বলা হয় সুফি মাস্টার। কেন তিনি সুফি মাস্টার? আর সুফি জিনিসটাই কি? নবী মোহাম্মদ (স.)–এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) সুফিজমের চর্চা শুরু করেন বলে কেউ কেউ দাবি করলেও অনেকেই আবার ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকরকেই (রা.) সুফিজমের প্রথম গুরু হিসেবে শনাক্ত করেছেন। যিনিই শুরু করুন না কেন, সুফিজমের উৎপত্তি যে ইসলাম থেকে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রথম দিকে শরিয়া চর্চাই সুফিজম হিসেবে বিবেচিত হতো। কারণ শরিয়া চর্চার মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্য বা নৈকট্য লাভ করা সম্ভব বলে মনে করা হতো। আল্লাহর নৈকট্য লাভই সুফি চর্চার মূল লক্ষ্য। এখনো অনেকে এই চিন্তার সমর্থক। তবে বাহ্যিক ইবাদত ছাড়াও আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব বলে যারা মনে করেন, তাদের কাছে সুফিজম এসেছে ভিন্ন রূপ নিয়ে। আর এই রূপটি ক্রমশ ধর্মের সীমানাও ছাড়িয়ে গেছে। ইশকের সাধনাই সুফিজম। ইশক মানে প্রেম। খোদার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যাওয়া, বিলীন হয়ে যাওয়ার নামই ইশকের সাধনা।
শরিয়াভিত্তিক সুফিজমের চর্চাকারীরা কোরআন সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করেন বেহেশত লাভের আশায়। আর বেহেশতে গেলেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হবে। আধ্যাত্মিক সুফি সাধকেরা মনে করেন, এই পৃথিবীতে থেকেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব, তাঁরা ক্কালবে খোদার জিকির-ধ্বনি তোলেন, মগ্ন হয়ে খোদার সান্নিধ্য লাভের অভিপ্রায়ে এক স্থানে দাঁড়িয়ে ঘুরতে থাকেন, চোখ বন্ধ করে খোদার প্রেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিমগ্ন থাকেন, যোগী সাধকেরা যোগ সাধনার মাধ্যমে ভগবান বা খোদায় কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন, সংগীতের তাল-লয়-সুরের মধ্য দিয়েও কেউ কেউ খোদাকে খোঁজেন।
সফল আধ্যাত্মিক সুফি সাধকেরা হৃদয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করেন। জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, নবী মোহাম্মদ (স.)–এর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে আল্লাহকে খোঁজো। সুতরাং তার কাছে প্রার্থনা করো, ‘প্রভু আমাদের প্রকৃত রূপ দেখাও/যাতে আমরা বিভ্রান্ত না হই এবং ভুল না করি।’/এই বিবেচনায় স্থির হও, যা কিছু ভালো আর পরিষ্কার তা মুহাম্মদের চেয়ে/ ভালো আর কে বলতে পারে, কারণ তিনি তা-ই করেন, যা তিনি বলেন/নিজের চিন্তা আর বিবেচনা দ্বারা তাড়িত হয়ো না/বরং আল্লাহর কাছে নতজানু হও এবং তার বিবেচনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও। (ফিহি মা ফিহি বক্তৃতামালা-১)
সুফিজমকে কেউ কেউ গান–বাজনার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। শুধু আধ্যাত্মিক ভাবধারায় গান-বাজনা করলেই হবে না, এটিকে খোদা ভজনের সাধনায় নিয়ে যেতে হবে, তবেই সুফিবাদের চর্চা বলে বিবেচিত হবে। যেমন রুমি বলেছেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে আমার একটি মুহূর্ত আছে, যেখানে কোনো বার্তাবাহক নবী/ বা খোদার নিকটবর্তী পবিত্র ফেরেশতাদেরও প্রবেশাধিকার নেই।/জেনে নাও, সেটাই হলো প্রার্থনার আত্মা/এবং সেই মুহূর্তটি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের এবং অচেতন হয়ে পড়ার।’
আল্লামা রুমি মোহাম্মদ (সা.)–এর প্রদর্শিত পথে হাঁটতে বলেছেন, কিন্তু ধর্মান্ধ হতে নিষেধ করেছেন। তিনি আত্মাকে, চিন্তাকে সর্বদা মুক্ত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ‘আবরণ মুক্ত করো/মানুষের মন একটি ঘরের মতো/সব দরজা এবং জানালার কপাট নির্দ্বিধ খুলে দাও/চিন্তাকে রেখো না বেঁধে সোনার শেকলে/ মুক্তচিন্তা হচ্ছে সেই প্রচেষ্টা যা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ খোদার প্রতি/তাঁর অগণন উপহারের জন্য/মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান আল্লাহর মহানুভবতার প্রতি নির্মম অবজ্ঞা।’ তিনি জাগতিক লোভ-মোহ থেকে মুক্ত হতেও পরামর্শ দিয়েছেন। এর সবই হলো সুফি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আত্মা এক সুবৃহৎ পরমাত্মার ভগ্নাংশ, এই বোধের সঙ্গে আমি একমত। সুতরাং সব আত্মাই সংযুক্ত। মানবাত্মার সেবা করার মধ্য দিয়ে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব, আমি এটা মানি। সেই দিক থেকে মানবতাবাদীরাও সুফি। কোনো না–কোনো একটি উপায়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সাধনায় নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিজম। এটাই সুফিজমের সর্বশেষ বিবর্তন।
ত্রয়োদশ শতকের ফারসি কবি জালালুদ্দিন রুমি ছিলেন সুফি সাধক এবং কালক্রমে হয়ে ওঠেন সুফি গুরু। তিনি ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। রুমি কোথায় জন্মগ্রহণ করেন, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তাঁর পুরো নাম জালাল আদ-দীন মুহাম্মদ রুমি বলখি। খোরাশানের বলখ শহরে জন্মেছেন বলেই তাঁর নামের সঙ্গে বলখি যোগ হয়েছে। জায়গাটি বর্তমান আফগানিস্তানে। তবে মতান্তরে বৃহত্তর বলখ অঞ্চলের বখশ নদীর তীরে অবস্থিত ওয়াখশ গ্রামে তাঁর জন্ম, যেটি বর্তমান তাজিকিস্তানে অবস্থিত।
তৎকালীন আফগানিস্তানে জন্ম হলেও কিশোর রুমি তাঁর পরিবারের সঙ্গে বাগদাদ, মক্কা, দামেস্ক হয়ে পৌঁছে যান তুরস্কের কোনিয়াতে এবং সেখানেই থিতু হন। তাঁর বেশির ভাগ সাহিত্যকর্ম কোনিয়াতেই রচিত। এখানেই তিনি ১২৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৬৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর রচনাসমূহ মাতৃভাষা ফারসিতে রচিত হলেও তিনি প্রচুর আরবি, তুর্কি শব্দ এবং কিছু গ্রিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। রুমির শ্রেষ্ঠ কাজ হলো ‘মসনবী’, যাতে প্রায় ২৭ হাজার পঙ্‌ক্তি রয়েছে। তাঁর অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজি’। এর বাইরেও তিনি আনুমানিক ৩৫ হাজার ফারসি শ্লোক এবং দুই হাজার রুবাইয়াত লিখেছেন।
এ যাবৎ প্রায় পঞ্চাশটির বেশি ভাষায় রুমির কবিতা অনূদিত হয়েছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকে পাশ্চাত্যে তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হলে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। Harper One প্রকাশিত ‘Essential Rumi’ বিশ্বের ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয় এবং ২০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়। ইউনেসকো ২০০৭ সালে রুমির ৮০০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর নামে একটি মেডেল চালু করে।
রুমির নামের সঙ্গে মাওলানা দেখে কেউ কেউ তাঁকে না বুঝেই মুখ ফিরিয়ে নেন। প্রকৃতপক্ষে রুমি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের কবি নন। তিনি মানবতার ও আধ্যাত্মিকতার কবি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে তিনি ঈশ্বর, মানুষ, আত্মা এবং মহাবিশ্বের প্রেমের জয়গান করেছেন। বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিতে তুলে এনেছেন ফুল, পাখি, নক্ষত্র, চাঁদ, সূর্য, নদী, মাছ এমনকি মহাকাশ বিজ্ঞানীর অ্যাস্ট্রোল্যাব পর্যন্ত। ইতিহাস, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে মানব জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। (চলবে)