পরবাসে রমজান যেমন

নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে বসবাসরত বাঙালি পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে বসে ইফতার
নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে বসবাসরত বাঙালি পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে বসে ইফতার

ঝকঝকে রোদ আর হালকা হিমেল বাতাসের চমৎকার এক দুপুর। ইফতারের জন্য কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম ব্যস্ততম জ্যাকসন হাইটস এলাকায়। রাস্তার একপাশে চটপটি ফুচকার গাড়ি। রোজকার চেয়ে ভিন্ন এক দৃশ্য সেখানে। সর্বদা দুই হাতে ক্রেতাদের খাবার দিতে ব্যস্ত মানুষ দুজন দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ক্রেতা নেই, নেই ব্যস্ততা। কিছু দূর যেতেই সামনে প্রিয় খাবার জায়রোর গাড়ি। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মাঝে গল্পে মশগুল বিক্রেতা দুই বাংলাদেশি ভাই। সারা বছর যাদের দম ফেলার ফুসরত নেই, দুদণ্ড কথা বলার সময় নেই, সেই তারাই অখণ্ড অবসর সময় কাটাচ্ছেন, হাসিমুখে গল্প করছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম, রমজানের মাস বলে সকাল থেকেই বেচা বিক্রি নেই, ক্রেতা নেই বললেই চলে। তবে সন্ধ্যা নামার কিছু আগে ব্যস্ততা বাড়ে। ইফতারের জন্য দীর্ঘ লাইন সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় তখন।
অনেক রোজাদারই ইফতারে ভাজাপোড়া না খেয়ে এক প্যাকেট জায়রো দিয়ে ইফতার সারেন। বাঙালি রেস্তোরাঁগুলোতেও দিনভর তেমন মানুষ চোখে না পড়লেও বিকেলের দিকে রোজাদারদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। রকমারি খাবারে সাজানো ইফতারের বক্স সামনে নিয়ে বসেন রোজাদার মানুষেরা। সর্বত্র পবিত্র মাহে রমজানের পরিবেশ। এই যে বিদেশ বিভুঁইয়ের হালাল খাবারের রেস্তোরাঁয়, কিংবা রাস্তার পাশের খাবারের দোকানগুলোয় দিনে স্থবিরতা, এ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় সংযমের কথা। মসজিদগুলোয় বিভিন্ন দেশের রোজাদারদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। মুসলমানরা একসঙ্গে বসে ইফতার করেন। তারাবির নামাজে থাকে মুসল্লিদের ভিড়। কোথাও কোথাও মসজিদের ভেতরে স্থান সংকুলানের অভাবে বাইরেও চাদর বিছিয়ে নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এই শহরের মুসলমানদের সব রকম অনুষ্ঠানাদি বন্ধ থাকে সংযমের এই মাসে। অনুষ্ঠান বলতে যে আয়োজন হয়, তা কেবল রোজাদারদের নিয়ে ইফতারের সময়ে একসঙ্গে বসে ইফতার করা—এটুকুই।
বছর দুয়েক আগেও রমজান হতো গ্রীষ্মকালীন স্কুল ছুটির সময়ে। যে সময়ে বাঙালিদের অঞ্চলভিত্তিক সংগঠনগুলোর বনভোজনের মতো আনন্দ আয়োজন হতো অহরহ। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করতাম, সিয়াম সাধনার এই মাসে কেউ কোনো বনভোজনের আয়োজন করত না তখন। এই যে হাজারো ব্যস্ততার মাঝে ভিনদেশে ভিন্ন সংস্কৃতিতে থেকেও সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভে মুসলমানদের সংযম—এ কিন্তু কম পাওয়া নয়। ভোররাতে উঠে সাহরি করা, নামাজ পড়া, ইফতারের আয়োজন, তারাবি কোনো কিছুরই কমতি নেই এই প্রবাসে। পূর্ণ আমেজে পবিত্র রমজান মাস অতিবাহিত হয় প্রবাসীদের। যারা বিকেলের শিফটে কাজ করেন, তাদের অনেকেই খানিক পারিবারিক আবহে ইফতার করার জন্য দেরিতে কাজে যান। কিংবা কাজে থাকলেও সময় করে বাড়ি ফিরে আসেন পরিবারের সঙ্গে একত্রে ইফতার করবেন বলে।
প্রায় পরিবারেই দেশের মতো স্টাইলে ছোলা বুট, পেঁয়াজি, বেগুনি, আলুর চপ, মুড়ি, জিলাপি, শরবতসহ নানান আয়োজন থাকে। তবে এখন অনেক রোজাদারই স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা ভেবে ইফতারে ভিন্নতা আনেন। যেমন আমার প্রায় আশি বছর বয়েসি শাশুড়ি দিনভর রোজা আর ইবাদত শেষে ইফতারে কোনো ভাজাপোড়া খেতে রাজি নন। পাকা পেঁপে, খেজুর, ইসবগুলের ভুসির শরবত, চিড়া-দই এসব দিয়ে খাবারের মেনু সাজাতে হয়। আবার দেশে থাকতে সাহরিতে খাবারের শেষে আম-দুধ দিয়ে অল্প পরিমাণ ভাত না খেলে যেমন কিছুই খাইনি মনে হতো, এখানেও ঠিক তাই। অন্য খাবার খেতে ইচ্ছে হোক, কিংবা না হোক, শেষরাতের দিকে কলা-দুধ, কিংবা আম-দুধ দিয়ে ভাত খাওয়াটাকেই বেশি তৃপ্তিদায়ক মনে হয়ে। শুধু মাইকে, ঘণ্টা বাজিয়ে কিংবা পাড়ার ছেলেরা গজল গেয়ে সাহরি খেতে ডেকে তোলাটা মিস করি এই প্রবাসে। দেশীয় আমেজে পুরো রমজান মাস কেটে গেলেও মনে হয়, কী যেন নেই, কী যেন খুঁজে ফিরি এই দূরের দেশে।