আঞ্চলিক রাজনীতি ও উপনিবেশবাদের প্রভাব

পৃথিবীর সব দেশে সব যুগে রাজনীতি ছিল ও আছে। নিতান্ত দেশ প্রেমের তাড়নায় মানুষ রাজনীতিতে অংশ নেয়। তবে রাজনীতির পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ হয় না, এটি জেনেবুঝে একজন মানুষ রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনীতির মাত্রা আলাদা আলাদা। যেমন ইউরোপের দেশগুলোর রাজনীতির বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম। তবে এশিয়া-আমেরিকা-আফ্রিকার দেশগুলোর রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন রকম। কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে রয়েছে ভিন্ন মাত্রা। কেবল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে কোনো রাজনীতি নেই। এখানে বংশানুক্রমে তৈরি হয়েছে শেখ শাসিত ডাইনেষ্টির শাসন। এর বিরুদ্ধে টু শব্দ করার কোনো জায়গা নেই। আর করলেই রক্তমাংসের দেহ থেকে মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নির্ঘাত। আধুনিক সভ্য জগতে এরা এক ধরনের মধ্যযুগীয় বর্বর, অসভ্য। এদের বিরুদ্ধে বিশ্বের কোনো গণতন্ত্রকামী নেতৃত্ব, মানবতাবাদী নেতৃত্ব মুখ খোলার সাহস পায় না। যার ফলে এদের ডাইনেষ্টি শাসনে অগ্ন্যুত্পাত ঘটার কোনো কারণ নেই। তাদের সামনে নেই কোনো চ্যালেঞ্জ, ফলে যুগের পর যুগ তাদের শাসন এভাবে চলতে থাকবে নিরাপদে। মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়ায় বা সংবাদপত্রে কোনো মানবাধিকার কর্মী বিড়ালের মতো মিউ মিউ ডাক হাঁকিয়ে আবার মৃত্যু ভয়ে অন্ধকারে বিলীন হয়ে যায়।

ইউরোপের দেশগুলোর মতো অস্ট্রেলিয়া, কানাডার রাজনীতি স্থিতিশীল, এখানে নেই কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরির সুযোগ। সময় আসলে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়ে যায়, ক্ষমতার পালা বদল হয়। কোনো ব্যতিক্রম কিছু এ যাবৎ চোখে পড়েনি। এককালে মার্কিন রাজনীতিও ছিল বিশ্বরাজনীতির গণতন্ত্রের মডেল বা সূতিকাগার, তবে সেই ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গেছে জর্জ ডব্লিউ বুশ, যাকে সিনিয়র বুশ বলা হয় তার কারণে। ব্যক্তি জীবনে যদিও বুশের বিশাল বর্ণাঢ্য জীবন ছিল, তিনি ছিলেন বিচক্ষণ খেলোয়াড় আর দাপুটে। ক্ষমতায় থেকে মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে সেরা ব্যবসায়ী আর বর্ণ বৈষম্যবাদী নেতাদের দিয়ে ক্যাবিনেট তৈরি করে বর্ণবাদ আর ঘৃণার অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন এবং প্রশাসনে নিজের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখে নিজের ছেলের জন্য জায়গা তৈরি করে গেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি। এই মার্কিন রাজনীতিতে যে অস্থিরতা আর বৈষম্য তৈরি হয়েছে, আমেরিকার স্বাধীনতার পর কোনো মার্কিন অথবা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ এমন দৃশ্য দেখেনি। সারা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে ধারণা ছিল, মার্কিন ও ব্রিটিশ রাজনীতি ছিল একটি মডেল আর এই দুটি দেশের রাজনীতির ঐতিহ্যকে মানুষ শ্রদ্ধা করত, মেনে চলতো।

যত অস্থিরতা, অনিয়ম, বৈষম্য, ক্ষমতা থাকার প্রবণতা, স্বৈরাচারীর ক্ষমতা দখল—সব প্রক্রিয়া চালু রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। আর সেই কারণে এসব এলাকার মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে এসব মেনে নেওয়ার প্রবণতা। অনিয়ম, বিশৃঙ্খলাকে তারা মেনেও নিয়েছে জীবনযাত্রার অঙ্গ হিসেবে। কেন এমন হলো, সামান্য ব্যাখ্যা দিলে বুঝতে সহজ হবে। এককালে এ অঞ্চলে মোগল শাসকেরা ছিল খুব দাপুটে প্রভাবশালী ও বিলাসী। তাদের মধ্যে কিছু কিছু ভালো শাসকও ছিলেন, যেমন সম্রাট আকবর। সম্রাট শাহজাহান ছিলেন যুগসেরা শাসক। শাসক হিসেবে তারা যেমন ছিলেন সেরা, সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম ইতিহাস–ঐতিহ্য সংরক্ষণে তারা ছিল সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষ। তবে মোগল শাসকদের বিলাসী জীবন, অতিরিক্ত ব্যয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে শূন্য করে দিয়েছিল। যেমন ময়ূর সিংহাসন তৈরি, যমুনার তীরে স্ত্রীর ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাজমহল নির্মাণ। এটি সুন্দরতম একটি সৃষ্টি যা পৃথিবীর সব ভালোবাসাকে হার মানায়, যেখানে খরচ হয়েছিল তৎকালীন সময়ে ২০ কোটি রুপি, বিশ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল এটি নির্মাণ করতে। নির্মাণশৈলী কারুকার্যখচিত ভিন্ন মাত্রার স্থাপত্যের নিদর্শন থাকলেও এটি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ছিল এবং এটি হয়েছে সম্পূর্ণ আবেগ থেকে, যা রাজনীতিতে কখনোই কাম্য নয়।

সময়ের ব্যবধানে তাদের ইতিহাসের পাতায় কেবল ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকতে হয়েছে, আর কোনো কিছুতেই নেই তারা। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসল, দখল করে নিল ভারতবর্ষ। সেটি ছিল ১৭০০ শতাব্দীর কথা। প্রথম ভাইসরয় ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ, ওয়ারেন হেষ্টিংস...এরা ছিলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্বপ্নদ্রষ্টা, যারা পরবর্তীতে গোটা ভারতবর্ষ দখল করে নেয়। তাদের নামটা ছিল এ রকম East India Company, English trading Company, Finally 1600-1708 governor and company of merchants of London trading into the east India or (1708-1873) United company of merchants of England trading to the east indies. English company formed for the exploitations of trade with east and south east Asia and India in corporate by Royal Chester on December 31,1600. Starting a Monopolistic trading body, the company become involved in politics and acted as on agents of British. Imperialism in India from early 18 century to the mid 19 century.

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত উপনিবেশবাদ আমাদের এতটা জেঁকে ধরে রেখেছিল যে, আমরা মোটামুটি আমাদের স্বাধীন সত্তা, মুক্তচিন্তা, জাতীয়তাবোধ—সবকিছু উপনিবেশবাদের কাছে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। আমরা শেষ পর্যন্তই বের হতে পারলেও দুশ বছরের বেশি সময় লেগে গেছে। দুই শতাব্দীর বেশি সময়। দুই শ বছরের পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, দুটি আলাদা দেশ পেয়েছিলাম। স্বাধীনতার স্বাদ কিছুটা পেলেও আবারও ২৪ বছর পরাধীনতার গ্লানি আমাদের পোহাতে হয়েছিল। আর সেই গ্লানির নৃশংসতা ছিল আরও ভয়াবহ আর অমানবিক। আমরা সেটিও জয় করতে পেরেছি আমাদের বাঙালিত্ব দিয়ে, বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা দিয়ে। আর যিনি বীরত্বের সঙ্গে এ কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা, কালজয়ী এক অকুতোভয় নির্ভীক মানুষ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও জীবন দিতে হলো সেই কিছু বাঙালির নৃশংসতার শিকার হয়ে। আর এই হত্যার পরিণতি কি দাঁড়াল? জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীন হলেও আবারও নিজেদের মধ্যে বিভক্তি। এরপর ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, রাজাকার, জামায়াত নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে শক্তি বৃদ্ধি করলেও যুদ্ধাপরাধের দায় নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ভর করল খালেদা জিয়ার ওপর। ২০০১ সালে খালেদার মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নিয়ে গোটা বাংলাদেশকে, বলতে গেলে গোটা স্বাধীন জাতিকে বিলীন করার প্রক্রিয়ায় চলে গিয়েছিল। যার পরিণতি হিসেবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মতো ভয়াবহ হামলা চালানোর মতো ঘটনা ঘটাতে তারা সক্ষম হয়েছিল। অনেকটা সফলও হয়েছিল। ১১টি গ্রেনেডের সর্বশেষ গ্রেনেডটি শেখ হাসিনার মাথার ওপর টানানো শামিয়ানার ওপর পড়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল বলে রক্ষা। সে বোমাটি যদি সরাসরি আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর মাথার ওপর পড়ত, পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতো, একবার ভেবে দেখলে অনুমান করা যাবে।

আজ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়, নিশ্চয় দেশ–বিদেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত উচ্ছ্বাসিত আনন্দিত। বেশির ভাগ নিবেদিত নেতা–কর্মী, সাধারণ কর্মী–সমর্থক কোনো কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলেই তারা খুশি ও তুষ্ট থাকে। কেবল অতৃপ্তি আর অস্বস্তিতে থাকে দলের কিছু সুবিধাভোগী ও পদলোভী নেতা-কর্মীরা। তাদের একটা বড় অস্বস্তি কাজ করে, তারা প্রত্যেকে নিজেদের বড় বড় নেতা মনে করেন। তারা মনে করেন, তারা ছাড়া বাকিরা কোনো নেতার পর্যায়ে পড়ে না। আর যে বিষয়টি তাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে, তারা মনে করে তারাই কেবল ছাত্রলীগ করে আসা নেতা এবং তারা বুনিয়াদি আওয়ামী লীগ। যেকোনো মূল্যে তাদের পদ–পদবি পেতে হবে, এর জন্য যা যা করণীয় তা তারা করবেই। আর নিজেদের যোগ্যতার ঢোল পেটানোর জন্য প্রয়োজনে তৈরি করে রাজনীতির মঞ্চ আর এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথম নিজকে পরিচয় দেয় আওয়ামী লীগের নেতা বলে, আর সেই দলীয় টাইটেল ব্যবহার করে যে বিশুদ্ধ বাংলায় নিজ দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন, যা সত্যিই শ্রুতিমধুর, ছন্দময়ী আর শেক্সপিয়ারের সনেটের মতো।

সাধারণ মানুষ কান পেতে শুনে আওয়ামী লীগ নেতাদের বচন আর তখন তারা এই দল ও নেতা-কর্মীদের নামের পেছনে নতুন বিশেষণ যোগ করে হাসি–ঠাট্টা করে আর তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আর এসব নেতাদের আচরণে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাও আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগকে শুনতে হয় অশ্রাব্য গালিগালাজ আর তীব্র সমালোচনা। তাই লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম নিজের যোগ্যতা আর অযোগ্যতার প্রমাণের জন্য নিরাপদ জায়গা রাজনৈতিক মঞ্চ।

সামছুদ্দীন আজাদ
সহসভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগ