শিল্পের উন্নতি বাড়াচ্ছে বিপদও

শিল্পসভ্যতার ভয়ংকর এক বিপদ হলো বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের ক্ষয় বা গহ্বর সৃষ্টি। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আজ থেকে কয়েক দশক আগে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি যাতে সরাসরি পৃথিবীপৃষ্ঠে না-আসে সেই কাজটি করে থাকে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর। দেখা গেছে, ব্রোমাইট ও ক্লোরিনযুক্ত রাসায়নিক পদার্থের প্রসারণের ফলে বায়ুমণ্ডলের সমতা নষ্ট হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে গহ্বরের। বিশেষত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, স্টাইরোফোম, স্প্রে শিল্প ইত্যাদিতে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) এবং আগুন নেভানোর জন্য হ্যালন নামক রাসায়নিকের ব্যবহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার ফলে ওজোন স্তরে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির বেশিটাই শুষে নেয় ওজোন স্তর। কিন্তু সেখানে যদি গহ্বর সৃষ্টি হয়, তাহলে ওই রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে পৌঁছাবে এবং জীবজগতে প্রাণের সংশয় দেখা দেবে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বাতাসে যদি এক শতাংশ ওজোন কমে যায় তাহলে ২০৭৫ সালের আগে জন্মাবে এমন ৩০ লাখ থেকে ১.৫ কোটি মানুষের চামড়ায় ক্যানসার দেখা দেবে, ৫ লাখ থেকে ২৮ লাখ মানুষের চোখে নতুন করে চোখে ছানি পড়বে। এই ওজোন স্তরঘটিত সমস্যা বর্তমানে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। ১৯৩১ সালে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন আবিষ্কারের পর থেকে এর ব্যাপক ব্যবহার এবং আধুনিক ইলেকট্রনিক শিল্পে এর চাহিদা বেড়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্লোরোফ্লুরোকার্বন উৎপাদন সারা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশ এবং ব্যবহার মোট বিশ্ব ব্যবহারের ৫০ শতাংশ। পরিণামে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুদেশের ওজোন স্তরে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে আশার কথা, ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের বিকল্প রাসায়নিকের উৎপাদন শুরু হয়েছে। সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে শিল্পে ব্যবহৃত বর্জ্য পদার্থ নিয়ে। কোথায় ফেলা হবে এসব বর্জ্য? যেখানেই ফেলা হোক না কেন, তার থেকে দূষণ ছড়াবেই। বিপজ্জনক রাসায়নিক বর্জ্য সৃষ্ট হয় জৈব রাসায়নিক শিল্পে। এসব বর্জ্য পদার্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হলো পারমাণবিক বর্জ্য—এ নিয়ে মানুষ কী করবে, জানেন না বিজ্ঞানীরা। পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি হলো ইউরেনিয়াম। এই পদার্থটিকে যখন খনি থেকে তোলা হয়, এটি রেডন নামে এক তেজস্ক্রিয় গ্যাস বিকিরণ করে যা শ্রমিকদের ফুসফুসে ঢুকে ক্যানসার সৃষ্টি করে। ইউরেনিয়াম খনি থেকে বিকিরিত গামা রশ্মি মানুষের যৌন ক্রমোজামের জিনগত বৈকল্য সৃষ্টি করে। ইউরেনিয়ামকে জ্বালানি দূষণের মাধ্যমে আণবিক চুল্লিতে প্রবেশ করানোর পর ভাঙন প্রক্রিয়ায় বিপুল তাপশক্তি ও অসংখ্য বর্জ্য পদার্থের সৃষ্টি করে।
একদল মানুষ যারা গরুকে ভগবতী বলে প্রচার করেন, আবার তারাই নানা রকম ইনজেকশন দিয়ে কৃত্রিমভাবে গরুর দুধ বাড়াতে চান। তারা শিশু খাদ্যে ভেজাল মেশান, মানুষের খাদ্যে ভেজাল মেশান, মানুষের মনে বিষ ঢোকান। আসলে ভোগবাদী সভ্যতা প্রাণীদেরই পণ্য করে তোলেনি, মানুষকেও পণ্যের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। প্রাকৃতিক সম্পদকে লুণ্ঠন করে শিল্প বিপ্লবোত্তর ধনী দেশগুলো যে ভোগবাদী সমাজের আদর্শ নিয়েছে, তাতে সবাই পণ্য। অপ্রিয় হলেও সত্য, পৃথিবীর সম্পদকে অসমবণ্টন করে ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, পশ্চিমা ধনী দেশগুলো বিপুল পরিমাণে মাংস খায়। যার ফলে, তারা পশুপালন না করে বাণিজ্যিক পণ্যের মতোই তাদের চাষ করে। এক কেজি মুরগির মাংসের জন্য ২ কেজি শসা এবং ১ কেজি শুকরের মাংসের জন্য ৪ কেজি শস্য প্রয়োজন। ফলে তারা ২৫ শতাংশ জনসংখ্যার অংশ হয়েও পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ শস্য ভোগ করে। উন্নত দেশগুলো পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর প্রতি কোনো মানসিকতা পোষণ করে, তা বিশ্বব্যাংকের জনৈক চিকিৎসকের বক্তব্যেই স্পষ্ট।
বাংলাদেশ শিশুস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে বলা হয়, বিশ্বব্যাংক শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য পশ্চাৎপদ দেশকে অর্থ সাহায্যে করছে কেন? বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু কমে গেলে সেখানে জনসংখ্যা আরও বেড়ে যাবে, তাতে বাংলাদেশেরই সর্বনাশ। বরং আরও ব্যাপক হারে মারা যাওয়ার ব্যবস্থা করলে হয়তো বাংলাদেশের উপকার হতো। এখানে উল্লেখ করা যায়, আমাদের দেশে পুরুষের মধ্যে সন্তানবহনকারী শুক্রের ক্ষমতা কমে যাওয়ার একটি কারণ হলো খাদ্যে সিনথেটিক উপাদানের আধিক্য।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আম পাকানোর জন্য এমন একটি সিনথেটিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পুরুষ শুক্রাণুকে নষ্ট করে দিচ্ছে। চাষের ক্ষেত্রে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও পুরুষের শুক্রাণুর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
পাহাড়ে পূর্ত দপ্তরের কাজের সঙ্গে যেসব প্রযুক্তিবিদ বিশেষজ্ঞ যুক্ত রয়েছেন এবং যাঁদের অভিজ্ঞতা দুই দশকেরও বেশি তাঁদের কারও মতে, মাত্র দুঘণ্টার টানা প্রবল বর্ষণে পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে প্রায় একই সময় ধ্বংসলীলা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।
পাহাড় সরে যাওয়া নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া চিন্তার বিষয়। কারণ ডোলোমাইট সংগ্রহের জন্য যেভাবে ব্লটিং করা হচ্ছে, তাতে কম্পনের তীব্রতা আঘাত করছে পর্বতের তলদেশেও। তা ছাড়া পাহাড়ে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি সবকিছুই বিপন্ন করে তুলছে পাহাড়ি অঞ্চলকে। একই চিত্র দেখা যাচ্ছে হিমাচল প্রদেশ, কাশ্মীরে। হিমাচল প্রদেশে যে ড্যাম গড়া হচ্ছে তাতে পাহাড়ি পরিবেশ ও ভূত্বকের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে দীর্ঘ আন্দোলনও চালিয়েছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা নামক এক ভারতীয় নাগরিক।
যাই হোক, এটা নিশ্চিত বলা যায়, কম-বেশি সব দেশেই পাহাড়ে পর্যটকদের ভিড় তার পরিবেশকে বিপন্ন করছে, নানাভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
প্রতিদিনই সংবাদপত্রে শহরের বায়ু দূষণের পরিমাণের হিসাব দেওয়া হচ্ছে। বায়ুদূষণের জন্য বিজ্ঞানীরা কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতিকে দায়ী করেন। বিভিন্ন খনিজ জ্বালানি (কয়লা, পেট্রল, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ালে বাতাসে কাবন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। হিসাব অনুযায়ী, বিগত এক শ বছরে বাতাসে ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়েছে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় প্রচুর সালফার ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশে। সালফার ডাই অক্সাইড বাতাসে থাকা অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে সালফিউরিক অ্যাসিড ও সাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে। এই দুই ধরনের অ্যাসিড বৃষ্টির সঙ্গে মাটিতে নেমে আসে। অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পায়, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ু দূষণের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, বায়ু দূষণের পরিমাণ না-কমালে ২০৪০ সাল নাগাদ পৃথিবীর উষ্ণতা ৫০ সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে। তাতে মরু অঞ্চলে বরফ গলবে, হিমবাহগুলো গলতে শুরু করবে, পানি ২-৩ ফুট বেড়ে যাবে। ফলে সমুদ্র উপকূলের শহরগুলো ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা যে দেখা দেবে, তা বলাই বাহুল্য।