অবিস্মৃত আইভি রহমান

আইভি রহমান
আইভি রহমান

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৪ সালে। নিহত হারিয়েছিলেন ২২ জন। আহত-পঙ্গু-ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন প্রায় শতাধিক। সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিচার চলল প্রায় ১৪ বছর। রায় বেরোল ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। ১৯ জনের ফাঁসি, ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেন আদালত। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সেই গ্রেনেড হামলার নির্মম শিকার। সেদিনের সরকারি দল বিএনপি রায়-কালে বিরোধী পক্ষে। আর সরকারের নেতৃত্বে প্রাচীন আওয়ামী লীগ। রায়ে বিএনপির শীর্ষ নেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই সাজা পেলেন। এই রায়কে তাই বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণাও দিয়েছে।
বিলম্ব হলেও বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদেনি। বিচার হলো, রায়ও হলো। এই ঐতিহাসিক দিনটিতে বারবার উদ্ভাসিত হচ্ছে সেই অবয়বটি। সেই স্মৃতিস্বর্ণে মোড়ানো হাসিমুখ, যা আমাদের কাঁদায়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার শিকার সে এক মরমি-মায়াবিনী; আইভি রহমান।
শেষ দেখা ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট। ঢাকার ৩৩ তোপখানা রোডে নিউজব্যাংক হলে। হলরুমটি চলত আমাদেরই পরিচালনায়। আমাদের ‘সাদাকালো’, নিউজব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ভাড়ায় অনুষ্ঠান-আয়োজন চলত প্রায় প্রতিদিনই। ১৮ আগস্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর ২৯তম শাহাদতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তা ও অতিথি আইভি রহমান। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি যেমন অবিচ্ছেদ্য, তেমনি চির-সৌন্দর্যে সৌকর্যময় রমণী। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন ২০০২ সাল পর্যন্ত। নেতৃত্ব দেন মহিলা সমিতি ও জাতীয় মহিলা সংস্থায়। আমাদের নিউজব্যাংক হলে এসে সেদিন আসর আলোকিত করলেন তিনি।
প্রধান অতিথি ছিলেন রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আওয়ামী লীগ তখন সরকারে ছিল না। ২০০১ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা হারিয়েছে। ক্ষমতাকালে সুরঞ্জিত বাবু ছিলেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ছিলেন বিরোধী পক্ষে। অনুষ্ঠানে আইভি রহমান সেই প্রসঙ্গটি টানলেন। বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মা আজ শান্তি পাচ্ছে। কারণ, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে যাদের কাছ থেকে চরম আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। আজ ওনাদের অনেকে নিজেদের সংশোধন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর গুণ-কীর্তনে ওনারা বেশ মুখর। এটি দেশরত্ন শেখ হাসিনার কৃতিত্ব। আমার রাজনৈতিক জীবনও আজ ধন্য। এখন মরেও আর অতৃপ্তি নেই। কারণ, ওপারে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে এই শুভ সংবাদটি দিতে পারব। চামড়া খুলে ডুগডুগি বাজানিয়ারা এখন সুর ও স্বর পাল্টেছে।’
আইভি রহমানের রসসিক্ত কটূক্তি বেশ উপভোগ্য ছিল সেদিন। রাজনীতিক, অ্যাডভোকেট মতিন খসরুও অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সদ্য-সাবেক আইন ও বিচারমন্ত্রী। তখন তাঁরও অফিস একই ‘মেহেরবা প্লাজাতে’ই। আমাদের এক তলা নিচে। অনুষ্ঠানে বেশ সমঝোতামূলক বক্তব্য রাখলেন তিনি। বললেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ভিন্নমতাবলম্বীরাও এখন এক কাতারে মিলতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে যারা, তাঁদের স্বাগত জানাই। আওয়ামী লীগ এক বিশাল সাগরসম দল। এখানে সমমনারা লীন হয়েছেন, অসুবিধে কী?’
অনুষ্ঠান শেষে চলল বহুমাত্রিক আড্ডা। আমি তখন রিপোর্ট পাঠাই আমেরিকার ঠিকানায়। বিশেষ সংবাদদাতা, আবার ঢাকায় ‘সাদাকালো’ সম্পাদক। আমার উদ্দেশ্যে অ্যাডভোকেট মতিন বললেন, ‘দুটো অনুরোধ করব। প্রথমত, রিপোর্টটা একটু বিস্তারিতভাবে পাঠাবেন। আমাদের না হোক, আপার ছবিটা যেন থাকে। আরেকটা বিষয়, হলরুমের ভাড়াটা একটু কমিয়ে নেবেন।’
আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। সিইও হিসেবে বললাম, ‘মাত্র দেড় হাজার টাকা। একবেলার সর্বনিম্ন হারের ভাড়া। যাদের সংগতি নেই, তাদের জন্য কমানো হয়।’ আইভি আপা বললেন, ‘আমরা এখন ক্ষমতাহীন। তাহলে তো কিছু সুবিধে পাওয়া যাবে।’ আমিও সম্মতি দিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই।’ হলরুমের কেয়ারটেকারকে ডাকলাম। হিসাবে দেখলাম ৫০০ টাকা অগ্রিম। এক হাজার বাকি। বললাম, ‘৫০০ টাকা মওকুফ করা হলো। চলবে আপা?’ বললেন, ‘বাহ্, হাওয়া দিয়েই ছাড় পাওয়া গেল।’
এরপর পুরো এক হাজার টাকাই বের করে দিলেন। বললেন, ‘৫০০ টাকা ভাড়া বাবদ। আর ৫০০ টাকা দিয়ে আমাদের নাশতা করান। কী বলেন, সুরঞ্জিত দা?’
প্রতি উত্তরে আবার রসযুক্ত সংলাপ। নীরবতা ভেঙে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন, ‘বকাও খাওয়াবেন। আবার চা-নাশতা দিয়ে আপ্যায়নও করাবেন। প্রধান অমাত্য বানিয়ে দাওয়াত করে আনবেন। আবার মঞ্চে বসিয়ে ধোলাই কাব্য ঝাড়বেন। নারী কূলের রাজ্যে সকলই গরল ভেল। চলুক, যেভাবে চালাতে চান, চলতে থাকুক।’
এল তোপখানা রোডের বিখ্যাত মোগলাই পারাটা। ২০০৪ সালে ৫০০ টাকা মানে অনেক টাকা। চলল সান্ধ্যকালীন আপ্যায়ন-আড্ডা। রাত ক্রমশ বাড়ল। যে যার মতো গন্তব্যের দিকে ছুটল। শূন্যতা নেমে এল সরগরম নিউজব্যাংক হলে।
কী এক চমক দিয়ে চলে গেলেন আইভি আপা। এক বিকেলেই কত আপন করে নিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শই যেন তাঁর অতল বুকের পুঁজি। স্বামী জিল্লুর রহমানও আওয়ামী লীগের শীর্ষ রাজনীতিক। একমাত্র ছেলে নাজমুল হাসান পাপন তখন বেক্সিমকো ফার্মায়। ফার্মাসিস্ট ও প্রধান নির্বাহী। দুই মেয়ে তানিয়া ও ময়না তখনো অধ্যয়নরত। আইভি আপার পুরো নাম জেবুন্নাহার আইভি। জন্ম ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই। পৈতৃক বাস কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে। নদীর বৈভবে কাটানো শৈশব-কৈশোর। বাবা জালালউদ্দিন ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। আট বোন-ভাইয়ের সংসারে দেখেছেন কলতান। এ জন্য রাজনৈতিক জীবনে মানুষের ভিড় দেখে ভয় পান না।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভা ছিল মুক্তাঙ্গনে; সচিবালয় ও আব্বাসউদ্দিন চত্বরসংলগ্ন সভাস্থলটিতে। পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সেভাবেই অনুমতি নেওয়া। কিন্তু সভার দু ঘণ্টা আগে বদল হয় সিদ্ধান্ত। দল সিদ্ধান্ত নেয়, সভা হবে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে, আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে। আকস্মিক এই স্থান পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক হয় বিস্তর। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে, ইতিহাসের আরেকটি কালো দিন ২১ আগস্ট। দলনেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালে মরণঘাতী গ্রেনেড হামলা হলো। বিদেশ থেকে আমদানি করা আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়েছিল হামলায়। স্প্রিন্টার বিঁধল শতাধিক নেতা-কর্মীর শরীরে।
সেদিন পরিবর্তিত সভাস্থলে নতুন করে আর মঞ্চ গড়া যায়নি। দুটো ট্রাককে দাঁড় করিয়ে বানানো হয়েছিল সভামঞ্চ। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই ট্রাকের ওপরে। আর দর্শকসারির সম্মুখেই ছিলেন আইভি রহমান। কোলাহলপ্রিয় পরিবেশকেই বেছে নিয়েছিলেন। ফলে, কেন্দ্রীয় নেতারা বাঁচলেও তিনি সুরক্ষিত থাকলেন না। স্প্রিন্টারে বিক্ষত হলো শরীর। হাসপাতালে নীত হলেন। তিনটি অস্থির দিনের উদ্বিগ্নতার অবসান ঘটালেন মৃত্যু দিয়ে। জাতীয় শোকের মাসে রেখে গেলেন আরেক শোকের স্বাক্ষর। জীবন পাতায় লেখা হলো—দেহাবসান ২৪ আগস্ট, ২০০৪।
অভিশপ্ত ২১ আগস্ট কেড়ে নিল ২২টি তাজা প্রাণ। শোকে-সমবেদনায় অস্থির আইভি আপার সহকর্মী-শুভানুধ্যায়ীরা। আবার এলেন অনেকে শোক-সমাবেশের প্রস্তাব নিয়ে। উদ্যোক্তারা হলরুম ভাড়া নিতে চান। বললাম, ‘হলরুম ব্যবহার হোক, তবে ভাড়া লাগবে না। আইভি আপার স্মৃতিতে প্রতি বছর আয়োজন হোক। আমাদের সাধ্যে যতটা কুলায়, সাহায্য করব।’ অবশেষে তিন দিন পর আয়োজিত হলো স্মৃতি-তর্পণ অনুষ্ঠান। ১৮ আগস্ট যিনি ছিলেন সভাধিপতি। আজ তিনি স্মৃতির মণিমঞ্চে। আমরা হৃদয়-প্রাণ উজাড় করে শ্রদ্ধা জানালাম।
বাকি ইতিহাস অধিকাংশ বাঙালির জানা। স্বামী দেশের মহামান্য জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। অতঃপর আকাশের ঠিকানায় চলেও গিয়েছেন। সন্তান জনপ্রতিনিধি ও জন পরিচিত হয়েছেন। আইভি আপা এই সুবর্ণধারার দিনগুলো উপভোগ করতে পারেননি। ‘রাজনীতির ত্যাগ’ নামের তিন ভাগ জলমগ্নতা দেখেছেন। একভাগ স্থলভূমির আনন্দকে উপভোগ করেছেন কদাচিৎ। বিদেহী আত্মার প্রতি আমাদের চিরন্তন শুভকামনা। আইভি আপার স্মৃতিমুখ আমাদের মাঝে চির-আদৃত। জনরাজনীতির চির-অবিস্মৃত এক মায়াবী মানবী তিনি।