বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও আজকের বাংলাদেশ

রক্তস্নাত আগস্ট। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। প্রায় একই সময়ে পাকিস্তান, চীন, লিবিয়ার স্বীকৃতি আসে। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। আইন তাই বলে, বাংলাদেশে সবাই তাঁকে জাতির পিতা মানেন না? জিন্নাহ পাকিস্তানের জাতির পিতা, কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের, সুকর্ণ ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা—এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের জাতির পিতা বলতে সমস্যা কোথায়?
আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় এক দশকের একটু বেশি। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মাতামাতি করার মানুষের বা বঙ্গবন্ধু প্রেমিকের কোনো কমতি নেই, ১৯৭৪-’৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমরা এমন দৃশ্য দেখেছিলাম। তাই হয়তো একদা রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমদ দুঃখ করে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য কোনো বীরউত্তম, বীরবিক্রম এগিয়ে আসেননি’। কথাটা সত্য। প্রকৃতপক্ষে সেদিন আমরা কর্নেল জামিল ও কাদের সিদ্দিকী ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। এখানে আমি যা লিখছি, তা নতুন কিছু নয়। তবু লেখা, জাতির জনকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। তিনি একটি ভূখণ্ড এবং একটি সবুজ পাসপোর্ট দিয়েছিলেন বলে আমরা আজ তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছি।
আগস্ট মাস এলেই রাজনীতিকেরা বলতে শুরু করেন, বিদেশ অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জোর তৎপরতা চলছে। সদ্য আইনমন্ত্রী তাই বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত ও দণ্ডিত ১২ খুনির মধ্যে ছয়জন বিদেশে পলাতক। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এরা হচ্ছেন—ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমদ ও এ কে এম মহিউদ্দিন। পলাতক ছয়জন হচ্ছেন—লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ। এদের মধ্যে লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী আমেরিকায় এবং লে. কর্নেল (অব.) নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। বাকি চারজন কোথায় আছেন, তা কেউ জানেই না? বলা হচ্ছে, মেজর ডালিম হয়তো পাকিস্তানে আছেন। ১৫ আগস্ট ভোরে ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানেন, তাঁর দণ্ড কার্যকর করা কতটা জরুরি। দণ্ডিত আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। এদের চিহ্নিত করা হয়নি। বিদেশি কানেকশন খুঁজে বের করা হয়নি?
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় খন্দকার মুশতাক আহমদ আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তি আইনটি বাতিলে যেমন তিনি ব্যর্থ, তেমনি ‘ইন্ডেমনিটি’ অধ্যাদেশ তাঁর হাত দিয়েই পাস হয়েছে। দুই দশকের বেশি সময় পর শেখ হাসিনা সেটি বাতিল করতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ২১ মন্ত্রী মুশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরে আওয়ামী লীগের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল পঁচাত্তরের পর বলেছিলেন, ‘দেশ আজ ফেরাউন মুক্ত হলো’। পরে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এইচ টি ইমাম পঁচাত্তর পরবর্তী মুশতাক সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। জাসদের হাসানুল হক ইনুর ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার ছবিটি ইতিহাস, তিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলেন। তোফায়েল আহমদের বয়স হয়েছে। আশা করব, সেদিনের ঘটনার একটি সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা তিনি লিখে রেখে যাবেন, যাতে তার মৃত্যুর পর জাতি সেটি জানতে পারে!
পঁচাত্তরের পর সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তিনি দলছুট এবং মাঝেমধ্যে আবোলতাবোল বকছেন। তখন আরও কিছু নেতার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল, যাদের কথা কেউ বলে না বা জানে না। এরা অনেকেই তখন কলকাতা পাড়ি জমিয়েছেন। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তাঁর পরেই ছিলেন রংপুরের সুনীল গুহ। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীপঙ্কর তালুকদার তখন কাদের সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। কলকাতায় তখন যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নরসিংদীর এমপি মোসলেমউদ্দিন; যশোরের এমপি রওশন আলী; যশোরের সাবেক এমপি সুবোধ সরকার; শেখ ফজলুল করিম সেলিম; জাতীয় ছাত্রলীগের ইসমাত কাদির গামা; জাতীয় যুবলীগের খালেদ খুররম; আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকী; ছাত্রলীগের ওবায়দুল কাদের; হরে কৃষ্ণ দেবনাথ, আওরঙ্গ এবং আরও অনেকে। ছাত্রলীগ নেতা নুরু হত্যা কাদেরিয়া বাহিনীতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধে যেমনি বরিশালের চিত্ত সুতারের বিশাল ভূমিকা ছিল, পঁচাত্তর পরবর্তীতেও তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। কাদেরিয়া বাহিনী কেন ব্যর্থ হয়, সেটি অন্য কাহিনি। কিন্তু ওই সময়কার অনেক ছাত্রনেতা হারিয়ে গেছেন। সফল তালিকার শীর্ষে ওবায়দুল কাদের। ভারত থেকে ফিরে তিনি ধরা পড়েন, অত্যাচারিত হন। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি, এখন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিবিধ কারণে তখনকার নেতা-কর্মীরা এদিক-ওদিক ছিটকে পড়লেও এদের ভোলা অনুচিত। কাদের সিদ্দিকী পারেন ওই অনুল্লিখিত ইতিহাস লিখে রেখে যেতে।
আওয়ামী লীগ যেমন বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার মত নেতা জন্ম দিয়েছে, তেমনি মুশতাক আহমদের মত বিশ্বাসঘাতকেরও জন্ম হয়েছে। কাদেরিয়া বাহিনীর সংগ্রামের ব্যর্থতার পেছনেও এই বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারত-ভীতি কাজ করেছে। অবাক কাণ্ড, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তার মৃত্যুর ঠিক পরই ভোল পাল্টে ‘জয়বাংলা’ চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে? বর্তমান আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে বঙ্গবন্ধুর সময়কার নেতারা হোঁচট খাবেন। মদিনা সনদ, হেফাজতের সঙ্গে সখ্য, মডেল মসজিদ ও ইসলামি সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র নির্মাণ, কওমি সনদের স্বীকৃতি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঠিক মানায় না? আওয়ামী লীগের স্লোগান ‘জয়বাংলা’, নেতা-কর্মীরা এখনো সেটি দেন, কিন্তু তাদের চেতনায় ‘জিন্দাবাদ’। ফলাফল, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো যুদ্ধাপরাধীর বিশাল জনপ্রিয়তা এবং এমনকি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সাহস সরকার বা আদালতের হয়নি? আজকের বাংলাদেশ সাঈদীর ওয়াজ শুনে ঘুমাতে যায়?
বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন ধারায় বিচার হওয়া দরকার ছিল। রাজনৈতিক, বিদেশি সম্পৃক্ততা এবং সামরিক সংযোগ। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত রাজনৈতিক নেতাদের পরিচয় জানা দরকার। সামরিক বাহিনীর ভূমিকা স্পষ্ট হওয়া উচিত। তখনকার তিন বাহিনী প্রধানের ভূমিকা কী ছিল, জানা দরকার। বিদেশি ষড়যন্ত্র উদ্‌ঘাটিত হওয়া উচিত। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশের সময় কি এখনো হয়নি? ‘কান টানলে মাথা আসে’—এই উদ্ধৃতি আবারও প্রমাণিত হবে, যদি আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিশদ তদন্ত হয়; বেরিয়ে আসবে ৩-৭ নভেম্বরের তথাকথিত সংহতি দিবস ষড়যন্ত্রের কাহিনি। জিয়া হত্যাকাণ্ড, জেনারেল মনজুর হত্যাকাণ্ড, ক্যামেরা ট্রায়ালের মধ্যে দিয়ে ১৩ মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার ও অসংখ্য সেনা অফিসার ও জোয়ানের ফাঁসির ইতিহাস মানুষের জানা দরকার। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাসও জানা দরকার। কাউকে হেয় করা বা প্রতিশোধ নয়, জাতির কল্যাণেই ওসব জানা দরকার। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পরপরই ১৬ আগস্ট দুপুরে জেনারেল জিয়া ও খালেদ মোশাররফ নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানান। অথচ খালেদ মোশাররফ নাকি আওয়ামী পন্থী? একদা আমাদের তাই বোঝানো হয়েছে! একইদিন, ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকায় লেখা হয়েছিল—‘এ করুন মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে লেখা ছিল, তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন ছিল না’। ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট দাঁড়িয়ে কী একইভাবে বলা যায়, ‘বাংলাদেশ যদি “মিনি পাকিস্তানই” হবে তাহলে কি দরকার ছিল এই স্বাধীনতার?’ আরও বলা যায়, পাকিস্তান আমলের মত সংখ্যালঘুরা যদি আজও প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হয়, তাহলে কি প্রয়োজন এই স্বাধীনতার? এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?
পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা যেভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, এর একটি হিসাব আমরা পাই বাংলাদেশ গেজেট (৮/৬/১৯৭৬) থেকে। কর্নেল শরিফুল হক ডালিম চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিবের দায়িত্ব পান; লে. কর্নেল আজিজ পাশা আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব; মেজর মহিউদ্দিন আলজেরিয়ায় দ্বিতীয় সচিব; মেজর শাহরিয়ার রশীদ ইন্দোনেশিয়া দ্বিতীয় সচিব; মেজর বজলুল হুদা পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব; মেজর নূর চৌধুরী সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব; মেজর শরীফুল হোসেন কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব; ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম আবুধাবিতে দ্বিতীয় সচিব; লে. খায়রুজ্জামান মিশরে তৃতীয় সচিব; লে. আবদুল মাজেদ সেনেগালে তৃতীয় সচিব; লে. নাজমুল হোসেন কানাডায় তৃতীয় সচিব। কারা এদের নিয়োগ দিয়েছেন অথবা কারা এদের দীর্ঘদিন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, তা সবার জানা। হয়তো সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি-জামায়াত। পাপ বাপকেও ছাড়ে না—বহু পুরোনো এই বচন কিন্তু রাজনীতিকেরা প্রায়ই ভুলে যান।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সরকারি প্রশ্রয়ে মৌলবাদের যে রমরমা অবস্থা—এটি পাপ। এটি হওয়ার কথা ছিল না। শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতাসীন, হয়তো তিনি আরও কিছুদিন থাকবেন, থাকুন, কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই? চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন, শেখ হাসিনা–উত্তর বাংলাদেশের কথা? শিউরে উঠছেন? বর্তমান ভুঁইফোড় বঙ্গবন্ধু প্রেমিকেরা তখন কোথায় থাকবেন, কে জানে?

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, যুক্তরাষ্ট্র শাখা বঙ্গবন্ধু পরিষদ
ইমেইল: [email protected];