দেশের চেয়েও ভালো ঈদ!

ইসলাম ধর্মের দুটি প্রধান উৎসব, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। রমজান মাসে সংযম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফিতর, সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এক বিশেষ উপহার। ঈদের শুরুটা সম্মিলিত নামাজের মাধ্যমে, যেখানে সবাই মিলিত হয় ভেদাভেদ ভুলে এক সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে নিবেদনে এবং মানবজাতির কল্যাণ কামনায়। নামাজের পর্বটি পর্যন্ত ধর্মীয় আচার মেনে চলা, কিন্তু এর পর সারা দিনের উৎসব আর ধর্মীয় বিধিনিষেধের আওতায় থাকছে না। তা হয়ে ওঠে সংস্কৃতির উৎসব। তাই ঈদের আনন্দ বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন উপায়ে উপভোগ করে। এমনকি সে আনন্দ উৎসব ছড়িয়ে পড়ে অমুসলিমদের মধ্যেও। সে জন্যই বলা হয়, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’
মধ্যপ্রাচ্যে ঈদ উৎসবের প্রধান অঙ্গ নামাজের পর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের একত্রে মিলিত হওয়া এবং বিশেষ খাবার ও উপহার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। শিশু কিশোরদের জন্য চকলেট, খেলনা, এমনকি অর্থও দেওয়া হয়। বাড়ির সামনে বিশাল কার্পেট বিছিয়ে আত্মীয়, প্রতিবেশী ও পথচারী সবাইকে আপ্যায়ন করার ভেতরই তাদের আনন্দ। তুরস্কে তিন দিনব্যাপী সরকারি ছুটিতে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। পাড়ায় পাড়ায় শুভেচ্ছা বিনিময়, কবরস্থানে গিয়ে পরোলোকগতদের জন্য প্রার্থনা, মেলা, মিষ্টি বিতরণ ইত্যাদি জাতীয় ঐতিহ্য ও আচার দিয়ে ঈদ উদ্‌যাপিত হয়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, চীন ইত্যাদি দেশেও নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুসরণে ঈদ উদ্‌যাপিত হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঈদের আয়োজন শুরু হয় রমজানের শেষ দিকে। প্রিয়জনদের জন্য উপহার কেনাকাটা থেকেই এর শুরু। ঈদের আগের রাতে মেহেদি লাগানো, কেনাকাটা ও রান্নার বিশাল আয়োজন চলে। বাংলাদেশে ঈদগাহ ময়দান থেকে উচ্ছলতার শুরু। নতুন পোশাক পরে নামাজ শেষে কোলাকুলি আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো। বড়দের কাছ থেকে ছোটদের ঈদ বকশিশ নেওয়াটা আরেক আনন্দ। সব বাড়ির সব দরজা উন্মুক্ত থাকে সারা দিন; আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু—যে কেউই আমন্ত্রিত। এ ছাড়া বসে নানা রকম মেলা। খুলে দেওয়া হয় পার্ক ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান। অন্তত দু দিন ধরে তো চলেই এ অবাধ আনন্দের স্রোত। এর পর অফিস আদালত শুরু হলেও পরবর্তী সব ছুটির দিনজুড়ে চলে ঈদের আনন্দ ও বেড়ানো। বাংলাদেশ যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, এখানে সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় থাকে। ফলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই ঈদের এ আনন্দযজ্ঞে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
যারা প্রবাসী, তাদের ক্ষেত্রে ঈদের আনন্দ উপভোগে অনেক সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। প্রবাসে তারা ধর্ম ও সংস্কৃতি দুই বিবেচনায়ই সংখ্যালঘু। প্রবাসের জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়, আবার নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিও বিসর্জন দিতে পারে না। বিশেষত ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ফলে প্রবাসের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ঈদ উদ্‌যাপনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা, ঈদের দিন অফিস খোলা থাকা।
অনেকেই চেষ্টা করে নিজের অর্জিত ছুটি থেকে একদিন ঈদের জন্য ব্যয় করতে। যারা পারে না, তাদের ঈদের নামাজ পড়েই কাজে ছুটতে হয়। এ জন্য অনেক স্থানেই খুব সকালে ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় শহরেই মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মসজিদ না থাকলেও অন্য কোনো ব্যবস্থাপনায় বিস্তৃত পরিসরে নামাজের আয়োজন করা হয়। অনেক স্থানে নামাজের সঙ্গেই বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। কোথাও কোথাও স্বল্প পরিসরে মেলার আয়োজনও থাকে, বিশেষত শিশু কিশোরদের জন্য। প্রবাসে আত্মীয়-পরিজন যেহেতু তেমন নেই, তাই বন্ধুরাই ভরসা, যেখানে বয়স বা জাতির কোনো বাধা থাকে না। নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে এর-ওর বাসায় বেড়ানোর মধ্য দিয়ে ঈদ শেষ হয়। কোনো কোনো শহরে দু-একজনের বাসায় ‘ওপেন হাউস’-এর আয়োজন করা হয়, যেখানে ওই শহরের সব মুসলমানদের উন্মুক্ত নিমন্ত্রণ দিয়ে রাখা হয়।
ওপরের চিত্রের ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। নিউইয়র্ক, আটলান্টা, লস অ্যাঞ্জেলেস, টরন্টো, লন্ডন, সিডনির মতো বড় বড় শহরে, যেখানে অভিবাসীর সংখ্যা প্রচুর, সেখানে কিছু কিছু এলাকায় বিশেষ অভিবাসীর আধিপত্য এত ব্যাপক যে, চেনার উপায় থাকে না এটি কোন দেশের অংশ। উদাহরণস্বরূপ নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে গিয়ে যেকোনো আগন্তুকের মনে হবে, এটি বুঝি ঢাকা শহরের অংশ। যেমন পোশাক, তেমনি খাবার; পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা, আড্ডা, রাজনীতি—কী নেই সেখানে! ফলে এসব অঞ্চলে ঈদ উদ্‌যাপিত হয় অনেকটা প্রায় দেশীয় আদলে। রমজান মাসজুড়ে শাড়ি-গয়নার মেলা, ঈদের আগের রাতে মেহেদি, সবার ঘরে ঘরে দেশীয় খাবারের সুবাস, নতুন পোশাকে পাড়া বেড়ানো—ঈদের কোন আয়োজনই বাদ পড়ছে না। অফিস খোলার দিনেও পাওয়া যাবে বাংলাদেশের মতো সরকারি ছুটির আমেজ। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেশের চেয়েও অধিকতর ভালো ঈদ উদ্‌যাপিত হয় এসব অঞ্চলে। কারণ, নিরাপত্তাহীনতা নেই, খাবারে ভেজাল নেই, পরিবেশ দূষণ নেই, লঞ্চডুবি নেই, চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাস নেই। নিজের সৎ উপার্জনে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনের সুবিধা পেতে হলে দেশের আনন্দ তো কিছুটা ছাড় দিতেই হবে।
আনন্দ যেহেতু মানুষের মনে, সেহেতু বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা আসলে ঈদের আনন্দে তেমন কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। ঈদের দিন সব উপকরণ থেকেও কেউ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে পারে, আবার কিছু না পেয়েও অনেকে আনন্দের স্রোতে ভাসতে পারে। আনন্দ উপভোগের প্রধান শর্ত হচ্ছে সততা ও উদারতা। নিজে পবিত্র না হলে ঈদের আনন্দ কখনোই আমাদের ছুঁয়ে যাবে না।

লেখক: অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল, আমেরিকা।