পানের পিক

এইতো কিছুদিনে আগে ঘটে গেল চোখের সামনে একটি মজার ঘটনা। বাসার একদম কাছেই আমার কর্মস্থল। বাসা থেকে পায়ে হেঁটে ১০ মিনিটের পথ মাত্র। একদিন সকালে কাজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে রওনা দিলাম। কিছু দূর এগিয়ে দেখি, রাস্তা ব্লক করে ৩-৪টি অ্যাম্বুলেন্স আর কিছু মানুষের জটলা। জটলার মাঝে আমার দুজন পরিচিত মুখও আছে। তাদের একজন আমাকে দেখে ছুটে এল। এসে হড়বড় করে যে ঘটনা বলল, শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম!! 

ঘটনা এই, আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নীলার চাচিকে প্রথমে পুলিশ ধরেছে, এরপর এমন মার দিয়েছে, উনার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ছুটছে। এখন উনার মরণাপন্ন অবস্থা। অ্যাম্বুলেন্স এসে তাঁকে কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে, অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে, হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আশপাশের যারা ছিল, তারা শুধু চাচির মরণ চিৎকার, আল্লাহ গো আমারে বাঁচাও... ও মাগো, ও বাবাগো—ধরনের আর্তনাদ শুনতে পেরেছে। আর কিছু জানে না, পুলিশও কিছু বলেনি। পুলিশকে কেউ জিজ্ঞাসা করার সাহসও পায়নি, চাচির অপরাধ কি?
আমি ভেবে কূল পাচ্ছি না, আমেরিকার মতো দেশে যেখানে মেয়েদের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়, মেয়েদের গায়ে আঁচড়টি দেওয়া দূরের কথা, অসম্মান করে কিছু বললেও শাস্তি পেতে হয়। সেখানে পুলিশ একজন বয়স্ক মহিলাকে মেরে নাক মুখ দিয়ে রক্ত ছুটিয়ে দিয়েছে! আর সেটা আবার নিউইয়র্কের পুলিশ!! যারা কিনা বড় বড় দাগি আসামিকেও খুব সৌজন্যের সঙ্গে স্যার/ম্যাডাম বলে সম্বোধন করে! আমার কাছে সবকিছুই অবিশ্বাস্য লাগছে। আমি তাড়াতাড়ি নীলাকে কল দিলাম। যা শুনেছি বিস্তারিত সব জানিয়ে দিলাম। নীলা আমার কাছে জানতে চাইল, আমি ফ্রি আছি কিনা? আমি জানালাম, অফিস যাচ্ছিলাম, তবে অসুবিধা নাই। আমি এখন বাসায় ফিরে অপেক্ষা করছি, তুমি আসো। তারপর যাওয়া যাবে হাসপাতালে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলা এসে হাজির। আমি আর নীলা দুজনে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। পথেই দুজনে আলোচনা সেরে নিলাম, পুলিশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যাব। এত বড় সাহস কীভাবে হল, হোক চাচির যত বড় অপরাধ। তাই বলে তাঁকে মেরে আধমরা? মেনে নেওয়া যায় না এমন অনাচার। যা হোক, হাসপাতালে পৌঁছে প্রথমেই ইমারজেন্সিতে খোঁজ নিলাম। কারণ জানা আছে, প্রথমে এখানেই চাচিকে আনা হবে। চাচিকে খুঁজতে বেশি বেগ পেতে হল না। চাচির চারপাশ ঘিরে ডাক্তার নার্স গিজগিজ করছে। এলাহি কাণ্ড কারখানা চলছে চাচিকে নিয়ে। আমেরিকা এমন একটি দেশ, মানুষের জীবনের মূল্য এখানে সবার ওপরে। একজন রোগী ধনী কি গরিব—তা দেখার প্রয়োজন নেই। চিকিৎসা খরচের ধার ধারে না, ধার ধারে শুধু রোগীর রোগটিকে। যমে মানুষে টানাটানি চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত একপক্ষ হার না মানে।
যা হোক, আমি ও নীলা ইমারজেন্সিতে গিয়ে বহু কষ্টে অনুমতি পেলাম চাচির কাছে যাওয়ার। কাছে যাওয়ার পর ডাক্তার নার্স তারাও কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ চাচি একটি ইংরেজি শব্দও জানে না, ডাক্তাররা যাই জিজ্ঞাসা করছে, উনি কিছুই বলতে পারছে না, সমানে কেঁদে যাচ্ছেন। নীলাকে দেখে চাচি আরও জোরে হাউমাউ করে যা বললেন, আর উপস্থিত পুলিশ ও ডাক্তার থেকে যে ঘটনার বর্ণনা উদ্ধারে সক্ষম হলাম, তা শুনে আমি ও নীলার মনের অবস্থা, হে ধরণি দ্বিধা বিভক্ত হও। আমরা দুজন তার ভেতর লুকিয়ে যাই। ঘটনা হচ্ছে, চাচির সুগার লেবেল অনেক বেশি। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে, প্রতিদিন প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে। দেশে থাকতে উনি সকালে পাড়াময় হেঁটে বেড়িয়েছেন। এখানেও তাই করতে বেরিয়েছিলেন। শুধু জানা ছিল না, দেশের আর এখানকার আইনের তফাত।
আজ সকালে উনি যখন বেরিয়েছিলেন, ফুরফুরে মনে এদিক-ওদিক হাঁটছিলেন। আর মুখের ভেতর ছিল পানে ঠাসা। আয়েশি ভাবেই চিবোচ্ছিলেন। চিবানোর ফলে মুখ ভরে উঠে ছিল পানের রসে। এমন সময় রাস্তায় দুজন পুলিশের মুখোমুখি হওয়ায়, পুলিশ দুজন চাচিকে সৌজন্য হিসেবে হাই বললেন, চাচিও আধুনিক কায়দায় হাই বলতে গিয়ে লাল টুকটুকে কিছু পানের পিক মুখ বেয়ে পড়ে গিয়েছিল। দুই পুলিশ তা দেখে, কিছুটা বিস্মিত হলো। ওদের বিস্ময় আমেজ কাটার আগেই চাচি পুরো পানের পিক পিচকারির মতো পুলিশের সামনেই ছপাৎ করে মাটিতে ফেললেন। ফেলার সঙ্গে সঙ্গে দুই পুলিশের মাথা খারাপ অবস্থা। তারা ভেবেছে চাচির ভয়ানক অবস্থা। হয়তো তক্ষুনি চাচির ভবের লীলা সাঙ্গ হতে যাচ্ছে। তাই এক মুহূর্ত দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে চাচিকে দুই পাশ থেকে ধরে ফেললেন। চাচি ঘটনার আকস্মিকতায় সম্পূর্ণ বেকুব। কারণ পুলিশ দুজন হাই বলেছে, উনিতো তাই বলেছেন। তাহলে এরা এমন করে তাকে ধরে বসল কেন? উনি যেহেতু ইংরেজি বলতে পারেন না। কিন্তু বাবাগো, মাগো বলে চেঁচাতে তো পারেন। উনি সমানে চেঁচামেচি আর গালি পাড়ছেন। পুলিশ বেচারা ভেবেছিল, এটা উনার যন্ত্রণার প্রকাশ। কাল বিলম্ব না করে পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স কল করে চাচিকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে ভোঁ ভোঁ ভোঁ...।
আমি ও নীলা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উপস্থিত সবাইকে বোঝালাম চাচির মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়ার আসল রহস্য। ওদের বললাম, চুইংগামের মতো এটিও একটি চিবিনো জাতীয় খাবার, যার নাম পান পাতা। যার সঙ্গে সুপারি, জর্দা নামক টোব্যাকো, খয়ের ও চুন লাগিয়ে চিবানো হয়। এটিও সিগারেটের মতন একজাতীয় টোব্যাকো। সিগারেট টানলে ধোঁয়া ছাড়ে আর এই পান জাতীয় টোব্যাকো চিবালে এক ধরনের লালা জমে। যেটাকে আমরা বলি পানের পিক, যা তোমরা ভাবছ রক্ত। উনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তাঁকে দয়া করে ছেড়ে দাও। সব শুনে উপস্থিত প্রায় সবার এমন অবস্থা ধরেছে, মুখ কিছুটা হা আর বিস্ফোরিত নেত্র। এমন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চাচিকে নিয়ে আমি ও নীলা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। আর চাচি কান্নাকাটি ভুলে যত বাঙালি বিখ্যাত গালি আছে সব ঝাড়তে ঝাড়তে বীরদর্পে দুই ভাতজিসহ হাসপাতাল ত্যাগ করলেন।
বাসায় যাওয়ার পথে আমি চাচিকে বোঝালাম, আমাদের এই দেশে যেখানে–সেখানে থুতু ও ময়লা ফেলা নিষেধ। নয়তো ৫০ ডলার জরিমানা করত। ওরা ভেবেছিল, আপনার মুখ ভরে রক্ত বের হচ্ছে, তাই এই এলাহি কাণ্ড ঘটেছে। শুধু টুকটুকে লাল রঙের পানের পিকের কারণে আজ আপনি জরিমানা থেকে বেঁচে গেলেন। চাচি সবকিছু বুঝে হু হু হা হা অট্টহাসি দিলেন। আমরাও চাচির সঙ্গে হাসতে হাসতে বাসায় ফিরলাম।