যে যাত্রা ভারী ভীষণ

আপন দেশে, আপন মানুষদের কাছে যাওয়া সব সময়ই অতি মধুর। কিন্তু সেই যাত্রা যদি হয় জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সত্যিটা জানার পর, যদি তাঁর জন্য হিমাগারে অপেক্ষা করে থাকে এমন কারও মরদেহ, যার থেকেই তাঁর জন্ম, তবে তার চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না! বুকের মধ্যে কেউ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী পাথরটা বসিয়ে দিয়েছে। আমার ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে এয়ারক্রাফটটা দুলতে থাকে। বাজে আবহাওয়ার জন্য একবার নিচে নামে তো আবার ওপরে ওঠে। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে শূন্যতার অনুভূতি হয়। পাশের সিটে বসা চীনা দম্পতি একের পর এক সিনেমা দেখে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে আমি একবার পাশের চেয়ারে বসা মেয়েটির হাত চেপে ধরি। ও কিছু মনে করে না। চৌদ্দ ঘণ্টা পাশাপাশি বসে থাকতে হবে। এই সময়টুকুতে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ তারাই।
সিনেমা দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে মেয়েটির স্বামী একসময় ঘুমায়। স্ত্রীটি ক্লান্তিহীনভাবে একের পর এক সিনেমা দেখে চলে। আমি কিছুক্ষণ ঘুমাই, আবার জেগে উঠি, আমার কিছু ভালো লাগে না। নিজেকে নিঃস্ব, রিক্ত ও খুব দুর্বল লাগে। কখনো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদি। আম্মার মৃত্যুর খবরটা পাই নিউইয়র্ক সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে। তারপর আর সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। আমার স্বামী রাত সাড়ে ১২টায় বাসায় ফেরে। দুঃসংবাদ শুনে চারদিকে ফোন করে অবশেষে বাংলাদেশে যাওয়ার একটা টিকিট বুক করে। আম্মার শরীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালের হিমাগারে রাখার ব্যবস্থা করে। ভোর ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে টিকিটটা সংগ্রহ করে আমি জেএফকের দিকে রওনা হই।
কষ্টের রাতও এক সময় ভোর দেখে। মেঘের ওপর মেঘ; তার ওপর সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি পড়ার পর কেমন যেন অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বপ্নরাজ্যে আছি বলে ভ্রম হয়। মনে হয় আমি যেন প্লেনে করে সপ্ত আসমানের ওপরে চলে গেছি। ভয়ংকর সৌন্দর্য আমার সহ্য হয় না; কেমন যেন লাগে। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। উঠে দেখি চারদিকে অন্ধকারে বেশির ভাগ যাত্রী ঘুমাচ্ছে। পাশে বসা চীনা নারীটি শুধু জেগে আছে। সামনের স্ক্রিনের আলোয় আলোকিত তার মুখ। বেশ কয়েক ঘণ্টা আমি কারও সঙ্গে কথা বলিনি। হঠাৎ নিজের কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করে। পাশে বসা ভদ্রমহিলাকে বলি, ‘তোমাকে ঘুমাতে দেখলাম না। তুমি খুব কম ঘুমাও!’ আমার না প্রশ্ন, না মন্তব্য ধরনের কথার উত্তরে মহিলাটি চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে হাসে। কিছুক্ষণ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে আমি আবার ফিরে যাই আমার ভঙ্গুর অবস্থায়। আমার কিছু ভালো লাগে না। নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার অনুভূতির মতো কেমন যেন বিবমিষা হয়। আবার আমার চোখ ভেঙে পানি ঝরতে থাকে। আমি আকুল হয়ে কাঁদতে থাকি।
আমার মা, যার জন্য আমি গত কয়েক বছরে কিছুই করতে পারিনি। বরং বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় মায়ের ওপর বিরক্ত হয়েছি। বলেছি, ‘মনে জোর আনতে পারো না কেন! তুমি এত দুর্বল কেন?’ মায়ের সঙ্গে শেষের কয়েক দিন ঠিকভাবে কথাও বলতে পারিনি। যেদিন মা চলে গেলেন, ওই দিন দু-তিনবার ভেবেছিলাম, ভিডিও কল করব। কিন্তু করা হয়নি। বরং আমি ব্যস্ত ছিলাম বেশি ফেসবুকে অন্যের পোস্ট দেখায়। ব্যস্ত ছিলাম অপ্রয়োজনীয় ফোন করায়। ছেলেদের স্কুল বন্ধ ছিল বলে কোথাও যাওয়া যায় কিনা, এই নিয়ে পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলাম।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে যখন ঘরের সব কাজ শেষ করছিলাম, তখন মেসেঞ্জারে আমার বোনের নম্বর থেকে ফোন এল। ও কখনো এত রাতে এভাবে ফোন করে না। ভয়ংকর দুঃসংবাদ শোনার আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরল। আমি কল রিসিভ করলাম। অনেকগুলো উচ্চকিত কণ্ঠ শুনলাম। সবাই চিৎকার করে কথা বলছে। একজন তাদের মধ্যে জোরে বলে উঠল, ‘আপা, আমার নাম রুমা। আপনাদের বাসায় কাজ করি। আপনার আম্মা মারা গেছে।’
এই একটা বাক্য যেন ভ্যূলোক-দ্যুলোক-গোলকব্যাপী বাজতে লাগল। ‘আপনার আম্মা মারা গেছে।’ মনে হলো পৃথিবীতে এর চেয়ে নির্মম কোনো কথা হতে পারে না। আমি আমার এতখানি জীবনে এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো খবর যেন শুনিনি। কিন্তু কীভাবে আমার আম্মা মারা যাবে? আম্মা তো আম্মাই। তিনি কীভাবে নাই হয়ে যেতে পারেন! প্রচণ্ড শীতের রাতে আমার সারা শরীর ঘেমে ওঠে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমার মাথা ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর ভয়ংকরতম বাক্যটা শোনার পর সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।
আমি আবার আমার বোনের মেসেঞ্জারে কল দিই। কাউকে বলি, ভিডিওটা ওপেন করে দেওয়ার জন্য। আমার মায়ের ঘরে তখন অনেক লোক আসতে শুরু করেছে। নিজের খাটে ঘুমিয়ে আছে আমার মা। ঘুমের মধ্যেও মাথায় ঘোমটা দিয়ে আছেন তিনি। মাথার দুই পাশে কালো চুল। ৬৩ বছর বয়সেও আমার মায়ের চুলের বেশির ভাগ ছিল কালো। বাদামি ফরসা মুখ, সেখানে নেই কোনো মৃত্যু যন্ত্রণার ছাপ। যেন এক স্বপ্নের ভেতরে আছেন তিনি। মায়ের পাশে শোয়া আমার বোনেরা চিৎকার করে কাঁদছে। বারবার মাকে জড়িয়ে ধরছে। মায়ের মাথা ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে, ‘মা, শ্বাস নাও মা, শ্বাস নাও।’
২.
অজপাড়াগাঁয়ের এক কিশোরী একদিন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে মহকুমা শহরে এল। এক আত্মীয়ের বাড়িতে সে প্রায় এক মাস থেকে পরীক্ষা দিল। তারপর সে কেউন্দিয়ায় গ্রামের বাড়ি ফিরে কুপির আলোতে সেই ঘটনা লিখল। কিশোরীর হাতের লেখা ছিল যেন মুক্তো বসানো। ওর ১৬ বছর বয়সের জীবনে ওটাই ছিল সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। সেই যাত্রার কথা লিখে রাখল খাতার পাতায়। কিশোরীর আরও অনেকগুলো খাতা ছিল। কোনোটাতে সে কবিতা লিখত, কোনটাতে প্রিয় সিনেমার গান। সে তো কখনো জানত না তাঁর অনাগত সন্তান একদিন সেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পিরোজপুরে যাত্রার লেখা পড়ে অঝোরে কাঁদবে।
তাঁর সন্তানদের কাছে সেই মা ছিল রোদ-বৃষ্টি-আলো-হাওয়া-জলের মতো। মা তো থাকবেই পাশে সুদিনে-দুর্দিনে; তারা ধরেই নিয়েছিল। ধূসর হয়ে যাওয়া সেই খাতাগুলোর মতো তাদের মাও দিন দিন ধূসর হয়ে যাচ্ছে, তারা বুঝতে পারেনি। সংসার আর সন্তানে আকীর্ণ মা যে তাদের ছেড়ে এভাবে আকস্মিকভাবে চলে যেতে পারে, তা তাদের ধারণাতে ছিল না। যে মহকুমা শহরে সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল, দুই বছর পর সেখানেই নতুন বউ হয়ে এল সে। পেছনে ফেলে এল নিজের সব সাধ-বাসনা, আর স্বপ্নগুলোকে। তার আর নিজের বলে কিছু থাকল না।
তবু সে মাঝেমধ্যে পুরোনো কাপড়ে রিপু করার সময় কিংবা রান্না ঘরে শাক বাছতে বাছতে আপন মনে গান গাইত। সেই গানটা কানে লেগেছিল তার বড় মেয়ের। সেই মেয়ে নিউইয়র্ক থেকে প্রথমে ঢাকা, তারপর মায়ের শবদেহ নিয়ে পিরোজপুরে গিয়েছিল বহুদিন পরে। প্রিয় জন্মভূমিতে মাত্র চার দিনের সফর শেষে প্রায় খালি স্যুটকেসে মায়ের পরনের শাড়ি, গায়ে দেওয়ার কাঁথা, আর নিয়মিত যে কোরআন শরিফটা পড়ত মা, সেটা নিয়ে ফিরে এল। তারপর এক রাতে বড় মেয়ে তার ছেলের জন্য ইউটিউবে একটা বাংলা সিনেমার গান খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ বহুকাল পরে মায়ের গাওয়া সেই গানটা খুঁজে পেল-
‘লিখেছ আর না আসিতে…
রজনী কেটে গেল ভাবিতে ভাবিতে।
হৃদয়বীণার তার ছিঁড়ে যায়
তোমায় ছেড়ে চলে যেতে
ভাবিতে ভাবিতে।
তোমার পত্রলেখা যতবার পড়েছি
মনের অজান্তে আঁখিজলে ভেসেছি...।’
বড় মেয়ে প্রতি রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সিংকে থালাবাসন মাজতে মাজতে ইউটিউবে গানটা শোনে। আর তার আঁখিজল এসে মিশে যায় সিংকের পানির সঙ্গে। একজন কিশোরী যে তার গ্রাম থেকে একদিন যাত্রা শুরু করেছিল, প্রথমে মহকুমা শহর, তারপর রাজধানী শহরে এসে থিতু হয়েছিল তাঁর জীবন, কত আনন্দ-বেদনা, কত মান-অপমান সয়েছে সে, কত অভিমান করেছে সে জীবনময়, সবকিছু ছেড়ে তাকে চলে যেতে হলো! এভাবেই সবাইকে চলে যেতে হয়। কারও জন্য থেমে থাকে না পৃথিবীর কোনো কিছুই।