গুজব ছড়িয়ে গজব আনছে জাতি!

‘পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশ দেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ সয়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।”

কবিগুরু এমনি আক্ষেপ করে এই কবিতাটি যখন লিখেছিলেন তার প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই ভিন্ন ছিল। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালি যেন প্রকৃত মানুষ হতে পারে। যেন বিশ্বসভায় নিজের জায়গা করে নিতে পারে। যেন ঘরকুনো হয়ে, মায়ের আঁচল ধরে বসে না থাকে। মায়ের নিষেধ শুনে, ভালো ছেলে হয়ে, খোকাবাবু হয়ে যেন জীবন পার করে না দেয় বাঙালিরা। শীর্ণ, শান্ত, সাধু সন্তানদের গৃহছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া হতে বলেছিলেন জীবনকে চেনার তাড়নায়, জগৎকে দেখার তাড়নায়।

আজ কোথায় সেই শীর্ণ, শান্ত, সাধু সন্তানেরা? রবিবাবুর ভাগ্য ভালো চাপাতি হাতে, লাঠিসোঁটা হাতে বীর বাঙালিদের তিনি অপরিচিতা নারীকে গণপিটুনি দিতে দেখে যাননি। দেখে যাননি প্রকাশ্য দিবালোকে শিক্ষককে পিটিয়ে তক্তা বানাতে। লেখককে কুপিয়ে হত্যা করতে। কিশোরীকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে। লিখতে গেলে এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আর কিইবা হবে লিখে?

আজকের দিনে বর্তমান এসব ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালিদের নিয়ে কবিতা লিখতে বসলে স্বয়ং গুরুমশাইও ভিরমি খেয়ে পড়তেন, সন্দেহ নেই। এখনকার এই হুজুগে, গুজবে, নেশাখোর, টাকাখোর, ক্ষমতালোভী, মানুষ মারার কারিগর, গণপিটুনি বিশারদ বাঙালিদের নিয়ে আর যাই হোক, কাব্য লিখতে পারতেন না তিনি। লিখতে বসে রাগে, দুঃখে, কষ্টে, অভিমানে বাঙালি জাতির নামের আগে যতগুলো বিশেষণ বসালাম, তার প্রতিটি শব্দই চাবুকের মতো নিজের পিঠেই এসে পড়েছে। কারণ, ওই বাঙলা মুল্লুকেই যে আমার নিজের, আমার বাপ–দাদার, আমার মায়ের আর আমার সন্তানের জন্ম হয়েছে।

তাই নিজের দেশে ঘটে যাওয়া বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, হানাহানি, ঝড়, বন্যা আর মহামারি দেখে আমরা যারা প্রবাসী, তারা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। এসব খবর, ঘটন–অঘটন আমাদেরও কাঁদায়, পোড়ায় এবং ভাসিয়ে নেয়। আমরাও অক্ষম আবেগে নানা কথা বলি। বিপর্যস্ত দেশকে গালি দিই, দেশের উচ্ছৃঙ্খল, ভণ্ড মানুষকে গালি দিই। কারণ দেশের দুর্দশায়, দেশের মানুষের চোখের পানিতে আমাদের বুক ভেঙে যায়। আমরাও কাঁদি, আফসোস করি। কারণ দিন শেষে আমরা জানি, ওই দেশটি আমাদেরই। ওরা আমাদেরই লোক। ওই ভূখণ্ডটি আমার জন্মভূমি। ওখানেই চির শয়ানে ঘুমিয়ে আছে আমার পিতা, পিতামহ। ওই দেশের আলো–হাওয়ায় আমি বড় হয়ে উঠেছি। তাই দেশের, দেশের মানুষের এই অবক্ষয় মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়…মেনে নেওয়া যায় না।

রবিঠাকুরের যুগে সেই অখণ্ড বাংলায় মাত্র সাত কোটি বাঙালি ছিল। তাদের নিয়ে ঠাকুরের ভাবনার অন্ত ছিল না। তার জায়গায় এখন শুধু পূর্ববাংলা বা আমাদের বাংলাদেশ হিসেবে জন্ম নিয়েছে তার মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। আর এই ছোট্ট ভূখণ্ডে, এই ১৬ কোটি সন্তানকে জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বঙ্গমাতা। তারপর তারা যদি হয় কুসন্তান। একপাল অমানুষ যেন ছিঁড়ে খুবলে–খুবলে খাচ্ছে মায়ের দেহ, হাড়, মজ্জা আর অস্থি। তাঁকে বিবস্ত্র করে সারা পৃথিবীর কাছে অপমানিত আর লজ্জিত করে তুলেছে তার বর্বর, অপরিণামদর্শী হুজুগে সন্তানেরা।

বিদেশের মাটিতে বসে দেশের কী নিয়ে আমরা গর্ব করব? দেশের একদল মানুষ অন্য মানুষদের প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করছে? গণপিটুনিতে বিশারদ বাঙালি জাতি গ্রিনিজ বুকে নাম লেখাবে? চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করতে তারা সিদ্ধহস্ত? আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারায় তারা পটু? এসব নিয়েই কী বড়াই করব আমরা? একদল মানুষ মারে আর অন্য দল সিনেমার শুটিংয়ের মতো সেই সব দৃশ্য দেখে। নয়তো তাদের স্মার্ট ফোনে সেই দৃশ্য ধারণ করে আপলোড করছে সামাজিক মাধ্যমে। এক কিশোরী মেয়েকে আগুনে পোড়ানো হল উৎসব করে। কয়েকদিন পর পরই কাউকে না কাউকে পথে-ঘাটে-বাড়িতে গিয়ে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। নিরপরাধ এক নারীকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহ করে একদল পশু ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। কারণ তারা বাঙালি। তারা অতি আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগ উথলে উঠলে তারা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এগুলোই হল তাদের আবেগ প্রকাশের নমুনা।

হিস্টিরিয়াগ্রস্ত একটা জাতি মানুষ হত্যা করার জন্য যেন মুখিয়ে আছে পথে, ঘাটে, ট্রেনে, বাসে।

হায় বঙ্গমাতা। এসব দৃশ্য আমরা কী অবলীলায় দেখে যাচ্ছি। দেখতে দেখতে আমাদের চোখ, মন, অন্তর ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। একসময় আমরা, আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা এসব দৃশ্য দেখে আর শিউরে উঠব না। আর ভয়ার্ত দুচোখে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠব না। আমরা ভাবব, এটাই স্বাভাবিক, এমনইতো হচ্ছে সচরাচর।

হায় বঙ্গমাতা! এই বাঙালিরাই একদিন অস্ত্র হাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিল—এযে ভাবতেই কষ্ট হয় আজ। যে অতিথিপরায়ণ বাঙালি জাতি অতিথির মুখে অন্ন না দিয়ে নিজে অন্ন গ্রহণ করত না, তারা এখন অপরিচিত এক নারীকে বিনা ক্লেশে, না জেনে, না বুঝে পেটাতে শুরু করে। তারা নিরপরাধ মানুষের বুকে পাড়া দিয়ে পশুর মতো পেটাতে পারে, চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে তার মাথা ঠুকে থেঁতলে দিতে পারে। তারা দেশের আইন মানে না, আইন জানে না।

হায় বঙ্গমাতা! হায় অচতেন বাঙালি। চিলে কান নিয়েছে ভেবে চিলের পেছনে আর কত দৌড়াবে তোমরা? এই বিজ্ঞানের যুগেও তোমরা সেই অন্ধকারে, সেই আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগেই রয়ে গেলে? সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগতে পারে এই অলীক বিশ্বাস কোনো অধম এখনো বিশ্বাস করতে পারে? হায়রে…! এখনো কত বড় অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে আমাদের স্বদেশ; ভাবতেও গা গুলিয়ে ওঠে।

হায় বঙ্গমাতা! বাঙালি তৈরি করার সময় তুমি তাদের মগজ কী এমন পদার্থ পুরে দাও? তাদের গুজব তৈরির এত ক্ষমতা কোথা থেকে আসে ভেবে বিস্মিত হতে হয়। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে গজব আনায় এই জাতির যে কোনো তুলনা নেই।

হায় বঙ্গমাতা! আমার সোনার বাংলা; তোমায় নিয়ে কী গর্ব করব বল? তোমার ধূলিতে মাথা ঠেকিয়ে আর কী চাইব বল? সন্তানদের অত্যাচারে অত্যাচারিত, নির্যাতিত, দুঃখে জর্জরিত এক জননী তুমি। এক হতভাগ্য দেশমাতা তুমি। তোমার এক সন্তান তোমার আরেক সন্তানকে মেরে তার রক্তে রক্তাক্ত, রঞ্জিত করছে তোমার দেহ। সন্তান শুধু জন্মই দিলে; তাদের মানুষ করতে পারলে না। তুমি এক ব্যর্থ জননী। হে কোটি কোটি বর্বর, অমানুষ সন্তানের জন্মদাত্রী—শত শত করুণা তোমার জন্য!