ফিরিয়ে দাও চিঠি, লও এই ইমেইল

মনে পড়ে সেই সময়ের কথা যখন আমরা চিঠি লিখতাম? তখন মুঠোফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট তো ছিলই না, সবার বাড়িতে ল্যান্ডফোনও ছিল না।
সেই সব দিনে কেউ খবর দিয়ে বেড়াতে আসত না। হয়তো একটানা কয়েক দিন বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে। বাতাস লাগাতে লেপ–তোশক, আলু–পেঁয়াজ সব বাইরে মেলে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় এক গাড়ি মেহমান এসে হাজির। লুকোছাপা, ভান ভণিতা, লোক দেখানো গোছগাছের কোনো সুযোগই ছিল না সেই সব দিনে। মানুষের জীবন যেমন ছিল তেমনই দেখা যেত। মেহমান এসেছেন অথচ ঘরে চায়ের চিনি নেই, বিস্কুট নেই। শুরু হতো মেহমান আপ্যায়নের চেষ্টায় ছোটাছুটি। রাস্তার মোড়ের একমাত্র মুদির দোকানে গোলাপি মোড়কের গ্লুকোজ বিস্কুটের একটা প্যাকেটও পাওয়া যেত না সব সময়। কী আর করা, চাক চাক করে আলু কেটে হলুদ লবণ মাখিয়ে ডুবো তেলে মচমচে করে ভেজে তুলে মেহমানকে চায়ের সঙ্গে খেতে দেওয়া হতো। পরে বিলেতে এসে দেখি, এর নাম ‘পটেটো চিপস’।
সেই সব দিনে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। আমাদের বাড়ি ছিল সিলেটের খাদিম নগরে, মাত্র ৬/৭ মাইল দূরে থাকত আমার সেই সময়ের প্রিয় বন্ধু রুবা। রোজা অথবা গ্রীষ্মের লম্বা ছুটির দিনগুলোতে আমরা পরস্পরকে চিঠি লিখতাম। একটা চিঠি পোস্ট করে সেটা পৌঁছার ও উত্তর আসার প্রতীক্ষায় দিন গোনা, ডাক পিয়নের সাইকেলের টুং টাং শব্দে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া। সেই উত্তেজনা আর আনন্দ কি এক সহস্র ফোনকলের মধ্যেও পাওয়া যাবে?
আমাদের জরুরি কোনো কথা ছিল না। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টিলা, বাড়ির রং রূপের পরিবর্তনের কথা আমি রুবাকে লিখতাম। বনে ফোটা নাম না জানা কোনো ফুলের ঘ্রাণ, কচি পাতার নানান ঘনত্বের সবুজের বর্ণনা দিতাম। রুবা সেই সব আঁতলামো চিঠির জন্য পথ চেয়ে থাকত। একবার তাকে ছড়ার ছন্দে চিঠি লিখলাম—
‘ও সখী তুই শহর থেকে আজও এলি না।
ফাগুন এল বনে বনে খবর পেলি না।’
সেই চিঠি পেয়েও যখন সে এল না, তখন আবার লিখলাম—
‘সখী তোকে কত করে আসতে দিলাম লিখে
এলি না তুই, দেখলি না রে বাসন্তী রূপটিকে’
ছড়া-চিঠিগুলো সেই সময় আঞ্চলিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, সব পেপার কাটিং এক সময় হারিয়ে গেছে।
চিঠির সীমাহীন ক্ষমতা টের পেলাম একবার। আমি তখন সবেমাত্র মানবিক বিভাগ থেকে দুটো বিষয়ে লেটার ও ফার্স্ট ডিভিশন মার্কসহ এসএসসি ফেল করে আত্মহত্যার নানান পন্থা খুঁজছি। আমার অসহনীয় মানসিক কষ্ট এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত আমার মা-বাবা পরিচিতজনদের কাছে নানানভাবে আমার এই ব্যর্থতার অবিশ্বাস্য প্রমাণের চেষ্টা করছেন। পরিবারের মধ্যে একমাত্র মানুষ যার সঙ্গে আমি প্রাণ খুলে কথা বলতে পারতাম, সেই চার বছরের বড় ভাই তখন ব্যবসা বোঝার জন্য চিটাগাং থাকত। আমাকে বুঝবার মতো কেউ আশপাশে ছিল না। এমন সময় ভাইয়ের নামে একটা চিঠি এল। খামের ওপর হাতের লেখা দেখেই বুঝলাম, তার বন্ধু চপল ভাইয়ের চিঠি। চপল ভাই একসময় আমাদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়তেন, পরে বাবার বদলির কারণে অন্য জেলায় চলে যান।
খামের মুখ অর্ধেকটা খোলা থাকায় খুলেই ফেললাম চিঠিটা। খোলার পর মনে হলো অন্যায় করিনি, কারণ চিঠির বিষয়বস্তু ছিল একটাই- ‘রোজীর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল কী?’
আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাইয়ের বন্ধু, যার সঙ্গে আমার তেমন কোনো কথাবার্তা ছিল না কখনোই, একটা চিঠি লিখেছে শুধু আমার পরীক্ষার ফলাফল জানতে? আবেগে মন ভিজে গেল। আমিই ভাইয়ের পক্ষ থেকে উত্তর লিখতে বসলাম। উত্তরটা হলো কয়েক পৃষ্ঠা লম্বা। এ পর্যন্ত মনের যে কথাগুলো কাউকে বলতে পারিনি, সব তাকে লিখলাম। আস্ত দুটো কামরাঙা মরিচ চিবিয়ে খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছি, তাও লিখলাম।
এক সপ্তাহের মধ্যেই উত্তর এল। এই প্রথম কোনো পুরুষের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম, যা প্রেমপত্র ছিল না। মানুষটার জীবনবোধ ছিল অসাধারণ, অন্যের কষ্ট বুঝবার ক্ষমতা সীমাহীন। তার চিঠি পড়ে আমার আত্মহত্যা করার ইচ্ছা উবে গেল। (ইতিমধ্যে আরও দুটি দুর্বল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।) আবার নতুন করে শুরু করার অনুপ্রেরণা পেলাম। একবার পরীক্ষায় ফেল করাই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, তা বুঝতে পারলাম।
তারপর শুরু হলো নিয়মিত চিঠির আদান–প্রদান। প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়, ন্যাকামি নয়। শুধু ভাবনা বিনিময়। আমি তাকে লিখতাম আমাদের টিলাবাড়ির প্রকৃতির বর্ণনা আর ঋতুচক্র নিয়ে লেখা আমার ছেলেমানুষী কবিতা। তিনি লিখতেন তাঁর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতার কথা, নতুন পড়া কোনো বইয়ের কথা। একসময় ডাকযোগে তিনি আমাকে তার পছন্দের বইও পাঠাতে শুরু করলেন। তার কল্যাণেই পড়লাম সুনীলের ‘সেই সময়’, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ, জয়নাব আল গাজ্জালির ‘কারাগারের রাতদিন’, আল মাহমুদের ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’, আসকার ইবনে শাইখের ‘কালো রাত তারার ফুল’। আরও অনেক বই যেগুলোর নাম এখন ভুলে গেছি।
চপল ভাইয়ের নিজের সংগ্রহ ‘সন্ধানী’ থেকে বেছে বেছে তিনি আমাকে বই পাঠাতেন। আমি তাকে আমার পুস্তক সংগ্রহের শখের কথা লিখলে তিনি আমার সংগ্রহের নাম দিলেন ‘অপরাজিতা’। নামটা আমার খুব পছন্দ হলো। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি অসংখ্যবার পড়ার পর আমি তখন ‘অপরাজিতা’ পড়ছি। আমার শোয়ার ঘরের পেছনে একটা অপরাজিতার লতা ফুলে ফুলে নীল হয়ে গিয়ে আলো ছড়াত। আমি এসব নিয়ে আমার অনুভূতির কথা তাকে লিখতাম। একদিন তিনি লিখলেন, ‘তোমার বর্ণনা শুনে মনে হয়, তোমাদের বাড়িটা আমেরিকার হোয়াইট হাউস থেকেও সুন্দর। আমি তো তোমাদের বাড়িতে বহুবার গেছি, কিন্তু এমন করে তো দেখিনি। তোমার দেখার চোখ অনন্য।’
পরের বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলাম। সামাজিক অনেক ট্যাবুর বিপরীতে এই কঠিন কাজটিতে সফল হতে দূরে থেকে চিঠি মারফত প্রতি পদে পদে আমার পাশে ছিলেন চপল ভাই। এসএসসি পাশ করার কিছুদিন পরই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন—
‘চপলের লেখা চিঠিগুলো কোথায়?’
‘আমার টেবিলের ড্রয়ারে।’
‘ওগুলো ছিঁড়ে ফেলে দাও।’
‘কেন আব্বা?’ আমি মিনমিনিয়ে জানা উত্তরটাই আবার শুনতে চাই।
‘তোমাদের যোগাযোগের সৌন্দর্য সবাই বুঝবে না।’
আব্বার কথা খুব একটা অমান্য করিনি কখনো, এই আদেশটাও নীরবে পালন করলাম। একটা অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্যমণ্ডিত যোগযোগের সব চিহ্ন কুটিকুটি করে ধ্বংস করে জীবনের দুর্লভ সব সৌন্দর্য বুঝতে অক্ষম বলে বিবেচিত কিছু মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে চলে গেলাম। এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বোধ হয় কেউ খুব একটা ভাবে না। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বিষয়গুলোকে যারা মেনে নিতে পারবে না বলে সন্দেহ করা হয়, আল্লাহর নামে কবুল পড়ে তাদেরই সঙ্গে সুন্দর জীবন গড়তে যাওয়া যে কতটা বোকামি তা কয়জন বোঝে?
সে যা-ই হোক, চপল ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ধীরে ধীরে পুরোই বন্ধ হয়ে গেল। আমি বিয়ের পর যুক্তরাজ্যে চলে এলাম, এবার শুরু হলো আব্বার সঙ্গে আমার চিঠি যুদ্ধ। আমি আব্বাকে লিখতাম ব্রিটিশদের অধঃপতনের কথা, আমার জীবনের সৌন্দর্যহীনতার কথা। আর আব্বা আমাকে বোঝাতেন ব্রিটিশ জীবনের সৌন্দর্য বুঝতে আমার অক্ষমতার কথা। আমাদের এই লড়াই অমীমাংসিত রেখেই সময় বদলে গেল। চিঠি হারিয়ে গিয়ে এল সস্তা কলরেট, মোবাইল ফোন, ইমেইল—আরও কত কী!
কয়েক বছর আগে ফেসবুকের কল্যাণে আবার চপল ভাইকে খুঁজে পেলাম। তিনি এখন একেবারে অন্য মানুষ। দুজনের চিন্তাভাবনায়, মনমানসিকতায়, আদর্শগত অবস্থানে এখন আকাশ-পাতাল দূরত্ব। কিন্তু তবু ২০ বছর পরের এই খুঁজে পাওয়া দুজনের জন্যই ছিল ভীষণ আনন্দের। আমি বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় তার বাসায় বেড়াতে গেলাম। ভাবি এবং তার বাচ্চাদের সঙ্গে পরিচয় হলো, আগে না বলা অনেক কথা জানা হলো।
চপল ভাইয়ের একটি কথা শুনে ভীষণ মজা পেলাম। আমাদের পত্র যোগাযোগের সময়টায় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন। সেই সময়ে বিনোদনের তেমন একটা ব্যবস্থা ছিল না। আমার সাপ্তাহিক চিঠিখানা নাকি হলের ছেলেদের জন্য অপার আনন্দ বয়ে আনত। তিনি একা নন, তার হলের অনেক ছেলেই নাকি পথ চেয়ে থাকত—কবে চিঠি আসবে? কয়েক শ মাইল দূর থেকে আসা একটা গ্রাম্য কিশোরী মেয়ের প্রকৃতির বর্ণনা কিছু যুবককে এতটা আনন্দ দিতে পারে, ভাবা যায়? চিঠি এলে নাকি কাড়াকাড়ি পড়ে যেত, কে সেটা আগে পড়বে। কেউ একজন ডেস্কের ওপরে দাঁড়িয়ে চিঠিটা জোরে জোরে পড়ত, বাকিরা শুনত। চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেলে তারা কষ্ট পেয়েছিল, এবং একপর্যায়ে চিঠির পুরো বান্ডিলটাই নাকি কেউ চপল ভাইয়ের ড্রয়ার থেকে চুরি করে নিয়ে যায়।
এখন আর চিঠি পেতে ভালো লাগে না, লেটারবক্সে শব্দ শুনলে আঁতকে উঠি। এখন চিঠি মানেই গ্যাস বিল, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, পেমেন্ট রিমাইন্ডার। কিছুদিন আগে দেশে বেড়াতে গিয়ে আমাদের গ্রামের পুরোনো পিয়নের সঙ্গে দেখা, সাইকেলের টুংটাং শব্দে স্বপ্ন সৃষ্টিকারী সেই মানুষটা এখন সিলেট শহরে একটি ব্যাংকের ডোর-কিপার। আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘মনে আছে আপা, আপনে কত ছোট আছিলেন, কিন্তু পরতেক সপ্তাহে চিঠি আসত আপনের নামে?’
আজকের চিঠিহীন জীবনে চিঠিময় সেই দিনগুলোর স্মৃতি আমাকে হাসায়, আবার কাঁদায়ও। প্রায়ই বলতে ইচ্ছে করে- ফিরিয়ে দাও চিঠি, লও এই ইমেইল।
(*চপল নামটা কাল্পনিক। রোজী আমার ডাকনাম।)