নীলিমার ঈদ

মাকে বলতে পারল না কখন নিউইয়র্কে আসতে পারবে। টেস্ট শেষ কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্সের প্রজেক্টগুলো এখনো বাকি। ‘ঈদের দিন আসার চিন্তা বাদ দাও আম্মু’, মাকে ফোন করে বলে দিল। আর কথা বাড়াতে চাইল না। আগে অনেক সময় নিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলত। এখন মুহূর্তেরও সময় নেই। টেলিফোন করলে হয় ক্লাসে, না হয় লাইব্রেরিতে বা হোমওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত। এখানকার সিস্টেম ওদেরকে রোবট বানিয়ে ফেলেছে। তবে সেও কি তার ভাইদের মতো হয়ে যাচ্ছে! না কখনো না। সময় পেলেই তো ফেইসটাইমে কথা বলে অনেকক্ষণ। বাবাকেও ফোন করে সুযোগ পেলেই।
ঈদের দিন সোজা ড্রাইভ করে তাঁরা মেয়ের ডরমে (হল) গিয়ে হাজির হবেন। সে রকমই ভাবছিলেন নীলিমা। স্বামীকে বলেছিলেন, ‘ঈদের নামাজ শেষে দেরি করবে না, আমরা মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে চলে যাব সেদিন। সে যা যা পছন্দ করে, তা-ই রান্না করে রাখব কনটেইনারে।’ মনে হচ্ছে কত দিন হলো মেয়েটাকে দেখছেন না। দেড় মাস আগে এক সপ্তাহের জন্য উইন্টার ভ্যাকেশনে এসেছিল। তখন বলেছে, এই সেমিস্টার শেষ হলে ডরম ছেড়ে দেবে। পরের সেমিস্টারের জন্য চার বান্ধবী মিলে চমৎকার অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। ডরম বেশি ব্যয়বহুল। বছরে প্রায় চৌদ্দ হাজার ডলার শুধু থাকার জন্যই চলে যায়। যে স্কলারশিপ পায়, তা দিয়ে টিউশন ও থাকা-খাওয়া পুরোপুরি কুলোয় না। যদিও প্রতি সপ্তাহে ইউনিভার্সিটিতে স্টাডি প্রোগ্রামে আলাদা কিছু আয় করছে।
নীলিমার মন খুব খারাপ হয়ে যায় মেয়েটির কথা ভেবে। সারা দিন পড়া আর কাজ। এই এতটুকু মেয়ের পক্ষে কি এত পরিশ্রম সম্ভব? স্বামীর ওপর ক্ষেপে যান। সবাই কত ইজি সাবজেক্ট নিয়ে পাস করে বের হচ্ছে। অথচ তাদের ছেলেমেয়েদের ওপর এই অস্বাভাবিক পড়াশোনার চাপ। সবাইকে জজ-ব্যারিস্টার হতে হবে কেন? সেই জুনিয়র স্কুল থেকে মেয়েটির ওপর পড়ার চাপ প্রতিদিন বাড়ছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলে উপোস থাকতে থাকতে অ্যাসিড রিফ্লেক্স হয়ে গেছে। স্কুলের লাঞ্চ খাবে না। বাসা থেকে কিছু নিয়ে গেলেও ফিরিয়ে আনবে। অন্যদের না দিয়ে ঘর থেকে নেওয়া লাঞ্চ খেতে তার নাকি সংকোচ হয়। প্রতিদিন এমনই করে। নীলিমার রাগে মেজাজ বিগড়ে যায়। বাংলাদেশি কোনো খাবারই এখন খেতে পারে না। মায়ের যত জ্বালা।
কত করে বলেছেন, নিউইয়র্ক সিটিতে এত ভালো কলেজ থাকতে কেন বাইরে যেতে হবে তাদের? একই উত্তর, ‘ভাইদের অন্য স্টেটে যেতে দিয়েছ, আমার বেলায় ডিসক্রিমিনেশন কেন করবে আম্মু? ছোট ভাই তো একেবারে ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছে।’ আর উনি উইসকনসিন-মেডিসন, অ্যারিজোনা অথবা লস অ্যাঞ্জেলেসে যাবেন। অনেক কষ্টে বুঝিয়েছেন।
নীলিমার স্বামী তাই বুদ্ধি করে মেয়েকে তিন-চার ঘণ্টা ড্রাইভিং রেঞ্জের ভেতরে একটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সম্মতি দিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। ইচ্ছে হলেই ড্রাইভ করে মেয়ের কাছে চলে যেতে পারবেন—এই একটা দারুণ সুবিধা। একবার ভেবেছিলেন বাফেলো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে রাজি হয়ে যাবেন। ভাগ্য ভালো, প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য মেয়ে নিজেই মন বদলেছে। স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনেক সুবিধা। কোনো কারণে স্কলারশিপ না থাকলেও নিজের স্টেট হওয়ায় অর্ধেক টিউশন ফি দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যাবে। প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসবের ধার ধারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় ফুল স্কলারশিপ, না হয় ফুল পেমেন্ট। আয় অনুপাতে প্যারেন্টস কন্ট্রিবিউশন তো বাধ্যতামূলক। তাই ওর ভাইদের ব্যাপারে ভয়ে ভয়ে ছিলেন তাদের বাবা। স্টুডেন্ট লোনের ফাঁদে সন্তানদের তিনি পড়তে দিতে চাননি। শুরুতেই ওদের ওপর পড়ার ভীষণ চাপ রেখেছিলেন। ভালো স্কুলে যেতে হবে। স্কলারশিপ পেতেই হবে, যে যাই বলুক।
নীলিমা এসব হিসাব বোঝেন না; বুঝতে চান না। যেটা বুঝতে পেরেছেন, এখন ছেলেরা অনেক দূরে থাকে। আসা-যাওয়া প্লেন জার্নি দশ-বারো ঘণ্টার বেশি। লম্বা ছুটি না হলে ওরা আসবে না। থ্যাংকসগিভিং, আর ক্রিসমাস ছুটিতেও আসার নিশ্চয়তা নেই। অন্য সময় সারপ্রাইজ ভিজিট। এবার ঈদেও আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্তত মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঈদের দিনটা কাটাতে পারবেন ভেবেছেন। সেই আশায় এখন গুঁড়েবালি।
ওরা যখন ছোট ছিল, আর কিছু না হোক ঘরে থাকলেও কত আনন্দ লাগত। সব যেন কেমন হয়ে গেল কয়েক বছরের ব্যবধানে। মনে মনে ভাবেন, ছেলেদের কাছে উড়ে গেলে কেমন হয়? স্বামীকে বলবেন নাকি। কিন্তু দুজন থাকে দুই জায়গায়, লস অ্যাঞ্জেলেস আর সিয়াটল। নীলিমার মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। নিরুপায় তিনি।
এখন ভাবছেন ঈদের দিন মেয়ের প্রজেক্ট থাকুক আর না থাকুক, তারপরও যাবেন তার কাছে। না হয় ঘণ্টাখানেক মেয়ের সঙ্গে থেকে নিউইয়র্কে ফিরে আসবেন। বিশাল ক্যাম্পাসটা ঘুরে ঘুরে আবারও দেখবেন। পড়ন্ত বিকেলে ফাউন্টেনের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন স্টুডেন্টস সেন্টারের সামনে। আগেরবার দেখেছিলেন সুইমিং পুলের পাশে কনসার্ট করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা জড়ো হচ্ছে। মেয়ে অবশ্য বলেছিল, আম্মু কনসার্ট দেখে যাও। স্বামী রাজি হননি। কারণ, প্রায় দেড় শ মাইল ড্রাইভ করে নিউইয়র্কে যেতে হবে। অনেক রাত হবে। ইদানীং মেয়েকে ড্রপ করে ফিরতি পথে প্রায়ই ওয়ালমার্ট থেকে কিছু শপিং করে নিয়ে আসেন। ইউনিভার্সিটির কাছে আমেরিকার সবচেয়ে বড় ওয়ালমার্ট। জিনিসপত্র অনেক সস্তা।
দুদিন পর আবার না হয় ফিরে গেলেন মেয়েকে আনতে। স্বামীকে বলতে গেলেন প্ল্যানটি। ‘তোমার মাথা খারাপ! জানো না মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে। কোলনোস্কপি করতে হবে আমার। সেই তিন-চার মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এখন মিস করা যাবে না। শরীর অনেক দুর্বল থাকবে দু-এক দিন। লম্বা ড্রাইভিং করা উচিত হবে না।’ মেয়ের বাবার কথা শুনে নীলিমা আরও হতাশ হয়ে পড়েন।
এখন তো মনে হচ্ছে ঈদ আর করা লাগবে না। স্বামীকে নিয়ে ঈদের দিন, অথবা আগের দিন তাদের হাসপাতালে কাটবে; এবং তা-ই হলো।
‘কেন? এই অ্যাপয়েন্টমেন্টটি চেঞ্জ করা গেল না!’ স্বামীকে চার্জ করলেন। স্বামী কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি ভাবলেন, ‘উলুবনে মুক্তো ছড়ানো, কোনো লাভ নেই। ঈদের দুদিন পরই ডরম থেকে মেয়েকে নিয়ে আসা যাবে। এ এমন আরকি। তাড়াহুড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।’
নীলিমার স্বামীকে কতক্ষণ আগে কোলনোস্কপির জন্য নার্স ভেতরে নিয়ে গেছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি মনে হয়। খুব ভোরে বেলভিউ হাসপাতালে আসতে হয়েছে তাঁদের, ঠিক অ্যাপয়েন্টমেন্টের এক ঘণ্টা আগে। দেবর নামিয়ে দিয়ে গেলেন গাড়ি পার্ক খুঁজতে। তিনি একা ওয়েটিং রুমে বসে সময় পার করছিলেন। পাশে দুজন স্প্যানিশ মহিলা বসে আছে। কখন যে রাজ্যের ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন।
প্রায় তিন দশক ধরে আমেরিকায়। বছরগুলো এত দ্রুত কিভাবে চলে গেল! বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই তো সেদিন এসেছিলেন মনে হয়। খিলগাঁওয়ে ভাড়া করা বাসায় থাকতেন তাঁরা। বাবার বাড়ির কাছাকাছি। বাবাও তখন বেঁচেছিলেন। স্বামী বিআইডব্লিউটিএতে চাকরি করতেন। সকাল সাড়ে সাতটায় মতিঝিল অফিসে যেতেন। বিকেল চারটার আগেই অফিসের মাইক্রোবাস নামিয়ে দিয়ে যেত। কোনো টেনশন নেই। স্বামী এসেই খাওয়ার পর একটু ন্যাপ নিতেন। নতুন সংসার। কখনো সন্ধ্যায় স্বামীর সঙ্গে বেরোতেন। একদিন সন্ধ্যায় লালমাটিয়া বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেয়ে ফিরতে দেরি করে ফেলেছিলেন তাঁরা। স্বামীর বন্ধু ও ভাবির অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে সম্ভবত ‘সকাল সন্ধ্যা’ না ‘শুকতারা’ নাটকটি একসঙ্গেই দেখে ফিরলেন রাত সাড়ে এগারোটায়। কল্পনায় আসেনি বাসায় কী অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য। তখন শাহজাহানপুরের বাসায় থাকতেন। এসে দেখেন মেইন ডোর খোলা। বিয়ের গহনাপাতি, শাড়ি-সব দরজা ভেঙে নিয়ে গেছে চোর। সেদিন সে কী কান্না! বিয়ের স্মৃতিগুলো, বিশেষ করে মায়ের হাতের বালার জন্য মনটা ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। স্বামী সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করো না এই সামান্য জিনিসপত্রের জন্য। আমার মায়ের অলংকারগুলোও তাঁদের বিয়ের কিছুদিন পর চুরি হয়ে গিয়েছিল।’
‘বাংলাদেশে আমরা সারভাইব করতে পারব না, চোর বাটপারে ভরে গেছে পুরো দেশটা। চাকরি ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাব। সেখানেই ভাগ্যকে গড়ে তুলব’, মনে আছে মায়ের হাতের বালাকে সামান্য বলায় খুব কেঁদে ছিলেন সেদিন।
জীবনযুদ্ধের এত বছর পর হিসেব কষছেন সেদিনের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল কিনা অথবা তাঁদের গন্তব্য আসলে কোথায়? নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস না সিয়াটল। তবে এটা নিশ্চিত যে আগামীকাল ঈদ উদ্‌যাপন করবেন একাই। কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি তিনি।