দিঘির জল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক.
কক্সবাজারে হোটেলের বিছানায় অয়নের গায়ে গা, পায়ে পা জড়িয়ে শুয়ে আছে দোলন। আজই তাদের প্রথম দেখা। অয়ন ঘুমিয়ে পড়েছে আগেই। সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আনমনা দোলন ভাবছিল নিজের জীবনের কথা। মফস্বলের চৌহদ্দিতে বড় হয়ে ঢাকায় এসে শহরটাকে যখন খুব অপরিচিত ঠেকছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখা মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল। ক্লাস করে একদিন বাসায় এসে শুনল, ‘ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ে’। কেউ জানতেও চাইল না তার ইচ্ছা, অনিচ্ছার কথা। যেন এটাই স্বাভাবিক। অথচ আর সব মেয়ের মতো দোলনেরও অনেক স্বপ্ন ছিল। কলেজে পড়ার সময় শর্মিলা ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘তোমরা কেউ শাড়ি, গয়নার পিছে সময় নষ্ট করবে না, নিজের পায়ে দাঁড়াবে।’ 

ম্যাডামের কথাগুলো সেদিন দোলনকে খুব নাড়া দিয়েছিল। সেরকমই আত্মনির্ভর হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছিল। অকস্মাৎ বিয়ে তার সেই সংকল্পে যেন কুঠারাঘাত করল। তা ছাড়া সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত লোকের সঙ্গে বিয়ে, যার সঙ্গে কখনো, কোনো দিন আলাপ-পরিচয় হয়নি—এই ব্যাপারটাও মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল। আর সব মেয়ের মতো তারও স্বপ্ন ছিল, মনের মতো কোনো মানুষের সঙ্গে প্রেম, পরিণয় হবে। কিন্তু নিয়তির কাছে হার মেনে সংসার জীবন শুরু করতে হলো। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মোকাবিলার সাহস সেদিনের আঠারো বছরের দোলনের ছিল না। তবে সেদিন সেই অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ করতে না পারলেও, তার আত্মনির্ভর হওয়ার সংকল্প থেকে সে পিছপা হয়নি। আজ সে স্বাবলম্বী, ব্যস্ত চাকুরে। ঢাকায় সরকারি চাকরির পাশাপাশি নিজের ব্যবসাও আছে। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যস্ততা যেন জীবনের শুরুতে সেই ভীষণ দুঃখবোধকে চাপা দিয়ে রাখে।
অয়নের সঙ্গে দোলনের পরিচয় ফেসবুকে। সে চট্টগ্রামের একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। ফেসবুকে এক বন্ধুর দেয়ালে কোনো একটা বিষয় নিয়ে দুজনের প্রথমে তর্ক-বিতর্ক, সেই থেকে আলাপ, বন্ধুত্ব। বয়সে অয়ন দোলনের বেশ ছোট। ব্যক্তিজীবনে সেও বিবাহিত। তরুণ বয়সে প্রেম করে অয়নের বিয়ে হলেও কোথায় যেন একটা সুর কেটে গেছে। চাওয়া-পাওয়ার মাঝে যে ফারাক সেটা ক্রমে সংসার জীবনে দূরত্ব বাড়িয়ে তুলেছে। দায়িত্বের বেড়াজাল ধীরে ধীরে ঘিরে ধরেছে অয়নের চারপাশ। এই সময়ে দোলন এল তার জীবনে খোলা হাওয়া হয়ে। হৃদয়পটে যে মানবীর মূর্তি আঁকা ছিল অয়নের, দোলন যেন ঠিক তাই। বন্ধু হওয়ার কথা অয়নই বলেছিল প্রথমে।
– বন্ধু হতে হলে কী করতে হবে? দোলনের সরল প্রশ্ন শুনে অয়ন থমকে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য।
–কিছু করতে হবে না, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর’- শুধু এইটুকুতেই চলবে।

দুই.
ফেসবুকে দুজন অসম বয়সীর ভালো লাগা, বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হতে বেশি সময় নেয়নি। ‘বেশি বয়সের প্রেমের মতো’ তাদের প্রেম যেন বড় একলা, অনন্য। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মেসেঞ্জারে খোঁজ নেওয়া, তারপর সকাল গড়িয়ে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত ক্ষণে ক্ষণে কথা বলা-এ যেন ফিরে যাওয়া সেই না পাওয়া হারানো দিনগুলো ‘বাতাসে তোমার স্পর্শ ছেলেবেলার মতো ডাকছে, যখন দিনগুলো সহজে, কত সহজেই রঙিন হতো।’
অবশেষে রূপকথার মতো বাস্তবে তাদের একদিন দেখাও হলো। কক্সবাজারে দোলনের একটা অফিশিয়াল মিটিং ছিল। অয়ন সেখানে গেল চট্টগ্রাম থেকে। বিমানবন্দরে প্রথম দেখা, সেখান থেকে পর্যটনের হোটেলে। দুজনের কেউ কাউকে আগে দেখেনি। অথচ মনে হলো কতদিনের চেনা; শুধু দেখা হওয়াটাই বাকি ছিল! সেই প্রথম দেখা, প্রথম চুম্বন, প্রথম মিলনের রেশ থেকে যায় বহুদিন। তারপর আধো পুনরাবৃত্তি।
দোলন একদিন বোঝাল অয়নকে তাদের সম্পর্কটা আসলে ‘শেষের কবিতা’য় উপমা দেওয়া দিঘির জলের মতো অমিত আর লাবণ্যের সম্পর্ক ছিল যেমন- ‘শেষ পর্যন্ত অমিত বাবু স্বীকার করেন, লাবণ্যের সঙ্গে তাঁর প্রেম যেন দিঘির জল, সে জল ঘরে আনবার নয়, সেই জলে মন তার সাঁতার দেবে।’
তবে মাঝে মাঝে দিঘির জলে সাঁতারেও দোলনের ক্লান্তি আসে, মেসেঞ্জারে দৈনন্দিন আলাপও মনে হতে থাকে একঘেয়ে। দোলন তখন একটু ছুটি চায়। দোলনের সঙ্গে নতুন জীবনের প্রাত্যহিক আলাপচারিতায় অভ্যস্ত অয়ন তখন বুঝতে পারে না, তার এ সময়ে কী করা উচিত। তার বদ্ধ জীবনে খোলা হাওয়া অকস্মাৎ যেন বন্ধ হয়ে যায়। খাঁচায় বন্দী পাখির পাশে বনে উড়ে বেড়ানো যে মুক্তবিহঙ্গ গান গেয়ে যায়, সে যেন হঠাৎ উড়ে যায় কোনো দূর অজানায়। সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলো দুজনকেই খুব কষ্ট দেয়।

তিন.
দোলন-অয়নের গল্প এভাবেই আরও অনেক দূর এগিয়ে যায়। এই গল্পের শেষ কী আমরা জানি না। হয়তো বহুদিন পর তারা দুজন আবার কক্সবাজারেই ফিরে আসে যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। নিজ নিজ জীবন থেকে অবসর নিয়ে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন তারা এখানেই কাটিয়ে দেয় একসঙ্গে। অথবা কেউ একজন আগে মারা যায়, আর অন্যজন সেই দিঘির জলের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে পরানের গহিন ভেতর।
‘হয়তো হয়েছে স্তব্ধ সেই দিন, আমার এ নক্ষত্রের রাত
হয়তো সরিয়া গেছে-তবু তুমি আসিবে হঠাৎ
গানের অনেক সুর-গানের অনেক সুর সমুদ্রের জলে
অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে!’
—জীবনানন্দ দাশ