কুসুম কুসুম ভালোবাসা

ভোরের আকাশ ফরসা হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে যায় আসিফের। অদূরে নদীর জলে জেলেদের নৌকার ছলাৎ ছলাৎ বইঠার শব্দ পরিষ্কার ভেসে আসছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো হয়তো এখনো যাত্রীদের অপেক্ষায়; তাই যাত্রাভঙ্গের নীরবতা।
আজকের দিনটা মনে হচ্ছে একটা বিশেষ দিন আসিফের কাছে। কারণ, এ প্রথমবার সুজানা একটা নোট বই চেয়েছে তার কাছে। বলেছে, সুজানাদের বাসায় যেন বইটা নিয়ে আসে সে। তাই আসিফের যেন তর সইছে না। রাতেই নোট বইটা ঝেড়ে-মুছে রেখে দিয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষায়। সে কখন যাবে, সুজানাকে নোটটা পৌঁছে দিতে। ঠিক করেছে বিকেলেই যাবে। ছুটির দিনে কারও বাসায় সকাল কিংবা দুপুরে যাওয়া যাবে না। আজকের সকালটা যেন অনেক লম্বা মনে হচ্ছে আসিফের কাছে। এখন শুধু ভাবছে। সে ভাবছে, পুরো সকালটা সূর্যের তাপ পোহাতে পোহাতে কাটিয়ে দেবে। হয়তো এই সকালটাই শেষ সকাল হবে। কারণ, এত ভোরে আসিফের ঘুম ভাঙে না কখনো।
তাই সে আজ সূর্যটা দেখতে চায়। ছাদে উঠে দেখে বেশ কুয়াশা পড়েছে। আশপাশের লাইটগুলো এখনো জ্বলছে। কুয়াশাতে লাইটগুলো কেমন বিবর্ণ দেখাচ্ছে। ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে ভালোই লাগছিল তার। এখন ভাবছে, সুরমা নদীর বাঁক থেকে সূর্যোদয় দেখবে। আসিফ তাকিয়ে দেখে, পুব আকাশ রাঙা করে সূর্য উঁকি দিয়েছে। কিন্তু সামনের বাঁশঝাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে সূর্যটা।
নদীর বাঁকে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবছে, সুজানা নোট বই চেয়েছে তো কী হয়েছে? সহপাঠী তো সহপাঠীর কাছে বই চাওয়াই স্বাভাবিক। তাতে এত প্রেম প্রেম ভেবে নিজেকে কেন বিচলিত করছে সে? অবশ্য কেনইবা ভাববে না; বাংলা সাহিত্যের স্যার যখন শরৎ চন্দ্রের ‘দেবদাস’ পড়াতেন, তখন তো মনে হতো সুজানা যেন পার্বতীর ভূমিকায় থেকে দেবদাসরূপী আসিফকে দেখছে।
মফস্বল শহরে একটিমাত্র কলেজ ছিল তখন। তাই ছাত্র-ছাত্রীরা যৌথভাবে একই শ্রেণিকক্ষে বসার নিয়ম ছিল। বলতে গেলে এ সুবাদে আসিফ সুজানার পরিচয়টা একটু গাঢ় হয়েছিল। তাই বলে এটাকে প্রেমের পর্যায়ে নেওয়া যাবে না। সুজানা কখনো এমন কোনো ইঙ্গিত করেনি, যাকে প্রেম-ভালোবাসার পর্যায়ে নেওয়া যায়। তখনকার দিনে প্রেম-ভালোবাসার কথা মুখে আনাও বিরাট লজ্জার ব্যাপার ছিল। তখনকার যুগটাই ছিল খ্যাত মার্কা। আর এ যুগের কলেজপড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের কথাই আলাদা। ওরা একে অন্যের সাথে তুই-তোকারি করে কথা বলে, একসঙ্গে বসে আড্ডা মারে, হই হুল্লোড় করে, মাঝেমধ্যে নেশা করে ফোনে কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলতে মোটেই দ্বিধা করে না। প্রেমের যবনিকা টানতেও কোনো ঝক্কিঝামেলা নেই। এরপরও একে অন্যের বন্ধু।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আসিফ তৈরি হয়ে সুজানাদের বাসা অভিমুখে যাত্রা করে। একটা রিকশা ডেকে পায়ের ওপর পা তুলে একটু ডাটে বসে রিকশাওয়ালাকে যাওয়ার নির্দেশ দিল। ছোট মফস্বল শহরে সবাই একে অন্যকে চেনে। তাই সুজানাদের বাসা আসিফের চেনা-জানা। বাসার সামনের কাঠের গেট খুলে সামনের দরজার কলিংবেলটা আস্তে টিপল। বোঝা গেল বেলটা বাজেনি। কারণ, আসিফের হাতটা মৃদু কাঁপছিল। দ্বিতীয়বার বেল টিপতেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে দাঁড়ালেন; সম্ভ্রান্ত দর্শন। আসিফ সালাম দিয়ে সুজানার খবর জানতে চাইল। ভদ্রমহিলা ইশারায় আসিফকে ভেতরে আসতে বলে সুজানাকে ডাকতে ডাকতে ভেতরে গেলেন। আসিফ ধরে নিল মহিলা সুজানার মা হবেন, মানে খালাম্মা। আসিফ বসার ঘরে প্রবেশ করে দেয়ালে ঝোলানো কিছু ছবি দেখল। হঠাৎ কখন যে সুজানা এসে আসিফের পাশে দাঁড়িয়েছে, তা টেরই পায়নি সে।
আসিফ ঘুরে দাঁড়াতেই দুজন মুখোমুখি। সুজানা আজ শাড়ি পরেছে, সবুজ শাড়ি, কমলা পাড়; সঙ্গে কমলা ব্লাউজ। দারুণ দেখাচ্ছে তাকে। আসিফ আর সুজানা সামনাসামনি বসে; কিন্তু কারও মুখে কোনো কথা ফুটছে না। চুপচাপ বসে থেকে ডাইনিং স্পেসে রাখা ফ্রিজের শব্দটাও কানে আসছে।
ফাগুনের মাঝামাঝি তেমন গরম নয়; কিন্তু আসিফ ঘামছে। ইতিমধ্যে সুজানার মা এসে নীরবতা ভাঙলেন। আসিফের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন—কয় ভাইবোন, বাবা কী করেন ইত্যাদি। সুজানারা বাবার চাকরির সুবাদে প্রায় দু বছর হয় এই মফস্বল শহরে বাস করছে। তাই সুজানার মা শহরের সবাইকে চেনেন না। সুজানা চায়ের সাথে টোস্ট বিস্কুট নিয়ে আসিফকে খেতে দিল। আসিফ একটা টোস্ট হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দেবে, অমনি সুজানার মা আসিফের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘আচ্ছা বল তো ফাউন্টেনপেন-এর বাংলা কী?’ আসিফ উত্তরটা জানে; তবুও নীরব থেকে সুজানার দিকে তাকাল। সুজানাও মায়ের এমন প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আসিফই উত্তরটা বলে দিল, ‘ফাউন্টেনপেন মানে ঝর্না কলম।’
খালাম্মা অর্থাৎ সুজানার মা অসিফের উত্তরটা শুনে মনে হলো খুবই খুশি হয়েছেন। বারবার আসিফকে বলছেন বাসায় আসতে। এতক্ষণে মনে হলো সুজানা কিছুটা জড়তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। মা আর আসিফের কথার মাঝে সেও ফোড়ন কাটছে মাঝেমধ্যে। অনেক গল্পের ফুলঝুরিতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল টেরই পাওয়া গেল না। আসিফ একসময় উঠে দাঁড়াল বাসায় ফিরবে বলে।
সে দিন রাতে আসিফ একদমই ঘুমাতে পারেনি, শুধু এপাশ-ওপাশ করে পুরোটা রাত পার করে দিয়েছে। এভাবে চলতে লাগল দিনগুলো। সুজানাদের বাসায় আসিফের যাওয়া-আসা দিন দিন বাড়তে লাগল। একদিন ঘটে গেল এক মজার ঘটনা। এত দিনের যাওয়া-আসায় কখনো সুজানার বাবার দেখা পায়নি আসিফ। তাই তাঁর সঙ্গে পরিচয়ও হয়নি। ওই দিন সন্ধ্যার পরপরই আসিফ সুজানাদের বাসায় হাজির। সুজানার পড়ার টেবিলে দুজন বসে গল্প করছে। হঠাৎ সুজানার বাবা কবির সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে বাসায় ফিরলেন।
আসিফকে দেখে মনে হলো কিছুটা বিব্রত হলেন। সুজানার মা তখন বাসায় নেই। কবির সাহেব সুজানাকে একটু চড়া গলায় ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার চাকুটা কোথায় বলতে পারিস মা?’ চাকুর কথায় কিছু ভয়, আর কিছু বিস্ময়ে ভরে ওঠে আসিফের মন। বাবার এমন আচরণে সুজানা অনেকটা বিরক্ত হলো মনে হলো। তারপরেও বাবার চাকুটা খুঁজে এনে দিল। চাকু হাতে পেয়েই তিনি কাজে লেগে গেলেন। কাজ বলতে অনেকগুলো কাগজ ভাঁজ করে খাতার মতো সাইজ করে অফিসের কাজে ব্যবহার উপযোগী করতে লাগলেন।
আসিফ ভেবে পায় না মানুষের মনের মতো রহস্যময় ব্যাপার দুনিয়াতে আর কী হতে পারে! এই কবির সাহেব, মানে সুজানার বাবা প্রথম দেখায় আসিফের সাথে মন খুলে বন্ধুর মতো দুটো মিষ্টি কথা বললে এমন কী হতো? আমলারা বুঝি এ রকমই হয়।
দীর্ঘদিন হলো আসিফ আর সুজানাদের বাসায় যায়নি। কলেজে দেখা হলে একে অন্যকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে; তাও সবার অগোচরে। তখন তো মুঠোফোনের যুগ ছিল না। চিঠিপত্র আদানপ্রদানেরও সাহস গড়ে ওঠেনি। না হলে সুজানা হয়তো চিঠির মাধ্যমে সবকিছু প্রকাশ করতে পারত। আসিফ ভেবে কুল পায় না এখন তার কী করা উচিত। রাত-বিরাতে সুজানার মুখ ভেসে ওঠে তার মনের একান্তে। এক ফোটা ঘুম আসে না চোখে। সুজানার অবস্থাও হয়তো তা-ই। বিকেলে খেলতে যাওয়া দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আসিফ এখনো মাঠে যায় ঠিকই। কিন্তু মাঠের এক কোণে দর্শকের সারিতে বসে থাকে। এভাবেই দিন কাটতে থাকে। একদিন ডাক পিয়ন একটা চিঠি দিয়ে যায় আসিফের হাতে। চিঠি পেয়ে অবাক হয় আসিফ। দেখে, খামের ওপর মেয়েলি হাতের লেখায় তারই নাম। আসিফের চোখে-মুখে আনন্দের জোয়ার। সে বুঝে গেল চিঠিটা সুজানাই লিখেছে।
আসিফ তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর অতি যত্নে চিঠিটা পড়তে লাগল। সুজানা চিঠিতে যা লিখেছে, তার জন্য আসিফ কল্পনায়ও প্রস্তুত ছিল না। সুজানা লিখেছে, ‘আসিফ, সেদিন আমার বাবা তোমাকে আমাদের বাসায় দেখে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। এর পর থেকে আব্বা তার চাকরির স্থান পরিবর্তনের জন্য বিভিন্নভাবে তদবির করে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত আব্বার বদলির আদেশ এসেছে। আমরা হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাব। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
এক শ্বাসে চিঠিটা পড়ে নিল আসিফ। বাকি লেখাটুকু না পড়েই চিঠি বন্ধ করে দিল। তারপর নিজে থেকেই বলতে লাগল, ‘কিছু কিছু ভালোবাসা দূর থেকেই উপভোগ করা ভালো।’ শরৎ বাবুর সেই লাইনটা মনে মনে আওড়াতে লাগল আসিফ: ‘খাঁটি প্রেম শুধু কাছেই টানে না, কখনো কখনো দূরেও সরিয়ে দেয়।’