পারুল

অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যায়। ছবি দেখে স্বপন অনুমান করে ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যের ছোঁয়া এখনো তাঁর হারিয়ে যায়নি। অনেক বছর হয়ে গেল। কখনো ভুলতে পারেনি পারুলকে। বয়সে তেমন একটা পার্থক্য ছিল না। স্কুল থেকে ফিরে পড়ার টেবিলে বসলেই জানালায় চোখ যেত। কোনো মোহনীয় দৃষ্টি আস্তে করে সরে পড়ত। ওরা শহরে নতুন আসায় স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছিল অনেক দিন। ওর মার্জিত আচরণ এবং চলাফেরায় কিছুদিনেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
পারুলদের সঙ্গে স্মৃতিগুলো জীবনের আনন্দ বেদনায় মিশে আছে এখনো। স্বপনও ঢালাওভাবে কারও সঙ্গে মেশার সুযোগ পেত না। কঠিন শাসনে তার বেড়ে ওঠা। এদের আগমনে খেলাধুলার পরিধি অবশ্য বেড়ে গিয়েছিল।
এক সময় তাদের পরিবারের মাঝে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকি কোনো কিছু কারওর অগোচরে থাকত না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো তাদের মধ্যে আর কোনো রাখঢাক নেই। মফস্বল শহরের দিনগুলো স্বপ্নের মতো পার হয়ে যায়। ছন্দপতন হবে সে রকম ভাবনা কখনোই তাকে তাড়া করেনি।
মধুর একটা আকর্ষণ ছিল পারুলের প্রতি। পারুল নিজেকে কখনো প্রকাশ করেনি সে সময়। জানালায় এক পলক তাকিয়ে রহস্যময় হাসি নিয়ে হারিয়ে যেত। বাড়ির আঙিনায় এক সঙ্গে তারা চোর পুলিশ খেলেছে। পুকুরে একই সঙ্গে সাঁতার কেটেছে। প্রজাপতির মতো ডানা মেলে পারুল ঘুরে বেড়াত। ভালো লাগা কী কঠিন যন্ত্রণা তখনো বোঝেনি। সেই বয়সে একসঙ্গে খেলা করা অতি সাধারণ ব্যাপার। কখনো এই সাধারণটা ভিন্ন বাঁক নেয়। পারুল তাদের বাসায় ঘন ঘন আসতে থাকায় অনেক কিছুতে রং বদলে দিয়েছিল।
কতটা বছর জীবন থেকে চলে গেছে। আজ কেমন আছে পারুল? সে সময় কী রকম ভাবনায় ছিল কোনো দিনও জানতে পারেনি।
সেদিন আচমকা ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পারুই প্রথম রিকোয়েস্ট পাঠায় এবং সে যথেষ্ট অবাক হয়ে গিয়েছিল। কখন যে জীবন থেকে এতগুলো বছর হারিয়ে গেছে। দেরি না করে অজানা শিহরণে অ্যাকসেপ্ট করে নেয়। কিছুদিন থেকেই পারুলের নাম ফেসবুকের পাতায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রথমে চিনতে পারেনি। ইচ্ছে হলেও সে রিকোয়েস্ট পাঠায়নি। যদি আগের মতো অহমিকায় দূরত্বকে বেছে নেয়। অনেক বছর আগে যেভাবে জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ভীষণ কঠিন মেয়ে। সেই স্মৃতিগুলো এখনো তার চলার গতিকে থামিয়ে দেয়। কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
যেদিন জানতে পারে, ওরা তাদের ছোট্ট শহরে আর থাকবে না। বাবা বদলি হয়ে যাচ্ছেন অন্য শহরে। সেদিন সত্যিই হারিয়ে গেল প্রজাপতির মতো অন্য কোনো বাগানে। খবর পেল বিয়ের পিঁড়িতেও বসতে যাচ্ছে। তখন সে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং এমন কিছু পড়ার স্বপ্নে বিভোর।
ছোট ভাই বিয়ের কার্ড নিয়ে আসে। তারা কেউই যেতে পারেনি। মনটা মোচর দিয়ে ওঠে। সেদিন মনে হয়েছিল সে কেন আরও বড় হলো না। সম্ভবত পারুল বিদেশে চলে যাওয়ার আগে স্বামী ও ভাইবোনদের নিয়ে বাসায় বেড়াতে আসে শেষবারের মতো। রীতিমতো শো আপ। এই আগমন উপলক্ষে তাদের বাসায় বিরাট আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন।
গভীর দৃষ্টিতে পারুলকে দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। ওকে পাওয়ার কোনো যোগ্যতা বা সামর্থ্য কোনোটাই তখন তার ছিল না। নীরবে মেনে নিয়েছিল এই পরিণতি। পারুলেরও কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করেনি সেদিন। হয়তো পারু ভেবেছিল, ওতো সামান্য, এখনো কোনো যোগ্যতাই নেই অথবা কিছুই ভাবেনি। পারুল যে সুখী এতে কোনো সংশয় নেই।
ফেলে আসা সেই দিনগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে। সে সময় অন্যরকম কিছু ঘটতে পারত। ইদানীং তার পোস্ট দেখে মনে হয়, আগে যে রকম জানালায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ মিলিয়ে যেত এখনো সেই লুকোচুরি আছে তার চালচলনে।
অব্যক্ত বেদনায় স্বপন গুমরে মরে। তাকে নিয়ে ভাবতে চায় না। তবুও বেশি করে মনে পড়ে। পারুলেরও কি এখনো তাকে তেমনি মনে পড়ে?
কখনো পারু তার পোস্টগুলোতে কমেন্ট করেনি। ভুলেও না। শুধু লাইক দিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করতে পারত এত দিন পরে কেমন আছে। তবে কি কোনো অভিমান আছে অথবা দুর্বলতা? দুজনে পরিণত বয়সে দিব্যি সুখেই আছে। আটলান্টিকের দুপাড়ে উন্নত বিশ্বের ব্যস্ততম দুটো শহরে আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে দীর্ঘদিন তারা বসবাস করছে। সামান্যতম কোনো যোগাযোগের আগ্রহ নেই কারও। এখন পর্যন্ত কেউই নিজ থেকে কথা বলেনি।
অনেক কিছু বলতে পারত। সুখ দুঃখের কথা! চাওয়া পাওয়া বা স্বপ্ন ভঙ্গের কোনো কিছু। এখন তো এসব আর কোনো ব্যাপার নয়। কত অপরিচিত জনের সঙ্গে তো চ্যাটিং হয়। মন ভরে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। একে অপরের খবর ঠিকই পেয়ে যায়। পৃথিবী তো এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু মানুষের মন? সে তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মুহূর্তের ব্যবধানে অনেক কিছু পাল্টে যায়। জীবন তো খুব অল্প সময়ের। আটলান্টিকের দুপাড়ের দূরত্বের মতো তাদের মনেরও ব্যবধান কিন্তু থেকে যায়।
এমন কি হতে পারত না? পারুল তার জীবনে এসেছিল। সংসারের দায়িত্ব তাকে দিয়ে সে নাক ডেকে ঘুমাত নিশ্চিন্তে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে চমৎকার সমঝোতা করে যেত। ছেলেমেয়েগুলো কি সাংঘাতিক এক একজন! ওদের সঙ্গে পেরে উঠছে না সে। ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যে পশ্চিমা স্টাইলে বড় করে তোলা এক একজন বড় বড় করপোরেট অফিসের গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশলী। তাদের এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে স্বপন সর্বশক্তি ব্যয় করেছিল। এখন তাদের মনোজগতে ঢুকতে পারা যেন অসম্ভব কিছু। নিজেকে নিতান্তই বেমানান ঠেকে। নিজের ব্যক্তিত্বকে খোয়াতে পারে না সে। মরে যাবে তবুও মচকাবে না। কত দিন ভেবেছে কোথাও হারিয়ে যাবে।
পারুলের মতো কেউ নিজস্ব আভিজাত্য ও স্টাইল নিয়ে সেতুবন্ধন করতে আসবে! তাকে এই কঠিন পরিস্থিতিতে আলোয় নিয়ে যেতে সহযোগিতা করতে থাকবে। কখন যে পারুলের ছবি দেখে এমন অবাস্তব ভাবনা পেয়ে বসে। জীবনের এই বাঁকে এসে তাঁকেই মনে পড়ে কেন বেশি!
কিছু স্মৃতি এখনো ভেসে বেড়ায়। ওর বাবার বদলি অর্ডার আসার পর একদিন তাকে ডেকে বললেন, ‘কিছুদিনের জন্য তোমাকে আমাদের বাসায় থাকতে হবে, কোনো অসুবিধা হবে না তো? তোমার খালাম্মা অনেক ভয় পান। আমাকে কয়েক দিনের জন্য নতুন জায়গায় গিয়ে থাকতে হবে।’
পারুল ড্রয়িং রুমের বিছানা ঠিক করে রেখে দিত। কোনো দিন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে। ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে সে ক্যারম খেলছে। হঠাৎ খেয়াল হলো পারুল আসছে না। কিছুদিন আগেও তারা সবাই মিলে ক্যারম খেলছে। পাশের খোলা জায়গায় ব্যাডমিন্টন খেলেছে। এমন পরিবর্তন দেখে স্বপন কিছুটা কষ্ট পায়। এটা কি তার প্রতি অবহেলা! সে জানে কিছুদিনের মধ্যেই ওরা একেবারে চলে যাচ্ছে। দৃষ্টি বিনিময় হলে আগে হাই হ্যালো করত। ইদানীং দূরত্ব রেখে চলে। স্বপন বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। সে তো ইচ্ছে করে থাকতে আসেনি। মাথামুণ্ডু কিছুই আঁচ করতে পারে না। সে কি এমন কিছু বলেছে যার জন্য পারুল ক্ষেপে আছে।
নিশ্চয়ই কোনো কারণে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করবে! একদিন যেচে কথা বলতে গেল। একদম পাত্তাই দেয়নি। স্বপনের আত্মসম্মান বোধে লাগে। সেদিনের স্মৃতিগুলো স্বপনকে বেদনার নীল সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর এতটা বছর! ক্ষতটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
জীবনসংগ্রামের শেষ অধ্যায়ে আবার তার নীরব আবির্ভাব। দূর থেকে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখছে। তার গতিবিধিতে এমনটা প্রকাশ পায়। প্রায় স্ট্যাটাসে লাইক দেয়। পারুল যে তার শুভাকাঙ্ক্ষী খুব বুঝতে পারে। খুব ইচ্ছে করে, তার সঙ্গে যদি প্রাণ খুলে একান্তে কথা বলতে পারত! জেনে নিত, কেনইবা এমন দুর্বার আকর্ষণ। তাকে সেদিন কি ভালোবেসে ফেলেছিল!
আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে তার ইচ্ছাগুলো দু-কুলেই আঁচড়ে পড়ে।