বিশ্ব গণমাধ্যমে মুজিবের বন্দী জীবন

২৫ মার্চ রাতের পর থেকেই বেশ কিছুদিন কেউ জানতে পারেনি, শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় আছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যদিও বলা হচ্ছিল, তিনিব মুক্ত ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাকিস্তান সরকার কয়েক দিন স্পষ্ট করে বলেনি তিনি কোথায় আছেন। পরে জানা যায় ২৫ মার্চ রাতে তাঁকে নিজ বাসা থেকে রাত ১:৩০টার দিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৯ মার্চ করাচি থেকে সংবাদদাতা এস এফ এইচ বেগের পাঠানো যে সংবাদ ছাপে তার শিরোনাম ছিল, সেনাদের ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ [Army ‘Complete control’]। এতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের স্পষ্ট সংবাদ পাওয়া যায়। তিনি পাকিস্তান থেকে মুক্তি পান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ১৬ জানুয়ারি তিনি নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ সংবাদদাতা সিডনি এইচ সানবার্গের (নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক যাকে ২৬ মার্চ অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়) সঙ্গে ২৫ মার্চ রাতে কীভাবে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং গ্রেপ্তারের পর তিনি কী অবস্থায় ছিলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দেন, যা ছাপা হয় নিউইয়র্ক টাইমস–এর ১৮ জানুয়ারি সংখ্যায়। শিরোনাম ছিল ‘তিনি গ্রেপ্তার ও অন্তরীণের পুরো গল্পটা বললেন’ [He tells full story of arrest and detention]
—তিনি তাঁর ক্রন্দনরত স্ত্রী ও সন্তানদের বিদায় বললেন—তাঁরা ভালো করেই জানেন, তিনি আর ফিরে নাও আসতে পারেন। তারপর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা তাকে পেছন দিকে রাইফেলের বাঁটের খোঁচায় সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগল। তিনি জিপের কাছে পৌঁছালেন এবং তাঁর স্বভাবসুলভ ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি আমার পাইপ আর তামাক আনতে ভুলে গেছি, আমার অবশ্যই পাইপ ও তামাক লাগবে!’ সৈন্যরা একটু পিছু হটল এবং বিভ্রান্ত হলো, কিন্তু তাঁকে আবার বাসায় নিয়ে আসল যেখানে তার স্ত্রী তাঁর হাতে পাইপ ও তামাকের থলি তুলে দেন। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে তাঁকে পাকিস্তান সরকার সাড়ে নয় মাস কারারুদ্ধ করে রাখে।
এভাবেই শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো বর্ণনা করছিলেন তাঁর গ্রেপ্তার, কারারুদ্ধ অবস্থা ও অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া—গত সপ্তাহে মুক্তির কথা। কিছুটা স্বচ্ছন্দে ও কিছুটা তিক্ততায় এবং কখনোবা নিজের ভাগ্যের জন্য হাসিমুখে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অনর্গল ইংরেজিতে অল্পসংখ্যক আমেরিকান সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁর পাইপ ও তামাকের থলেটি সামনের কফি টেবিলের ওপরে ছিল। পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করছে এমনটি তিনি জানতে পেরেছিলেন জানিয়ে বলেন, ‘যখনই আমি বাড়ি থেকে বের হব, তখনই তারা আমার গাড়িতে একটা গ্রেনেড ছুড়ে আমাকে হত্যা করে বলবে, বাঙালি চরমপন্থীরা এই কাজ করেছে। তাই সেনারা আমার লোকদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিয়েছে। এজন্যই আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমি আমার বাড়িতেই থাকব। তারা আমার বাড়িতেই আমাকে হত্যা করুক, তাহলে সবাই জানবে, তারা আমাকে হত্যা করেছে এবং আমার রক্ত আমার মানুষকে শুদ্ধ করবে।’
ওই দিন ২৫ মার্চের পটভূমিতে যখন পূর্বাঞ্চলের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানিদের দীর্ঘ শোষণের অবসানে আন্দোলন করছিল এবং তাদের দমাতে চূড়ান্ত ব্যবস্থা প্রায় আসন্ন ছিল, তখন শেখ মুজিব তাঁর বড় ছেলে কামাল এবং দুই মেয়েকে আত্মগোপনে পাঠিয়ে দেন। তাঁর স্ত্রী ছোট ছেলে রাসেলকে নিয়ে তার সঙ্গেই ঢাকার ধানমন্ডি অংশে তাদের ছোট্ট দোতলা বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
তাদের অজান্তে মেজ ছেলে জামাল তাঁর কক্ষে ঘুমিয়েছিল। রাত ১০টার মধ্যে শেখ মুজিব জানতে পারেন, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা সাধারণ নাগরিকদের ওপর আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সৈন্যরা তাঁর বাসা ঘেরাও করে এবং অদূরেই একটি মর্টার শেল বিস্ফোরিত হয়। এ ধরনের আক্রমণের জন্য তিনি কিছু গোপন প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব বন্দর নগরী চট্টগ্রামে তাঁর গোপন সদর দপ্তরে যোগাযোগ করে জনগণের জন্য শেষ বার্তা দেন যা রেকর্ড করা হয়েছিল এবং পরে গোপন ট্রান্সমিটার থেকে প্রচার করা হয়েছিল। সেই বেতার বার্তার সারকথা ছিল—সেনা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোল এবং তোমাদের নেতার যাই হোক না কেন, যুদ্ধ করে যাও। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শেখ মুজিব এই আদেশটি আধাসামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের যারা তাঁকে পাহারা দিচ্ছিলেন, তাদের কাছেও পাঠান।
পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী রাত ১১টায় সারা শহরে আক্রমণ শুরু করে। দ্রুতই তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। সেনারা মধ্যরাত থেকে রাত ১টার মধ্যে শেখ মুজিবের বাড়িতে গুলি ছুড়তে শুরু করে। তিনি স্ত্রী ও সন্তানকে ওপরের তলায় ড্রেসিং রুমে নিয়ে যান। তারা ফ্লোরে শুয়ে থাকেন, মাথার ওপর দিয়ে সাঁ সাঁ শব্দে গুলি ছুটতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সৈন্যরা বাসায় ঢুকে একজন প্রহরীকে গুলি করে ক্রুদ্ধভাবে সিঁড়ির দিকে আসতে থাকে। শেখ মুজিব ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে বাইরে এসে তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গুলি বন্ধ কর! গুলি বন্ধ কর! কেন তোমরা গুলি করছ? যদি আমাকে গুলি করতে চাও, তবে চালাও গুলি, এই যে আমি; কেন তোমরা আমার লোক ও সন্তানদের গুলি করছ?’ আরও কিছু বিশৃঙ্খলার পর একজন মেজর সৈন্যদের থামিয়ে বলেন, আর গুলি নয়। তিনি শেখ মুজিবকে বললেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর অনুরোধে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে কিছুটা সময় দেওয়া হয়। তিনি পরিবারের সবাইকে বলেছিলেন, ‘তারা আমাকে মেরে ফেলতে পারে, তোমাদের সঙ্গে আমার হয়তো আর দেখা হবে না, কিন্তু আমার লোকেরা একদিন মুক্ত হবে, আমার আত্মা সেটা দেখে শান্তি পাবে।’ শেখ মুজিব বলেন, ‘তাঁরা আমাকে বাসা থেকে সংসদ ভবনে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে একটি চেয়ার দেওয়া হয়। এরপর তারা আমাকে চা সাধে।’ বিদ্রূপের সুরে তিনি স্মরণ করেন, ‘আমি বললাম, অপূর্ব, অপূর্ব মুহূর্ত। আমার জীবনে চা পানের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।’
শেখ মুজিব বলেন, এরপর তাকে ক্যান্টনমেন্টের একটি স্কুলে একটি অন্ধকার এবং নোংরা কক্ষে নেওয়া হয়। ছয় দিন তিনি সেই কক্ষে কাটান। ১ এপ্রিল তাঁকে উড়িয়ে নেওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে, সেখানে মিনওয়ালী কারাগারের একটি কনডেম সেলে তাঁকে রাখা হয়। পরে নয় মাস তাঁকে সেই কারাগারসহ পর্যায়ক্রমে লায়ালপুর এবং সাহিওয়াল কারাগারে রাখা হয়। সবই ছিল পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে। সামরিক সরকার ১২টি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু করে যার ছয়টিতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। একটি ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো। শেখ মুজিব যিনি নিজেও একজন আইনজ্ঞ ছিলেন তিনি জানতেন, কোনোভাবেই খালাস পাবেন না। সুতরাং তিনি বিলম্ব করার কৌশল নিলেন। মুচকি হেসে বললেন,‘আমিও তাদের সঙ্গে কিছুটা খেললাম। আমি কিছুটা সময় ক্ষেপণ করতে চাইলাম।

শীর্ষ আইনজীবী দাবি
প্রথমে শেখ মুজিবের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনজীবী এ কে বোখারিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি সব দলের কাছেই সম্মানিত ছিলেন। বোখারি তাঁর মক্কেলকে রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। কয়েক মাস পর লায়ালপুরে বিচার কাজ শুরু হয়। এ সময় শেখ মুজিব সহসা ঘুরে দাঁড়ান এবং ঘোষণা করেন, তিনি কৌশলী চান না। মি. বোখারিকে বাড়ি পাঠান যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নতুন সামরিক আইন জারি করেন—শেখ মুজিবকে অবশ্যই একজন আইনজীবী নিতে হবে, তা তিনি চান বা না চান। শেখ মুজিব বলেন, ‘তোমরা দেখলে তারা কেমন করে ‘আমার অধিকার সংরক্ষণ’ করছে। তারা আমাকে ফাঁসি দিতে শুধু একটি সার্টিফিকেট চায়।’ বিচার শেষ হলো ৪ ডিসেম্বর, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে, যাতে ভারতের বিজয় ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে অভ্যুদ্বয়ের মাধ্যমে। শেখ মুজিব বলেন, ‘ইয়াহিয়া মিলিটারি কোর্টের সব সদস্যকে রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠান, তারা কী পেল তা লিপিবদ্ধ করতে। কিন্তু এরপর তারা যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।’ সেই রায় যা অনেকটা হাস্যকর, নানা দ্বন্দ্বের মধ্য তা আর প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু ৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে মেনওয়ালী কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর শেখ মুজিবের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার একটা পরিকল্পনা ছিল, যা পরদিন সকালে ঘটতে যাচ্ছিল। মেনওয়ালী ছিল লে. জে. এ এ কে নিয়াজীর নিজ জেলা, যিনি টিক্কা খানের বদলে পূর্ব পাকিস্তানে কমান্ডার হন। ১৫ ডিসেম্বর কয়েদিদের যারা তাঁর জেলার ছিল, তাদের বলা হতো জেনারেল নিয়াজিকে বাঙালির হত্যা করেছে। পরদিন সকালে সেল-এর দরজা খোলা হলে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করত। তিনি বললেন তারা উৎসাহের সঙ্গে একমত ছিল।
ভোর ৪টায় হত্যাকাণ্ড ঘটার দুই ঘণ্টা আগে জেল সুপারিনটেনডেন্ট, যিনি শেখ মুজিবের প্রতি বন্ধু সুলভ ছিলেন তাঁর সেলের দরজা খুললেন। শেখ মুজিব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী আমাকে ফাঁসি দিতে নিয়ে যাচ্ছ? আমি দেখেছি, জেলের কর্মচারীরা সেলের বাইরে একটা কবর খনন করেছে। তারা বলেছে, এটি পরিখা, যদি ভারতীয় বিমান আক্রমণ করে তবে তাঁর নিরাপত্তার জন্য।’ সুপারিনটেনডেন্ট মুজিবকে নিশ্চয়তা দিলেন, তিনি তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাতে নিচ্ছেন না। শেখ মুজিব তখনো সংশয়ে ছিলেন। বললেন, ‘আমি তাকে বললাম, যদি তুমি আমাকে মারতে চাও, তাহলে আমাকে শেষ প্রার্থনার জন্য কয়েক মিনিট সময় দাও।’ জেল সুপার বললেন, না, না, কোনো সময় নেই।’ শেখ মুজিবকে টানতে টানতে তিনি বললেন, ‘তুমি তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে চল।’ যখন তারা দুজন কারাগার থেকে বাইরে বের হন, তখন তিনি এই পরিকল্পনার কথা বলেন। তিনি মুজিবকে মাইল খানিক দূরে তাঁর বাড়িতে নিয়ে দুই দিন রাখেন।
যুদ্ধ শেষ হচ্ছিল, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক বিশৃঙ্খলা চলছিল এবং ১৮ ডিসেম্বর সুপারিনটেনডেন্ট শেখ মুজিবকে বলেন, তার সম্পর্কে কথাটা জানাজানি হয়ে গেছে এবং তাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। সেই কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে কয়েক মাইল দূরে একটি খালি বাড়িতে নিয়ে যান। তিনি সেখানে ছিলেন নয় দিন। সৈন্যরা সুপারিনটেনডেন্টকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তিনি জানেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুপারিনটেনডেন্টকে বলেন, শেখ মুজিবকে লুকিয়ে রাখার দরকার নেই এবং তাঁর ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। কারণ জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে দেখতে চান এবং কথা বলতে চান। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ভুট্টো, যিনি ১৯ ডিসেম্বর ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। শেখ মুজিবকে বের করে তৎক্ষণাৎ রাওয়ালপিন্ডিতে উড়িয়ে নেওয়া হয়, সেখানে তাঁকে রাষ্ট্রপতি অতিথি ভবনে গৃহবন্দী হিসেবে রাখা হয়।
কিছুদিন পর পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মি. ভুট্টো শেখ মুজিবকে দেখতে গেলেন। শেখ মুজিব তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, ‘ভুট্টো তুমি এখানে কী করছ?’ বললেন, তিনি ভুট্টোর ক্ষমতা গ্রহণের কথা জেনেছেন কিন্তু কিছুটা কৌতুক করলেন। উত্তর এল, আমি প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। শেখ মুজিব বললেন, ‘চমৎকার অবস্থা।’ শেখ মুজিব স্মরণ করেন, ভুট্টো বলেন, ইয়াহিয়া যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, তখন তিনি বলেন, তার একটা বড় দুঃখ থেকে গেল, তিনি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারেননি। ভুট্টো শেখ মুজিবকে বলেন, ওই জেনারেল অগ্রবর্তী তারিখে কাগজ সই করতে চেয়েছিলেন যাতে দেখা যায়, তাঁর সময় এটা কার্যকর হয়েছিল। ভুট্টো এটি করতে অস্বীকৃতি জানান। শেখ মুজিব আজ বলেন, কারণটা মূলত ছিল রাজনৈতিক। ভুট্টো কারণ দেখান, যদি বাঙালি ওই নেতাকে হত্যা করা হয় তবে তারা প্রায় ১ লাখ পাকিস্তানি আত্মসমর্পণকারী সৈন্যকে হত্যা করবে যারা মূলত পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ। মানুষ এজন্য ভুট্টোকে অভিযুক্ত করবে।
ভুট্টো তাকে চাপ দিতে থাকেন, যত ক্ষীণই হোক পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের যেন একটা সম্পর্ক থাকে। শেখ মুজিব বলেন, ‘আমাকে প্রথমে একটা জিনিস জানতে হবে, আমি মুক্ত না কি মুক্ত না। যদি আমি মুক্ত হই তবে আমাকে যেতে দাও। যদি না হই তাহলে আমি কথা বলতে পারব না।’ তিনি ভুট্টোর সঙ্গে মুক্তির বিষয় ছাড়া কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলেননি।
আরেক সময়ে ভুট্টো যখন প্রতিবাদ করছিলেন, আইন অনুসারে ও ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তানের দুই অংশ এখনো সংযুক্ত, শেখ মুজিব তাঁকে মনে করিয়ে দেন, শেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল যা কখনো মানা হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘যদি পাকিস্তান এখনো একটি দেশ হয়, তবে তুমি প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নও।’ ৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট তৃতীয় ও শেষবার শেখ মুজিবের কাছে আসেন। বাঙালি নেতা তাকে বলেন, ‘তুমি অবশ্যই আজ রাতে আমাকে মুক্তি দেবে। সময় ক্ষেপণের আর সুযোগ নেই, হয় আমাকে মুক্ত কর অথবা হত্যা কর।’ শেখ মুজিব বলেন, ভুট্টো উত্তর দিলেন, এত সংক্ষিপ্ত সময়ে সব আয়োজন করা কঠিন। শেষে তিনি তাঁকে লন্ডন যেতে দিতে সম্মত হন। শেখ মুজিব বলেন, ভুট্টো তাকে যখন বিদায় জানান তখনো তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এখনো একটা রাজনৈতিক বন্ধনের কথা বলছেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে গোপনে যখন শেখ মুজিবের বিচার চলছিল, সেই সময় ২৯ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমস ‘Sheikh Mujib’ শিরোনামে এক কলামের ছোট্ট একটি সংবাদ ছাপে যার মূল বক্তব্য ছিল—গোপনীয়তাই হলো এই বিচারের মর্ম কথা। তারা জানতে পারে, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির দক্ষিণে কোনো একটি জেলখানায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার অভিযোগে সামরিক আইনে তার বিচার হচ্ছে। এর আগে অনেকেই তিনি তখনো বেঁচে আছেন কিনা তা নিয়ে সন্দিহান ছিল। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন তাকে শেষ পর্যস্ত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি, হলিস শাখার ম্যানেজার
ইমেল: [email protected]