সুস্থ সমাজ গঠনে নীতি শিক্ষা

ভালো ও মন্দ (সু এবং কু)—এই দুটি ভাব বা প্রবৃত্তি আমাদের মনোজগতে সদা বর্তমান—এমনটিই বলেন মনোবিজ্ঞানীরা। একটি জাগ্রত থাকলে অপরটি থাকে সুপ্ত। শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ যেমন একসঙ্গে চলে না, একটির পর অন্যটি আসে, তেমনি এ দুটি প্রবৃত্তির মধ্যে একটি ক্রিয়াশীল হলে অপরটি সুপ্ত হয়ে থাকে। কখনো এ দুটি একসঙ্গে ক্রিয়াশীল বা সক্রিয় থাকে না। যে প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়, একজন মানুষের প্রকৃতিও (চরিত্র) সেই প্রবৃত্তির অনুবর্তী হয়। অর্থাৎ সু-প্রবৃত্তির প্রভাবে মানুষ সৎ এবং কু-প্রবৃত্তির প্রভাবে মানুষ অসৎ প্রকৃতির হয়। এ কারণেই কালে কালে বিজ্ঞানীরা কু-প্রবৃত্তি দমন বা জয় করার জন্য নানা পন্থা-পদ্ধতির কথা বলে দিয়েছেন বা নানা উপদেশ দিয়েছেন।

যেহেতু জন্মলগ্ন থেকেই আমরা এই দুটি প্রবৃত্তির বাহক, সুতরাং শৈশবকাল থেকেই এগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে কু-প্রবৃত্তিটাকে জয় করে বা দমন করে আমাদের সু-প্রবৃত্তির দ্বার খুলে দিতে হয়। আর এ জন্যই প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণ। উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধ হয়। সৎকর্মে প্রবৃত্তি আসে এবং তার চিন্তায়, কর্মে, চলনে-বলনে এর প্রতিফলন ঘটে। উপযুক্ত শিক্ষালাভের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে থাকা সু-প্রবৃত্তিগুলো বিকশিত হয় এবং পরবর্তীতে এগুলোরই প্রভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনও সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠে এবং সু-প্রবৃত্তি বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কু-প্রবৃত্তিগুলো অবদমিত হয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এসবের কোনো প্রভাব তখন আর থাকে না।

কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষালাভের অভাবে আমাদের মধ্যে থাকা সু-প্রবৃত্তিগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকে। আর এরই ফাঁকে কু-প্রবৃত্তিগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে এবং স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তি জীবনকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে। শুধু তাই নয়, ওই ব্যক্তির চিন্তায়, কর্মে, আচার-ব্যবহারে প্রভাব বিস্তার করে। আর ব্যক্তিটিও এর দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে এই শ্রেণির মানুষই নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পরিবার, সমাজ তথা দেশের নানাবিধ ক্ষতিসাধন করে। তাই একটি সুস্থ, সুন্দর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন গঠনের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা লাভের প্রয়োজন অপরিহার্য।

‘শিক্ষা’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই শিষ্টাচার, আর তা অর্জনের ক্ষমতাই-শিক্ষা বা শিক্ষাপদ্ধতি। আবার শিষ্টাচার বলতে তা-ই বোঝায় যা সর্বকালে, সর্বস্থানে সবার কাছে গ্রহণীয় বলে স্বীকৃত এক প্রকার কলাকৌশল বিশেষ, যার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে থাকা সু-প্রবৃত্তিগুলো বিকশিত হয়। পণ্ডিত ব্যক্তিদের ভাষায়-মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণত্বের বিকাশ সাধনকে বলে শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্ব দেয়। সত্য ও সুন্দরের দিকে আকৃষ্ট করে, মানবিক মূল্যবোধে তাঁকে সাজিয়ে তোলে। প্রকৃতি শিক্ষার প্রভাবে তার মধ্যে আসে স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসার প্রবৃত্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ আর অপগত হয় হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, লোভ-লালসা ইত্যাদি। এরূপ একজন মানুষই পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের সম্পদ বিশেষ।

শিক্ষাক্ষেত্রের পরিধি বিশাল, আমৃত্যু শিক্ষাগ্রহণের কাল। আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আছে বিভিন্ন স্তর, বিভিন্ন ধারা, বিভিন্ন পর্যায় এবং বিভিন্ন পদ্ধতিও। প্রতি ক্ষেত্রের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ, জনসেবা ও আত্মিক উন্নতি। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে, যখন আমরা কু-প্রবৃত্তিকে দমন করে সু-প্রবৃত্তির অনুবর্তন করতে পারব। এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হলো নৈতিকতার নবজাগরণ। নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হতে না-পারলে কোনো শিক্ষাই কখনো ফলদায়ক হবে না। অপ্রিয় হলেও সত্য, আজকাল প্রায়ই দেখা যায় নীতিবোধের অভাব হেতু একজন উচ্চশিক্ষিত লোক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক, শিক্ষক, জননেতা কিংবা অন্য কেউ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এই শ্রেণির লোক তার পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও ত্রাসের সঞ্চার করে, জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে, সার্বিকভাবে সমাজকেও কলুষিত করে। শুধু তাই নয়, এঁদেরই কুট কৌশলের বিষময় ফলস্বরূপ নেমে আসে সামাজিক অবক্ষয়। যার ফলে জনজীবন হয়ে যায় বিপর্যস্ত, পর্যুদস্ত, অসহনীয়। অতএব দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র তখনই সুন্দর হয়, যখন প্রতিটি ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র পরিশুদ্ধ হয়। তাই প্রয়োজন শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে নীতিশিক্ষার প্রচলন ও প্রসার ঘটানো যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী হতে পারে।

আমাদের দেশীয় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরই হলো নীতিবিষয়ক শিক্ষা গ্রহণের মুখ্য কাল। আজকের শিশু-ছাত্র-যুবারা ভাবীকালের নাগরিক। ওদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের। তাই সর্বাগ্রে নীতিবিষয়ক পাঠদান জরুরি। কেন না, নীতিকথা, নীতিমালা বা হিতোপদেশ কোমলমতি শিশু-ছাত্র-যুবাদের মনে যেভাবে রেখাপাত করতে পারে, পরিণত বয়সে তা আর সেইরূপ হয় না। ওই সময় নীতিবিষয়ক শিক্ষা তাদের মনে যে বীজ বপন করে, ভবিষ্যতে তা মহিরূপের আকার ধারণ করে সমাজে ফুল-ফল ও ছায়া বিতরণ করবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজকের শিশু-ছাত্র-যুবরা নীতি শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে প্রায় বঞ্চিত হয়েই আছে। আমরা, অভিভাবকরাও ‘হিরেকে কাচ’ ভেবে নীতিশিক্ষার প্রতি উদাসীন হয়ে আছি।

আধুনিকতার নামে আজ আমরা নানা অপসংস্কৃতির অনুকরণ করে আত্মপ্রসাদ লাভে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তথাকথিত আধুনিকতার মায়াবী ছলনায় স্বকীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে আধুনিকতার ধ্বজাধারীরূপে গৌরব অনুভব করছি। আর এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সামাজিক অবক্ষয়। তাই দেখা যায়, সমাজ জীবনে স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসা প্রায় অবলুপ্ত, শ্রদ্ধা-বিনয় অদৃশ্য, দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারে সামাজিক পরিমণ্ডল কলুষিত। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদি স্বাভাবিক জীবনকে ছন্দহীন করে তুলেছে। অপকর্মে লিপ্ত থাকাটা যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই কুপ্রভাবে আমাদের শিশু-ছাত্র-যুবারা দিন দিন মানসিকভাবে আহত হয়ে বিপথগামী হতে চলেছে। সত্ত্বর এদের নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে সার্বিক অবক্ষয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কবির ভাষায়—

‘এই সব মূঢ় ম্লান-মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা,
এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্নবুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।’

আর এ কাজের জন্য শিশু-ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে নীতিশিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটানো আবশ্যক। এতে মানসিক ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতা আসবে। ব্যবহারিক শিক্ষালাভ যেমন আবশ্যকীয়, তেমনি ওই শিক্ষার যথোপযুক্ত ব্যবহারে নৈতিক শিক্ষার পাঠ নেওয়াও ততধিক আবশ্যক। তবেই একজন শিক্ষার্থী যথাসময়ে অর্জিত বিদ্যা নিয়ে সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে এবং দেশ ও সমাজ তাঁর সেবায় অবশ্যই উপকৃত হবে। আর এ কারণে নীতিশিক্ষা যে অপরিহার্য, তা বলাই বাহুল্য।