আগে কি সুন্দর দিন কাটাতাম!

দেশে গেলে আজও সেই মমতার খোঁজে খুঁজে বেড়াই সেই হোসেনের বাড়ির আড্ডার কোলাহল। সেই ‘সিকির’ দোকানের আড্ডা। ‘সিকির’ চায়ের স্টল, চুনু মামার দোকান, ছালই ভাইয়ের পান বিড়ির দোকান, কিংবা হোসেন ফার্মেসি অথবা মান্নান মিয়ার কাপড়ের দোকান, আড্ডার অনেকেই আজ বেঁচে নেই। অনেকে আবার বৃদ্ধ, যারা বেঁচে আছেন দেখা হলে বিগত দিনের ঝলমলে স্মৃতি টেনে অনুশোচনা করেন। বর্তমানকে সামনে এনে দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে পর্যালোচনায় চোখের পানি ছাড়েন, স্মরণে টানেন সেই মায়াময় প্রাণের আকুলতার কোলাহলের দিনগুলো।

সেই কালের খোলা মনের, নিঃস্বার্থ উদাত্ত, আত্মার সাথিদের—প্রয়োজনে যারা রক্ত দিতে দ্বিধা করতেন না, বন্ধুদের সেই স্পন্দন, সেই ঝলমলে সকাল, দুপুর, বিকেলের প্রহর। সেই স্বার্থহীন বন্ধুত্ব, সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, সেই শ্রদ্ধা। সেই আনন্দের বন্যা, সেই পরিবেশ।

আজকের বিবর্ণ পরিবেশ দেখে পূর্বসূরিরা হতাশা প্রকাশ করে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য। সবই যেন দিনে দিনে অবনতির পথে, মনমানসিকতা উন্নয়নের কোনো লক্ষণ নেই বা অপূর্ণতায় ভরপুর। সবাই যেন স্বার্থ বৃত্তে আটকে পড়েছে, দিক দিগন্তের শুভযাত্রায় ওঁদের নিজেদের নেই কোনো সদিচ্ছা, ছাউনিহীন প্রাসাদে ওদের যাপিত জীবন, রোদ বৃষ্টি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক, সবই মনে হয় কালো ছায়ায় আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। নেই তাদের জীবনের কোনো লক্ষ্য, নেই তাদের পরিবার–পরিজনের কোনো চিন্তা। নোঙরবিহীন তরী ধাক্কায় ছোটাছুটি এদিক-ওদিক। কুলাঙ্গার কারও ইশারায় ধাবিত হচ্ছে অতল গহ্বরে, বিচ্ছিন্ন হচ্ছে সমাজ থেকে, নিজের দিন–রাতের সাথি বন্ধুকেও হত্যা করছে হেসে হেসে। আসক্ত হচ্ছে মাদকে ও জুয়া খেলায়।

১৯৭৬ সাল এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অবসর সময়, ফলাফল প্রকাশের অধীর অপেক্ষা, আড্ডার সুবর্ণ সুযোগ। বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে বিরামহীন আড্ডা, পরিবারের নেই তেমন বাঁধা বিপত্তি। যদিও বাবার কড়া শাসন, কিন্তু মা আমাকে সমর্থন করত। মা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, এইমাত্র ছেলে পরীক্ষা শেষ করেছে, রাতের পর রাত জেগে পড়াশোনা করেছে। এখন একটু রিলাক্স করুক, এগুলো সব বাচ্চারা করে। মা বাবাকে থামিয়ে দিত, মা হাতে তুলে দিত আড্ডার টাকা, সকালের নাশতা পানি সেরে গোলাপগঞ্জ।

সে সময় ছিল না এখনকার তুলনায় হাইফাই চায়ের দোকান কিংবা আড্ডার স্থান। আবিষ্কার হয়নি সেকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কিংবা সেলফোন। নির্দিষ্ট স্থানে একে অন্যের অপেক্ষাই ছিল মাধ্যম। চুনু মামার দোকানে ছিল সবার মিলিত হওয়ার নির্দিষ্ট স্থান। একে একে চেরাগ ভাই, কাদির ভাই, ফারুক ভাই, সিরাজ ভাই, ছখাই ভাইসহ অনেকে জড়ো হতো। হামেশা চুনু মামার চায়ের আপ্যায়ন চলত, দোকানের অপর পাশে নুরুউদ্দিন ভাইয়ের চায়ের দোকান, আঙুলের ইশারায় অর্ডার। আড্ডার প্রথম পর্ব সমাপ্তি টেনে সিকির হোটেলে।

সেখানে অপেক্ষায় অন্য টিম। তাস খেলার টিম। সিকির হোটেলের পেছনে রয়েছে বেশ জায়গা, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি দিয়ে সাজানো রয়েছে বসার আসর। বিভিন্ন গ্রুপে, কেউ টুয়েন্টি নাইন, আবার কেউ কলব্রিজ খেলত। অনাবিল আনন্দ–উল্লাস, নেই কোনো টাকার ব্যাপার–স্যাপার। হেরে যাওয়া টিম শুধু চা–নাশতার বিল পরিশোধ করত, তাও সব সময় প্রযোজ্য না। হাসি–তামাশায় শেষ হতো দিনের সমাপ্তি।

সিকির হোটেলের টিম লিডার সবার কমন পাখি চাচা। হেরে গেলে পাখি চাচা উত্তেজিত, যদি জেতা হত, তবে পাখি চাচা টেবিলের ওপর আঙুলের তাল-বেতাল বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গিয়াস ভাই পাশে বসে কৌতুক শোনাতেন। সবাই আগামীকাল আবার দেখা হবে—এই আনন্দে বিদায় নিত।

সিনিয়র–জুনিয়র মিলে মহাদুমদাম, নেই কলহ, নেই হিংসা, নেই কোনো অহংকার, নেই কোনো ভেদাভেদ। কারণ সেখানে ছিল না কোনো অসামাজিক কার্যকলাপ। এদিকে মান্নান মিয়ার কাপড়ের দোকানে চলছে লুডু খেলা, সেটাও চা–পানির বাজি। দলে দলে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আড্ডা, ভালোবাসার আড্ডা, আজও স্মরণে নেই কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার।

কলেজ–ভার্সিটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই চলে যেতেন যে যার গন্তব্যে। প্রয়াত মান্নান মিয়ার দোকানে, হোসেইন ফার্মেসি, প্রয়াত স্বর্ণের ব্যবসায়ী ছালেহ ভাইয়ের স্টোরে সামান্য ঢুঁ মেরে, ছালই ভাইয়ের দোকান থেকে পান বিড়ি নিয়ে সবাই যার যার গন্তব্যে ফিরে যেত।

এগুলো ছিল আগেকার দিনে অনেকের প্রতিদিনের রুটিন। ২০১৮ সালে দেশে গিয়ে দেখি, অনেকেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। মান্নান মিয়া, ছালেহ ভাই, কাঁচা মিয়াসহ অনেকে। বেঁচে আছেন হোসেন ভাই, তবে বয়সের ভারে দুর্বল।

সে সময় রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না গ্রামে–গঞ্জে। বাবাজিদের শ্বাস–প্রশ্বাসের মৃদু হাওয়ার পরশ কম পরিমাণে ছিল বিদায় হয়তো স্বস্তি ছিল, এটা সেকালের লোকজনের অভিমত। যুগের ব্যবধানে গ্রামেগঞ্জে রাজনীতি প্রসারিত হয়েছে। সেটি মন্দ না, কিন্তু সহিংসা পরিহার করা জরুরি। পাশাপাশি একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা থাকতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের এসব বিষয়ে খেয়াল নজর রাখলে সামাজিক মানসিক উন্নয়নের প্রতিফলন আসবে বলে সবার বিশ্বাস। যারা অসামাজিক কাজে বিশেষ করে মাদক, জুয়া, চুরি, ডাকাতি—এদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে সমাজের স্বার্থে পুলিশকে সহযোগিতা করতে হবে। এমনটাই আশা করেন দেশের মানুষ।