বিশ্ব গণমাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ

ষষ্ঠ পর্ব
ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৯ মার্চ করাচি থেকে সংবাদদাতা এস এফ এইচ বেগ-এর পাঠানো সংবাদ ছাপে, যা ছিল মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিবৃতি। শিরোনাম ছিল—সেনাদের ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ [Army ‘Complete control’]
সংক্ষেপে সংবাদটি হলো—
গতকাল পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান সেখানকার অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ আছে বলে জানিয়েছেন।
করাচিতে সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, ভয়েস অব বাংলাদেশ নামের গোপন রেডিওটি কলকাতার কাছে হুগলি নদীতে একটি ভারতীয় জাহাজ থেকে প্রচার চালাচ্ছে।
তারা বলেন, সেনাবাহিনী ৬ ঘণ্টার মধ্যেই এটির সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে। কলকাতার কাছে বলেই রেডিওর রিসেপশন পূর্ব পাকিস্তানের যেকোনো শহরের চেয়ে কলকাতায় ভালো।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, তারা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অনেক মজার ঘটনা শুনেছেন। তারা উল্লেখ করেন, শুধু শেখ মুজিবের অনুসারী কিছু বিপথগামী যুবককেই চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে
শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে ছোট্ট একটি সেনার দলকে পাঠানো হয়, তার নিরাপত্তা কর্মকর্তা কমান্ডার মোজাম্মেল যিনি ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী মামলায় জড়িত ছিলেন তিনি রিভলবার বের করতে গেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, এরপর আরেকজন প্রহরী উপস্থিত হয়ে একই কাজ করলে তারও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, সেনাবাহিনী সেখানে পৌঁছার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র প্রহরী ও বিদ্রোহী ছাত্রদের মজুত করে রাখা গোলাবারুদ বিস্ফোরণে আগুন লাগে।
ওপরের প্রতিবেদনটি ছাড়াও ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৯ মার্চ বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন ছাপে ও সম্পাদকীয় লেখে। ৮৪ ঘণ্টা আগে ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত সাংবাদিক সাইমন ডিঙের একটি প্রতিবেদন যার শিরোনাম ছিল, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্ভবত ভারী’ [Casualties likely to be heavy]
এই সংবাদটি মূলত তার আগের পাঠানো সংবাদগুলোর পুনঃউল্লেখ যেখানে তিনি ঢাকায় তার অভিজ্ঞতা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
২৯ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফের আরেকটি প্রতিবেদন ছিল নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো ডেভিড লোসাকের যার শিরোনাম ছিল, ‘পূর্বাঞ্চল অবরুদ্ধ’ [East wing sealed off]। তাঁর প্রতিবেদনে বলা হয়—বহির্বিশ্বের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় সম্ভাব্য সব সূত্র থেকে জেনেছেন, এখানে কদর্য গৃহযুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চলছে। বিদেশি দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যে ক্ষীণ রেডিও যোগাযোগ আছে এবং যে সব বিদেশি পর্যবেক্ষক ঢাকা ত্যাগ করছিলেন, তারা ব্যাপক সেনা উপস্থিত ও হত্যার কথা উল্লেখ করেছেন। অনেকেই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বাঙালিদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করতে শুনেছেন। অনেকেই শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছেন সে রকম আভাস দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারের আভাস
বৃহস্পতিবার রাতে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় অবস্থান পরিবর্তনের পর সরকারি বাহিনীর ঘোষণায় আভাস পাওয়া যাচ্ছে, শেখ মুজিবকে বন্দী করেছে। এ ক্ষেত্রে গত মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ বলেছিলেন অথচ গত শুক্রবার ভাষণে তিনি তাঁকে ‘একজন দেশদ্রোহী’ বলেছেন।
৩০ জন সংবাদকর্মী, টেলিভিশন ক্যামেরাম্যানকে গত বৃহস্পতিবার ঘেরাও করে রাখা হয় যারা ছিলেন ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানি ও জাপানসহ অন্যান্য দেশের যাদের বন্দুকের মুখে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী বের করে দেয়, যাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করেছে। অস্ট্রেলিয়া ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের ডোনাল্ড হুক বলেন, তাঁকে নগ্ন করে তল্লাশি করা হয় এবং তার সব নোট ও ফিল্ম জব্দ করা হয় বলে অভিযোগ করেন।
ভারত উদ্বিগ্ন
পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে ভারত উদ্বিগ্ন। ভারতীয় কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মানেক্‌স মন্ত্রিসভা পর্যায়ের সভায় যোগ দিতে দিল্লি গেছেন। ভারতে সমস্যা জর্জরিত পশ্চিম বাংলা, যেখানে এখন রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে, তা পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত। এ মাসের গোড়ার দিকে রাজ্য ও সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রায় এক লাখ সৈন্য সেখানে অবস্থান করছিল, তাদের উপস্থিতি এখন সীমান্ত রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক হবে।
বিজয় দাবি
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ, তাই বিচ্ছিন্ন যে সব খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং গোপন রেডিও থেকে কুমিল্লা, যশোর, খুলনায় বিজয় দাবি করা হয়েছে। দুটি হাসপাতালে বোমা ফেলা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।
সংবাদটিতে বক্স আকারে ছোট একটি সংবাদ পরিবেশন করা হয়, যাতে বলা হয় ব্রিটেনের বার্মিংহামে প্রায় ৭ হাজার বাঙালি শেখ মুজিবের সমর্থনে জড়ো হয়। সেখান থেকে নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৯ মার্চ অত্যন্ত জোরালো ভাষায় একটি সম্পাদকীয় লেখে যার শিরোনাম ছিল ‘ভাগ করো, শাসন করো’ [Divide and rule]
সংক্ষেপে সম্পাদকীয়টি হয়েছে—
অর্থনীতি রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে আইয়ুব খান থেকে শুরু করে ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত বছরের পর বছর কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে। বাঙালিরা স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল, বিচ্ছিন্নতা চায়নি। কিন্তু এখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের দৈত্য বোতল থেকে বের হয়ে গেছে। পাঞ্জাব থেকে সব বেয়নেট আনা হলে একে আর ঠেলে ঢুকানো সম্ভব হবে না। জেনারেল ইয়াহিয়াকে পার্লামেন্টে গঠনের জন্য যেকোনোভাবে আলোচনায় বসতে হবে, অন্যথায় পূর্ব পাকিস্তান তার নিজস্ব রাস্তা দেখবে। সম্ভবত ভারত অথবা পশ্চিম বাংলার সঙ্গে কোনো মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলবে। যদি অলৌকিকভাবে কোনো সাংবিধানিক আলোচনা আবার শুরু হয়, তবে সেটা তার নিজস্ব গতিতে চলবে। পার্থক্য হলো, এই পথে শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়তো হতে পারে, এ ক্ষেত্রে পশ্চিমের পাওয়া হবে পূর্বের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক একটি সম্পর্ক ফিরে পাওয়া। অন্যথায় অনেক রক্তঝরার পর পূর্বে যে স্বাধীনতা আসবে পশ্চিমের তখন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৯ মার্চ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল—পাকিস্তান যুদ্ধে কোনো অনুকম্পা নেই, ‘শান্তি পুনরুদ্ধারের’ দাবি পশ্চিমের [No mercy in Pakistan fighting, ‘peace restored,’ West claims]
প্রতিবেদনটির সারবস্তু হলো—
পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা সপ্তাহান্তে শত শত সাধারণ নাগরিক হত্যার পর গতকাল পূর্বাঞ্চলে তাদের মুষ্টি আরও শক্তিশালী করেছে বলে জানা যায়।
আমাদের সংবাদদাতা দিল্লি থেকে তারবার্তায় জানাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তান কার্যত বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঢাকায় সান্ধ্য আইন উঠিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়, তবে বিশৃঙ্খলা দমাতে চট্টগ্রামে আরও সেনা পাঠানো হয়েছে। বিদেশি দূতাবাসগুলো বলছে, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের স্বাধীনতার আন্দোলন দমাতে সেনারা কোনো অনুকম্পা দেখাচ্ছে না।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা সিডনি এইচ সানবার্গ যাকে শনিবার পাকিস্তান সেনারা অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করেছেন তিনি ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস–এ আরেকটি প্রতিবেদন পাঠান যা ২৯ মার্চ ছাপা হয়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘ট্যাংকের বিরুদ্ধে লাঠি ও বল্লম’ [Sticks and Spears against Tanks]
প্রতিবেদনটিতে সিডনি উল্লেখ করেন, এই মাসের গোড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেকের কিছু পশ্চিমা সাংবাদিকের কথা হয়। তখন তিনি অবাধ্য জনসাধারণের সঙ্গে সেনার ব্যবহার কেমন হবে—তা বর্ণনা করছিলেন। দেখতে দীর্ঘদেহী এই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ‘যখন সেনা ডাকা হয় তখন সেটা হলো শেষ অবলম্বন। সেনারা তখন হত্যার জন্য গুলি ছুড়বে’—তাঁর এই কথা ছিল ভবিষ্যদ্বাণী। দুই সপ্তাহ পরে তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
সিডনি দীর্ঘ প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের কারণগুলো উল্লেখ করেন। উল্লেখ করেন ব্যাপক গণহত্যার কথা, ব্যাপক সেনা মোতায়েনের কথা, ভবিষ্যতের যুদ্ধে বাঙালিরা কেমন করে সুবিধা পাবে তার কিছু যুক্তি তুলে ধরেন— যেমন—নদীমাতৃক এই দেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী, নদীর চরিত্র, বর্ষাকাল, নরম মাটি, পরিচিত পরিবেশ কীভাবে বাঙালি গেরিলাদের সুবিধা দেবে। যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, এক হাজার মাইল দূরে থেকে যুদ্ধের সরঞ্জাম, রসদ ইত্যাদি নিয়ে সিলন (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) বা বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) হয়ে আসার ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এবং হবে তা বিস্তারিত বর্ণনা করেন। দুই মাস আগে দুজন কাশ্মীরি গেরিলা ভারতের একটি বিমান ছিনতাই করে পাকিস্তানে নিয়ে উড়িয়ে দিলে ভারত তার আকাশের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরিশেষে তিনি বলেন, এখন হয়তো বড় বড় শহর পাকিস্তানিরা দখল নিচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে তা ধরে রাখতে পারবে বলে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। (চলবে)

লেখক: নিউইয়র্কের কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার
ইমেইল: [email protected]