ফ্লাইট মিস ও ব্লু মসজিদ দর্শন

নিউইয়র্কে ফেরত যাত্রার তারিখ ছিল ১৭ মার্চ ভোর ৬টা ৫৫ মিনিটে। তার মানে ১৬ মার্চ মধ্যরাতে ছুটতে হবে বিমানবন্দরে। ১৬ মার্চ পুরো দিনটি কেটে গেল নানা ব্যস্ততায়। ভোর পাঁচটায় তসলিম ও শর্মী নামিয়ে দিয়ে গেল ঢাকায় হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো অল্প সময়ে। কিন্তু টার্কিশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটি আকাশে উড়ল পুরো এক ঘণ্টা দেরিতে। যাত্রাপথে আসনের সামনের স্ক্রিনে দেখানো ফ্লাইট পথ বারবার বদল করছে কোনো ঘোষণা ছাড়াই। যাত্রার অর্ধেক পথ আসার পর ককপিট থেকে এল ঘোষণা। পাকিস্তান ও ভারত সীমানায় আকাশ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় উড়োজাহাজ সরাসরি যেতে পারছে না, তাই ঘুরে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে ভারতের ওপর দিয়ে উড়ে ইস্তাম্বুল পৌঁছাতে দেরি হবে এক ঘণ্টার বেশি। তার মানে কী দাঁড়াল, যাত্রার শুরু হলো এক ঘণ্টা পর ঘোরা পথে আরও এক ঘণ্টা মানে মোট দু ঘণ্টা দেরি করে পৌঁছাবে টার্কিশ এয়ারলাইনসের এয়ার বাস এ৩৩০-৩০০ মাঝারি আকারের উড়োজাহাজটি।
নিউইয়র্কের সংযোগ উড়োজাহাজটির যাত্রা শুরুর সময় দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে ইস্তাম্বুলের স্থানীয় সময়ে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা উড়োজাহাজ ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমান বন্দরে নামল মাত্র আধা ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে। ট্রানজিটের নানা আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিউইয়র্কগামী বিমান ধরতে গেটে পৌঁছে দেখি গেট লক করে উড়োজাহাজের লোকজন খোশগল্প করছে। আয়নার ওপাশে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, টার্কিশ এয়ারলাইনসের নিউইয়র্কগামী ফ্লাইট ট্রিপল সেভেন থ্রি হানড্রেড বৃহৎ আকারের উড়োজাহাজটি ধীরে ধীরে রানওয়ের উদ্দেশে রাজকীয় ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে টানা ১১/১২ ঘণ্টা আকাশে ওড়ার বাসনায়। চারদিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করলাম, সংযোগ উড়োজাহাজ ধরতে না পারার যাত্রীদের সংখ্যা জনা বিশেকের বেশি। পরে জানলাম, দিল্লি থেকে ছেড়ে আসা উড়োজাহাজও দেরিতে পৌঁছেছে ইস্তাম্বুল। নিউইয়র্ক যেতে ইচ্ছুক যেসব যাত্রী সংযোগ ফ্লাইট মিস করেছেন তাদের সবাইকে বলা হলো, যত দ্রুত সম্ভব কাস্টমার সার্ভিসে রিপোর্ট করতে। নিউইয়র্কগামী উড়োজাহাজের জন্য নির্ধারিত ২০৯ নম্বর গেট থেকে আবার ফেরত এলাম ২১৫ নম্বর গেটের যাত্রী সেবার কাউন্টারে। দাঁড়াতে হলো প্রায় ১৫ জনের পেছনে। এখানে সাক্ষাৎ হয়ে যায় এক ভারতীয় যাত্রীর সঙ্গে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি নিউইয়র্কগামী যাত্রী কিনা। স্বাভাবিকভাবে আমি হ্যাঁ বলে যে এই বিপদে পড়ব তা কল্পনাও করতে পারেনি। তারপর তিনি আমার পেছনে পড়লেন আর আমাকে কী পরিমাণ জ্বালাতন করলেন তার সব বিবরণ দেওয়া সংগত নয় বলে মনে করছি। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি চেষ্টা করেছি প্রথমবারের মতো আমেরিকাগামী এই ভারতীয় যাত্রীকে সর্বোচ্চ সেবাদানের, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল অনলাইনে ট্রানজিট ভিসার আবেদন করে নিজ ব্যাংক কার্ডের সাহায্যে ফি পরিশোধের। যদিও তাঁর কারণে আমি খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে হোটেলে গেলাম এক ঘণ্টা পর। তবু যখন সেই ভদ্রলোক দুহাত জোড় করে তাঁকে সহায়তার জন্য বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, তখন মনে হলো মানুষ তো মানুষের জন্যই। সৃষ্টিকর্তার স্পষ্ট অঙ্গীকার, বিপদে কিংবা কারও প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও, আমি সৃষ্টিকর্তা তোমার পাশে সারাক্ষণ থাকব। বাড়তি পাওনা ছিল সাইড ব্যাগ থেকে বের করে দেওয়া দুটো নাড়ু। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার প্রতীক।
ভারতীয় যাত্রীর ভিসা লাগানোর পর আমার বাড়িয়ে দেওয়া আমেরিকান পাসপোর্ট দেখে অভিবাসন ডেস্কে বসা তুর্কি তরুণীর চোখেমুখে বিস্ময়। আমি ভেবেছি, তুমি ওই ভারতীয় যাত্রীর সাথি, তুমি সামান্য ফি দিয়ে সহজে তোমার ভিসা লাগাতে পারতে স্বল্প সময়ে। এতক্ষণ কি তোমার ভারতীয় সহযাত্রীর জন্য অপেক্ষা করলে? বাহ বেশ তো। আমার আর তখন মুড ছিল না তাকে বুঝিয়ে বলি, সঙ্গের ভারতীয় যাত্রীর সঙ্গে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সাক্ষাৎ হলো মাত্র। শুধু একজন সহযাত্রীর সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিয়েছি, তার চাইতে বেশি কিছু নয়। এ কথা বলেই পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা অনুসরণ করে চলে এলাম তুর্কি অভিবাসন পুলিশের কাছে।
মুখে গম্ভীরতা নিয়ে তরুণ কর্মকর্তা পাসপোর্টে শুধু সিল মেরে ছেড়ে না দিয়ে সহজ করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন, আমাদের স্বল্প যাত্রাবিরতি পর্বে পরের অনুসন্ধান কেন্দ্র কোথায়? ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেলে যেতে উদ্‌গ্রীব আমার কানে শেষ যে কথাটুকু গেঁথে রইল তা হলো স্টার বাক্স কফি শপের পাশের কক্ষেই পেয়ে যাবে তোমার কাঙ্ক্ষিত হোটেলে যাওয়ার যাবতীয় নির্দেশনা। মিনিট দুই হাঁটার পর প্রথমেই চোখে পড়ে গেল, নানা জাতের মজাদার কফির বিপুল সমাহার নিয়ে বিখ্যাত কফিশপ স্টার বাক্স। মাঝারি আকারের কফির মগে যত্ন করে বানিয়ে দিল এক কাপ ক্যাপেচিনো। সঙ্গে উপরি পাওনা ছিল তুর্কি লাস্যময়ী তরুণীর মিষ্টি হাসি। কফিসহ সব সেবার বিনিময় মূল্য ছিল মাত্র ১৫ লিরা (টার্কি মুদ্রার নাম) অর্থাৎ মাত্র তিন ডলার।
অর্ধেক কফি শেষ না করতে ডাক পড়ে গেল হোটেলে যাওয়ার বাসে উঠতে। বাইরে ঝকঝকে মধ্য দুপুরের সুন্দর রৌদ্রস্নাত দিন। হালকা ঠান্ডায় ১২ আসনের মিনিবাসটি চলতে শুরু করল ঢালু পথ বেয়ে। মিনিট বিশেক প্রশস্ত মহাসড়ক ধরে চলে বামে মোড় নিয়ে অতিক্রম করল বিরাট এক গোল চত্বর। এর পর লোকাল ট্রাফিক চলা হাইওয়ে ধরে পাঁচ মিনিট পর শুরু করল ওপর দিকে চড়া। রাস্তার দুধারে ছোটবড়, কাছে এবং দূরের পাহাড়ের ঢালুতে প্রচুর আবাসিক বাড়ি ঘর। কোথাও রাস্তা লাগোয়া শপিংমল, নয়তো নানা আকারের আবাসিক হোটেল। আরও কিছুক্ষণ চলার পর রাস্তা থেকে বামের ঢালুতে তৈরি পাঁচ তারকার সুবিধা সংবলিত হোটেল ইস্তাম্বুল গনেনের সামনে এসে থেমে গেল মিনিবাসটি। লবিতে বসতে হলো আরও কিছু সময়।
নাম ও ফ্লাইট নম্বর জেনে ফ্রন্ট ডেস্ক কর্মকর্তা আমাকে আজেম নামের রুম সার্ভিসের এক লোকের সঙ্গে যেতে বললেন। লিফট বেয়ে তার সঙ্গে দ্বিতীয় তলায় নেমে সামান্য হেঁটে সে দাঁড়াল ২০৬ নম্বর কক্ষের সামনে। পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি দরজা খোলার অপেক্ষায়। খেয়াল করে দেখি আজেম আমাকে দরজা খোলার ইশারা করছে। আমি বললাম, আমার কাছে তো চাবি নেই। জবাবে হেসে ইংরেজিতে সে বলে, এই দরজা চাবি দিয়ে খুলবে না। তোমার হাতের ছাপ লাগবে। হ্যাঁ, তাইতো এ ধরনের কারিগরি অভিজ্ঞতা আমার জন্য একদম নতুন, ঠিক সেই সময় মনে পড়ল ফ্রন্ট ডেস্কে ম্যানেজার নাম জিজ্ঞেস করে একটি আইপ্যাড সাদৃশ্য চারকোনা প্লেটে আমার পুরো ডানহাতের ছাপ নিয়েছিল। তর্জনীসহ চার আঙুলের মাথা দরজার এক পাশে স্টিল পাতে লাগাতেই সিসিম ফাঁকের মতো খুলে গেল দরজা। সার্ভিস বয় আমাকে সবকিছু দেখিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল, আমি চাইলে সুইমিং পুলের সুবিধা নিতে পারি। কক্ষের এক পাশের বিরাট আকারের বাথরুমে যা সুবিধা আছে, তাতে বাইরের সুইমিংপুলে না গেলেও চলবে। প্রমাণ সাইজের বিরাট বাথটাব জাকুজিসহ সবই আছে। বাথটাবে সেট করা আছে পায়ের পাতা, পিঠসহ ঘাড়ের পেশি ম্যাসেজের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা।
এবার সার্ভিস বয় আজেমের কথা সংক্ষেপে বলি। আজেমকে প্রথম দর্শনে মনে হলো সে তুর্কি না। তার চেহারাতে অন্য কোনো দেশের ছাপ আছে। আন্দাজ করলাম বসনীয় অথবা আলবেনীয় হবে। সব সুবিধা দেখানোর সময় গল্পছলে জেনে নিলাম আজেমের তুরস্কে বসবাসের কাহিনি। ওর পিতামহ ছিলেন বসনিয়ার প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা। যুগোস্লাভিয়া এক দেশ থাকাকালে আশির দশকের প্রথম দিকে তার পিতামহ তরুণ বয়সে মার্শাল টিটোর দলে যোগ দিয়েছিল। ১৯৯২ সালে বসনিয়া স্বাধীন হলে আজেমের পিতামহ পড়ে যায় রাজনৈতিক চক্রান্তে। শাসকদের হাত থেকে নিজের জান বাঁচাতে তুরস্কে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। ট্যাক্সি চালিয়ে সংসার চলাতে শুরু করে। আজেম জানাল, হোটেল ইস্তাম্বুল গনেন যে এলাকায় তার নাম নাকি নিউ বসনিয়া। রুম সার্ভিসকে বিদায় দিয়ে অনেক সময় নিয়ে আয়েশ করে গোসল সেরে নিলাম। ক্লান্তিতে মনে হলো বাথটাবে ঘুমিয়ে যাই। এর ওপর চলছে স্বয়ংক্রিয় মেসেজ পুরো শরীর জুড়ে, পিঠে ঘাড়ে আর দুপায়ের পেশিতে।
আহ কী আরাম! ঘুম আর তন্দ্রার মাঝামাঝিতে কানে এল বাথটাবের ওপরে রাখা ফোনে রিং হচ্ছে।
ফোনের রিং শুনে ভাবনায় পড়ে গেলাম। কিরে ভাই, কোনো ভুল কিছু করলাম নাকি? বাথটাবে গা এলিয়ে দিয়ে ফোনে হ্যালো বলতেই শুনি অন্য প্রান্ত থেকে পরিষ্কার সিলেটী বাংলায়, ‘ভাইছাব কিথা খবর?’ বললাম গোসল করছি ভাইজান। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভাইছাব নাইরা নি? ভালা ভালা, হুনউকা ব্লু মসজিদে যাইতানি। গেলে নিচে আউকা আধঘণ্টার মাঝে। জিজ্ঞেস করলাম, ভাইসাব আপনি কে? হো হো করে হেসে বলে উঠলেন ভাইছাব চিনছইন না নি? আমি আজীজ ভুইয়া, একলগে নু আইলাম ঢাকা থাকি।’ বললাম, ‘জী জী ভাইছাব ছিনছি আফনারে। আফনে তো আমার শ্বশুরের দেশের মানুষ। জী ব্লু মসজিদে যেতে চাই। নিচে আসছি আধা ঘণ্টা পর।’
লবিতে নেমে আজীজ ভাইকে লবির গিফট শপের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপরত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। ব্লু মসজিদে যাওয়ার জন্য গাড়ির ভাড়া নিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনা চলছে। দুপক্ষের লাগাতার প্রস্তাবে ফয়সালা হলো ভাড়া হবে মোট ৬০ মার্কিন ডলার।
মোট সময় ঠিক হলে তিন ঘণ্টা, অতিরিক্ত যানজট সাপেক্ষে আরও আধা ঘণ্টা নেওয়া হলো গ্রেস টাইম। বাইরে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া হলো, নৈশভোজের শেষ সময় রাত দশটা। তার মানে রাত ১০টার আগেই ফিরতে হবে হোটেলে।
ছয় আসনের আরামদায়ক মিনিবাস। আমি বসলাম চালকের পাশের আসনে। আজীজ ভাই পেছনের আসনের বাম দিয়ে বড় গ্লাস লাগানো জানালার পাশে। হোটেল ইস্তাম্বুল গনেন থেকে ব্লু মসজিদের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার পেরোতে বসফরাস প্রণালির পাশ দিয়ে যাওয়া প্রশস্ত রাস্তা ধরে ছুটছেন চালক ব্রাদার ইউসুফ। সামান্য ইংরেজিতে যতটুকু পারেন বুঝিয়ে যা বললেন, তাতে বোঝা গেলে তিনি কলেজে পড়াশোনা করছেন। গাড়ির মালিক গিফট শপের ম্যানেজার। উনি সেই গাড়িতে করে টুরিস্টদের এখানে–সেখানে নিয়ে যান বাড়তি কিছু রোজগারের আশায়। জানালেন, পুরো বছরে আয়–রোজগার মন্দ না। ইস্তাম্বুল শহরের আদি নাম ছিল ল্যাগোস। ইউরোপ ও এশিয়াকে বিভক্তকারী বসফরাস প্রণালির দুপাশের আজকের এই আধুনিক শহরের গোড়াপত্তন হয় ১১ শতক থেকে ১৩ শতকের মাঝামাঝি থ্রাসিয়ান (Thracian) গোত্রের মাধ্যমে। প্রকৃতিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সমঝে নিয়ে পাহাড়ঘেরা শহরটিকে অতি সুন্দর করে সাজিয়েছেন তিন হাজার বছর শাসন করনেআলা সম্রাট বাদশাহ ও খলিফারা।
সন্ধ্যায় ইস্তাম্বুলের রূপ যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। পাহাড়ের গায়ে তৈরি বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর নয়নাভিরাম দালান থেকে ছিটকে আসা আলোর ছটা বসফরাস প্রণালিতে পড়ে সৃষ্টি করেছে অপরূপ আলোর খেলা। বসফরাস প্রণালির নীল জলে ভেসে থাকে বিভিন্ন আকারের নৌযানসহ অনেক ছোট বড় নৌকা, যার প্রতিটি রঙিন আলো দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। অর্ধেক পথ যেতেই ব্রাদার ইউসুফ দেখালেন আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা টপকাপি মিউজিয়াম। তবে সন্ধ্যা নেমে আশায় মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে।
জাদুঘরকে ডানে রেখে আমাদের নিয়ে ছুটছেন ব্রাদার ইউসুফ। খানিক চলার পর দুরে পাহাড়ের ওপর দেখা গেল ব্লু মসজিদ। সে এক অপরূপ দৃশ্য। শৈল্পিক স্থাপনার সঙ্গে মিশে আছে মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্যের শক্তিমান রাজাদের শৌর্যবীর্যের দাম্ভিক উপস্থিতি। পুরো শহরজুড়ে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার নয়নাভিরাম উপস্থাপনায় চোখ আটকে থাকে হরদম। চোখ আর চেতনার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে না থেকে কোনো উপায় নেই। সেখান থেকে ফিরিয়ে আনলেন ব্রাদার ইউসুফ। তিনি বারবার বলেছেন, ব্রাদার আমরা ব্লু মসজিদে এসে গেছি।
বিরাট এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে চোখ ধাঁধানো ব্লু মসজিদসহ গ্র্যান্ড মসজিদের অপর স্থাপনা। মসজিদে ঢোকার অনেক আগেই এঁকেবেঁকে চলা রাস্তার দুপাশে রয়েছে গিফট শপের সারি, সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় স্বাদ নিয়ে বিচিত্র নামের রেস্তোরাঁ। প্রতিটি রেস্তোরাঁর সামনে রাখা তাজা মাছের বিপুল আয়োজন। ভাগ্যক্রমে আমি ও আজীজ ভাই ব্লু মসজিদ পরিদর্শন করে হোটেলে ফেরত আসার আগে দুটো মাছের স্বাদ নিয়ে এসেছি। এককথায় লা জবাব। মসজিদ চত্বরে হেঁটে আসতে আসতে শুনলাম এশার নামাজের আজান। চত্বরের এক পাশে মোগল স্থাপত্যের সঙ্গে মিল রেখে নির্মিত অজু খানায় অজু সেরে বসে আছি মসজিদের বারান্দায়। চারদিকে দুনিয়ার নানা দেশের মুসলিম ভাইদের বেশ বড়সড় জমায়েত। তাদের সঙ্গে আমরাও অপেক্ষায়, কখন খুলবে ঐতিহাসিক ব্লু মসজিদের মূল দরজা, যেখানে আদায় করব এশার চার রাকাতের ফরজ নামাজ। কারুকার্যময় বিশাল কাঠের দরজা খুলে দিতেই ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকেন নানা জাতের, নানা ভাষায় হাজার মুসল্লি। সঙ্গে সঙ্গে এক কাতারে শামিল হয়ে এশার ফরজ নামাজের নিয়ত করে যখন শুরুর অপেক্ষায়, তখনই শুনলাম ঐতিহাসিক ব্লু মসজিদের প্রধান ইমামের গম্ভীর সুরে এই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং শক্তিমান ও সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে পুরো মুসলিম উম্মার প্রিয় একটি আওয়াজ ‘আল্লাহ আকবার’, ‘আল্লাহ আকবার’।