সায়লার চোখে জল

লাউড স্পিকারে ঘোষণা এল, নিউইয়র্কগামী যাত্রীদের বিমানে আরোহণ করতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। চারদিকে একটা চাঞ্চল্য ভাব। হাতের ব্যাগ টানতে টানতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাউঞ্জ থেকে বেরোতেই গরমে ভীষণ অস্বস্তি বোধ হয় সায়লার। যদিও এই আলো বাতাসেই তাঁর বেড়ে ওঠা।
দূরে পেটমোটা ধাতব নির্মিত বিশাল লম্বা এক জোড়া পাখাওয়ালা বোয়িং বিমানটি ছোট্ট তিনটি চাকার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মাটি থেকে একটু উঁচুতে তুলে ধরা হয়েছে তার কটিদেশ। ওপরে মেঘমুক্ত আকাশ দেখে মনে হলো বিশাল একটা সিনেমার পর্দা। হাঁটা পথের রানওয়েতে যাত্রীদের খুব ঠেলাঠেলি হতে থাকে। পাশের এক যাত্রী দুহাতে দুটো ব্যাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা বারবার সায়লার পায়ে এসে লাগছে। সে লোকটাকে পথ করে দিতে সরে দাঁড়ায়। ভেতরে একটা নীরবতা আর বুক ফাটা কান্নায় দুই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে সায়লার। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে প্রায় সব যাত্রীই উঠে গেছে বিমানে। একটু পা চালিয়ে সায়লা চলে আসে সিঁড়ির কাছে। বোর্ডিং কার্ড দেখায়, বিমানে পা রাখার মুহূর্তে আবার সে পেছনে তাকায়, দেখে তাঁর ছোট ভাই রাসু বিমান বন্দরের সীমান্তের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আবার সায়লার চোখে জল। কেন সে পেছনে তাকাল! কোনো আবেগ আর উৎকণ্ঠা কি তাকে আটকাতে পারবে? হঠাৎ বিমানবালার স্বাগতম সম্বোধনে সামনে তাকায় সায়লা। সামনে বিমানবালার সবুজ শাড়ির রং যেন চোখ আটকে দিয়েছে। আরেকজন বিমানবালা তাকে নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দেয়। তারপর মৃদু হেসে বিমানবালা চলে যায়। সায়লা সামনে তাকায়। দেখে একজন বিমানবালা সিটবেল্ট বাঁধা থেকে শুরু করে সব নিয়ম হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিচ্ছে। আরেকজন মাইকে বলে দিচ্ছে। সায়লা সিটবেল্ট বেঁধে নিল।
প্রচণ্ড শব্দে উঠল বোয়িং বিমানের ইঞ্জিন। বৈমানিক তাঁর এবং বিমানের পক্ষ থেকে যাত্রীদের স্বাগত জানালেন এবং যাত্রা নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করলেন। সায়লা মনে একটু সান্ত্বনার সুর ধ্বনিত হলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে শেষবারের মতো ঢাকাকে দেখে নিল সায়লা। বুকের ভেতরে একটা সঞ্চরণশীল উত্তেজনা অনুভব করে সায়লা। বিমানটা লম্বা রানওয়ের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে আকাশের দিকে মুখ স্থির করে আবার গর্জন করে ওঠে ইঞ্জিন। তারপর একটা লম্বা শিস দিয়ে বিমান দৌড়ায়। সঙ্গে গাছপালা বাড়িঘর সব যেন বিমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। তারপর মুহূর্তেই বিমানটা লাফিয়ে উঠে যায় আকাশে। সায়লা নিচে তাকানোর চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। কারণ পাশের জানালায় বিশাল দেহী এক নারী জানালা প্রায় ঢেকে বসে আছে।
এতক্ষণে বিমানটা মধ্য আকাশে উড়ে চলেছে। সায়লার মনের আতঙ্ক অনেকটা লাঘব হয়েছে। নিজেকে সে আকাশের নীলে সাদা রঙের মেঘের ভেলার মতো ভাসিয়ে দিয়েছে। তবুও যেন এক অজানা আতঙ্কে বারবার তাকে ভাবিয়ে তুলছে। জীবনে এই প্রথম সে পা বাড়িয়েছে বিদেশ বিভুঁইয়ের পথে। ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকার স্বপ্নে সে বিভোর ছিল। কিন্তু তার বাবার অভাবের সংসারে সায়লার স্বপ্ন যেন বারবার হোঁচট খাচ্ছিল। সেই খুলনা থেকে ঢাকায় আসা। আমেরিকান দূতাবাসে দৌড়ানো। ভিসা ফি আর আমেরিকায় আসা বাবদ এত খরচাপাতি তার বাবা কীভাবে সামলাবেন।
বিত্তশালীদের কেউ কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন তাঁদের স্বার্থকে সামনে রেখে। সায়লা সুন্দরী, শিক্ষিতা; তার ওপর ডিভি লটারি জয়ী। তাকে সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করা যায়। যদি সায়লার সঙ্গে একজনের ছেলের বিয়েতে সায়লার বাবার মত থাকে।
তিন মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সায়লার বাবা-মার সংসার। বাবা খেটে খাওয়া দিনমজুর। অনেক কষ্টে তিন মেয়ে আর এক ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে সায়লার বাবা খালেক মিয়া হাঁপিয়ে উঠেছেন। তার ওপর এই উটকো সমস্যা। কিন্তু মেয়েকে তো আর যেনতেন ভাবে কন্যাদান করা যায় না। সায়লার মা হাজেরা বেগম এ সব প্রলোভনের প্রস্তাবকে পাত্তাই দিতে চাইলেন না। হাজেরা বেগম স্বামীকে জানিয়ে দিলেন, দরকার হলে তাঁর মায়ের দানের ভিটেমাটি বিক্রি করে সায়লাকে আমেরিকা পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন তবুও কারও করুণার স্বার্থের কাছে মাথা নত করবেন না।
এদিকে খালেক মিয়ার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়র ছেলে মল্লিক সরকার অনেক দিন থেকে সায়লাকে পছন্দ করে। যে কোনো মূল্যে সে পেতে চায় সায়লাকে। কিন্তু সায়লা কখনো তাকে পাত্তা দেয়নি। মল্লিকের মাস্তানির দাপটে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। তল্লাটে এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা মল্লিক ছাড়া ঘটেছে। কিন্তু আজ এই মল্লিক মরণপণ বাজি রেখে এগিয়ে এল সায়লাকে সাহায্য করতে। কিন্তু সায়লার মা হাজেরা বেগম কিছুতেই মল্লিকের প্রস্তাবে রাজি না। তাই এলাকার স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মুরুব্বিদের সহায়তায় নগদ পাঁচ লাখ টাকা আর সায়লার আমেরিকা যাওয়ার সম্পূর্ণ খরচ বহন করার মর্মে সায়লার মা-বাবাকে রাজি করানো হলো। অগত্যা সায়লার মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করেই তাড়াহুড়ো করে সবকিছুর ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে গেল। কিন্তু সায়লা কিছুতে এ সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তবুও পরিবারের অসহায়ত্বের কথা, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিল।
হঠাৎ বিমানের পাইলটের ঘোষণায় সংবিৎ ফিরে পায় সায়লা। ককপিট থেকে ঘোষণা আসে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটা ল্যান্ড করতে যাচ্ছে নিউইয়র্কের আন্তর্জাতিক জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে।
রানওয়ে ঘুরে এসে সায়লার বিমান সিঁড়িঘর বরাবর যখন দাঁড়িয়ে গেল তখন যাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের মনো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল যার যার হাতব্যাগ বাংকার থেকে নামিয়ে রাখতে। সায়লা তখনো নিদারুণ ভাবনায় নিমজ্জিত।
নিউইয়র্ক প্রবাসী তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ফরিদ ভাই বিমান বন্দরে আসার কথা সায়লাকে নিয়ে যেতে। ফরিদ মিয়ার পরিবারের সঙ্গেই সায়লার থাকার কথা। সায়লা জীবনে ফরিদ মিয়াকে দেখেনি কোনো দিন। এই নিয়ে দারুণ উৎকণ্ঠা সায়লার মনে। যাত্রীরা একে একে বিমান থেকে নামার পাঁয়তারা করছে। সায়লাও ব্যাগ হাতে নিয়ে সবাইকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগল।