অবৈধ অভিবাসীরা যেন ভাসমান কচুরিপানা

কত স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়ে তরুণেরা। বাবুই পাখির বাসার মতো মনের কোণে বুনতে থাকে স্বপ্ন। ভাবে, বাবা এক পাঞ্জাবি দিয়েই কাটাচ্ছে বছরের পর বছর। পাঞ্জাবিতে সেলাই পড়ছে কতগুলো তার হিসাব কখনোই করে না।
বাবাকে সেলাই করা পাঞ্জাবিটা আর পরতে দেব না। মাকেও বলবে, এক শাড়িতে আর কত। সংসারের হাল এবার সেই–ই ধরব। কিন্তু চাকরির বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে। আর পেলেওবা কত বেতন পাব! তাও আবার লাগে ঘুষ। না এভাবে হবে না। বিদেশে যেতে হবে। শুনেছে, পরিশ্রম করলে সেখানে অনেক আয় করা যায়। এভাবে গড়ে উঠে একজন তরুণের মনে স্বপ্ন। সে পা বাড়ায় বিদেশে। একটু সচ্ছল জীবনজাপনের আশায়। আপনজনের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য। খুঁজতে থাকে কীভাবে বিদেশ পাড়ি দেওয়া যায়, সে পথ। পেয়েও যায়। দালালের অভাব নেই দেশে। আর ভুলটা তখনই করে, সে নিজেও বুঝতে পারে না। সে বিদেশ আসে ঠিকই কিন্তু তত দিনে বুঝে যায়—এই পথটা সঠিক ছিল না। তখনই সে অনুধাবন করতে পারে, তার আর ফেরার পথ নেই। তখন পথ খুঁজতে থাকে, যেভাবে হোক স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।
বৈধ কাগজ না থাকায় চাকরিও পায় না অনেক সময়। আবার পেলেও অন্যদের তুলনায় মজুরি ২/৩ ডলার কম। তাও মেনে নেয়। কিছু করার থাকে না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে যেন পুলিশ ধরতে না পারে। অনেকে আবার কাজের পারমিট পায়, কিন্তু বৈধ কাগজপত্র পায় না। এ এক দোদুল্যমান অবস্থায় থাকা। দেশে যেতে চাইলেও পারে না। কেউ আবেদন করে উকিলের মাধ্যমে কিন্তু এতে সে যা আয় করে তার অর্ধেক চলে যায় উকিলের পেছনে। বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকে। না পারে স্থির হতে প্রবাসে, না পারে দেশে ফিরে যেতে। ফিরে গিয়ে করবে কি? যা দিনকাল জীবনের তো নিরাপত্তা নেই। তাই সে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে প্রবাসে। ভাসতে থাকে কচুরিপানার মতো, যেন কুল–কিনার নাই। আজ এই অঙ্গরাজ্যে তো কাল অন্যখানে। ভয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ, কখন না আবার পুলিশ ধরে। সম্প্রতি আমেরিকায় শুরু হয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড়। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে চলছে এই অভিযান। বিশেষ করে যাদের বিপক্ষে ডিপোর্টেশনের বা বহিষ্কারের আদেশ রয়েছে তাদের আটক করা হচ্ছে।
ডিপোর্টেশনপ্রাপ্ত প্রবাসীরা দেশে ফিরে না গিয়ে ইমিগ্রেশন আইন অমান্য করে থেকে গেলে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে আইন অনুযায়ী। সেই জরিমানার পাল্লা অনেক ভারী। প্রায় প্রতিদিন গুনতে হবে পাঁচ শ থেকে সাত শ ডলার পর্যন্ত। একটা বাংলা প্রবাদ বাক্য আছে, এ যেন খাঁড়ার ওপর মরার ঘা। যাদের এমনিতেই চলে না, তাদের আবার এত জরিমানা। কিন্তু কিছুই করার থাকে না।
ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ৪ জুলাইয়ের পর থেকে অবৈধ অভিবাসীদের আটক করা হবে।
এর মধ্যে অনেককে আটকও করা হয়েছে। হয়তো দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু দেশে গিয়ে তারা করবেটা কি? এমনিতেই বেকারের সংখ্যা অগুনতি। আর নিজে কিছু করতে হলে যে পুঁজি দরকার, তা তো থাকার কথা নয়। আমি একজনকে চিনি, যিনি ১১ বছর ধরে এই আমেরিকাতে আছেন বৈধ কাগজপত্র ছাড়া, ফলে দেশেও যেতে পারছেন না। ছোট একটা চাকরি করে কোন রকমে চলছেন। এই যে তার জীবনযাপন, তিনি না পারছেন এখানে কিছু করতে, না পারছেন দেশে কিছু করতে। কারণ যে বেতন পান, তা দিয়ে নিজের থাকা–খাওয়ার খরচ চালিয়ে সামান্য কিছু দেশে পাঠান। এতে সংসার চলে যায়। কিন্তু ডলার জমিয়ে বড় কিছু করবে সাধ্য তাঁর নেই।
এই ব্যক্তির মতো হাজার হাজার তরুণ আছেন যারা এ অবস্থার মধ্যে জীবন পার করছেন। কিছুই করার নেই। যে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকা এসেছেন, সে স্বপ্ন আজ ধূসর। কাঁদা বালিতে আটকে গেছে জীবন। এখন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে তাকে প্রতিনিয়ত। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন যারা পরিবার নিয়ে আছেন অথচ বৈধ কাগজপত্র নাই তাঁরা। না পারছেন পরিবার নিয়ে দেশে যেতে, না পারছেন এখানে শান্তিমতো থাকতে।
অনেকের সন্তানের জন্ম আমেরিকায়। সেসব বাচ্চারা হয়তো আইনি লড়াইয়ে জিতে যাবে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত। আসলে একেকজনের সমস্যা একেক রকম। সমস্যা যেমন হোক না কেন, বৈধ কাগজ না থাকলে কী পরিমাণ কষ্টে কাটে অবৈধ অভিবাসীদের জীবন, তা নিজের চোখে দেখেছি। বাস্তবতার নিরিখে চলতে গিয়ে তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবান সময়, বয়স, হাসি-আনন্দ। তবুও বেঁচে থাকে এই স্বপ্ন নিয়ে, একদিন আঁধার কেটে গিয়ে আলো পড়বে চলার পথে।