আমাজনে ধ্বংস, মানব সভ্যতার সংকট

আগে যখন দেশে ছিলাম, স্লোগান শুনতাম—‘জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো!’ সেটার অর্থ, কোনো সরকারের গদিতে আগুন জ্বালানোর ডাক।

এবার কিন্তু সত্যিই আগুন জ্বলছে, সারা বিশ্বে। এই আগুনে মানবসভ্যতাও পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা খুব দৃঢ় ভাবেই মনে করছেন।

আগুন জ্বলছে আমাজনে। আগুন জ্বলছে সৌদি আরবের পেট্রোলিয়ামে। এই বনের আগুন আর সংঘাতের আগুন নিশ্চয়ই কেউ জ্বালিয়েছে। কিন্তু এখন সেটা নেভাবে কে! নাকি সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য?

আমাজনের কথাতেই আসি। গোটা পৃথিবী শঙ্কিত। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন, জ্বলছে পৃথিবীর ফুসফুস। কি ভয়ানক কাণ্ড! এই আগুন আবার সরকারি মদদে মানুষই নাকি লাগিয়েছে!! তারা জায়গা বাড়াতে চায়, গাছের বাইরেও লাভজনক কলকারখানা করতে চায়। কৃষি ও পশুপালন বাড়াতে চায়। ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো নাকি এ রকমই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো। যিনি ব্যবসা বোঝেন, অক্সিজেন বোঝেন না।

গোটা পৃথিবী তোলপাড়। চলতি বছরে আগস্ট শেষ না হতেই মোট ৭০ হাজার আগুন লেগেছে, যার বেশির ভাগই জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষযোগ্য ভূমিতে পরিণত করার জন্য বুঝেশুনেই লাগানো হয়েছে। এই সংখ্যাটি গত বছরের পুরো ১২ মাসের তুলনায় নাকি ৮৪ ভাগ বেশি। যেই বনভূমিটি একাই পৃথিবীর শতকরা ২০ ভাগ অক্সিজেন উৎপাদন করছে, তার এই রকম আগুন প্রয়োগে, নিধনে আমি ভাবলাম, ব্রাজিলের সরকার বুঝি ভীষণই শরমিন্দা। কোথায় কী? কয়েকদিন আগে এনপিআরে ব্রাজিলের আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। গাড়ির মধ্যে সেটা শুনতে শুনতে আমার নিম্নরূপ তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো—

১. তাঁরা নিজের দেশের উন্নতির কাছে পরিবেশ দূষণ বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে ছোট করে দেখছেন
২. মানুষ অন্যের সিকি ভাগ অন্যায় দেখিয়ে নিজের হাজার ভাগ অন্যায় ঢাকতে চায়
৩. একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে আপনার (গোটা দুনিয়ার) কিচ্ছু করার নেই
৪. আপনার (বিশ্বের) সদুদ্দেশ্য গৃহকর্তার কাছে ভীষণই অসৎ এবং মতলববাজ মনে হতে পার

রাষ্ট্রদূত ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, গোটা দুনিয়ায় হইচই পড়ে গেছে। সবাই একেবারে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তেমন কোনো ঘটনা তো ঘটেনি! গোটা আমাজন পুড়ে যায়নি! এখানে–ওখানে বিচ্ছিন্ন কিছু ছোট আগুন লেগেছে মাত্র। তাতেই বিশ্ববাসীর ভাবসাব, যেন আমরা বিশ্বকে ধ্বংস করে দিচ্ছি!!

ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত আরও বললেন, আমাজন ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্য কোনো দেশের না। এটি আমাদের জঙ্গল। কাজেই...

সরকারের নীতির কারণে এমন হয়েছে শুনে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন এবং তখনই রাষ্ট্রদূত আমেরিকার উদাহরণ টেনে আনলেন। কই, ক্যালিফোর্নিয়ায় যখন আগুন ধরে, সে আগুন যখন কোনো মানুষ লাগিয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তখন তো কেউ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর অথবা আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে দোষারোপ করে না!

আমাজনে আগুন লাগাতে কেন প্রেসিডেন্ট বা তার নীতিকে দোষারোপ করা হচ্ছে?

হতেই পারে। একটা স্বাধীন দেশ তার জঙ্গল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতেই পারে। তাদের খেত–খামার করতে হবে, গরু-মোষ পালতে হবে, খনিজ পদার্থ তুলতে হবে, দেশের অর্থনীতি চাঙা করতে হবে। নিজের দেশেরই তো জঙ্গল। কেন নয়? তুমি দুনিয়ার মোড়ল অথবা উন্নাসিক ইউরোপ। নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে, যাও। জ্ঞান দিতে এসো না। পরিবেশ বিজ্ঞানীর অজুহাত দেখিও না।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের আগুন নেভানোর জন্য ২০ মিলিয়ন ডলার অনুদান বরাদ্দ করেছিল। অবশ্য অনুদানের এই ক্ষুদ্র সংখ্যাটি বলতে মিডিয়া থেকে শুরু করে সবাই কিঞ্চিৎ লজ্জা পাচ্ছিলেন। গোটা ইউরোপ আরেকটা দেশকে সাহায্য দিচ্ছে ২০ মিলিয়ন? আমি আরও লজ্জা পাচ্ছি, কারণ আমার বন্ধু সালামত (সে কে তা বলব না) বাংলাদেশ থেকে তো একাই ব্রাজিলকে ১০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিতে পারে!

যা হোক, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূতকে এনপিআর প্রশ্ন করল, ২০ মিলিয়ন ডলারে সামান্য হলেও তো আগুন নেভানোর কাজে লাগত। আপনারা নেননি কেন?

তেজি এবং চৌকস রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘কোনো শর্ত নিয়ে আমরা অনুদান নেব না। আমরা আগুন কীভাবে নেভাব, ইউরোপের টাকা দিয়ে কী করব, সেটা আমরা জানি। শর্ত দেবেন, দাদাগিরি ফলাবেন, স্রেফ তফাতে যান। আমাদের সমস্যা আমরাই মেটাব। হইচই করবেন না। মনে রাখবেন, আমাজন ব্রাজিলের...আর কোনো…নয়।’

ব্রাজিলিয়ান রাষ্ট্রদূত একদম এইভাবে বলেননি। আমি ভাবার্থ করলাম। দুইবার শুনেছি, তাই খুব বেশি ভুলও হয়নি।

এখানে আমরা বাইরের মানুষ, তাই ব্যাপারটার ‘বায়াস’ এবং ‘সমস্যা’ দেখতে পাওয়া খুবই সহজ। তার দেশপ্রেম আছে, নীতিগতভাবে আমাজন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আছে। কিন্তু বিশ্বপ্রেম নিয়ে বিশ্বের মানুষ কবে-কখন ভাবা শুরু করবে? সবকিছু থাকতে থাকতে? নাকি

সবকিছু পুড়ে যাওয়ার পর?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাজন এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা জঙ্গল যে, এর একাংশ নষ্ট করে ফেললে পৃথিবীর জলবায়ুতে স্থায়ী পরিবর্তন চলে আসবে। বাকি অংশটুকুকে কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না। বন উজাড় হলে বৃষ্টি কমে যাবে, তাতে গরম আরও বেড়ে যাবে, গাছপালা আরও নষ্ট হবে, তাতে বৃষ্টি আরও কম হবে। আমাজনে বৃষ্টির জন্য বনভূমি প্রয়োজন। সে কারণেই এটাকে বলা হয় আমাজন ‘রেইন্ ফরেস্ট’। বন ধ্বংস করতে করতে এমন একটা চক্র শুরু হবে, যেটাকে আর কোনোভাবেই ফেরানো যাবে না। গড়িয়ে পড়া পাথরের মতো তার গতিবেগ বাড়তেই থাকবে। ২০ থেকে ২৫ ভাগ বন ধ্বংস হলে এই ‘টিপিং পয়েন্টটা’ শুরু হবে। তখন আমাজনের বাকি অংশও বৃষ্টির অভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে, তাতে পুরো পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা থামানোর কোনো উপায় থাকবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ ভাগ ইতিমধ্যেই উজাড় হয়ে গেছে। আর ১০ থেকে ১৫ ভাগ উজাড় হলেই শুরু হবে গরম বাড়া এবং বৃষ্টি কমার নিরাময় অযোগ্য চক্র, যা দ্রুত পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে। এটি কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতায় কার্বন দূষণের ওপরেও মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো একটা ব্যাপার ঘটছে। আমাজন উজাড় হলে ব্রাজিলে বৃষ্টি কমে যাবে। আশপাশের দেশ, উরুগুয়ে প্যারাগুয়েতেও তাই হবে। তাপমাত্রা বাড়বে, এভাবে অমোচনীয় এবং উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা একটি সর্বগ্রাসী উত্তাপের মধ্যে পড়ে যাবে পৃথিবী। মানব প্রজাতির টিকে থাকা আক্ষরিক অর্থেই দায় হয়ে যাবে।

কত দিন পরে? না, সুদূরপ্রসারী কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়। পাঠকের মধ্যে অনেকের জীবদ্দশাতেই এমন ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু ব্রাজিলের নতুন সরকারকে বোঝায় কে? আমাজনের পুড়ে যাওয়া, তার সঙ্গে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ পুড়ে যাওয়া ঠেকায় কে? শুধু ব্রাজিল যে পরিবেশ দূষণ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা নয়। উন্নত বিশ্ব শত শত বছর ধরে বন উজাড় করেছে, ফসিল ফুয়েল জালিয়ে বায়ুমণ্ডলের বারোটা বাজিয়ে উন্নতি করে ফেলেছে। এখন যখন ব্রাজিল, চীন, ভারত, বাংলাদেশ—এমন সব সম্ভাবনাময় উন্নয়নশীল দেশের পালা, তখন তারাই মোড়ল সেজে বাঁধ সাধছে। ব্যাপারটা অবশ্যই ন্যায্য নয়। ব্রাজিলের কথায় কিঞ্চিৎ হলেও হয়তো যুক্তি আছে।

কিন্তু পরিণাম যে আসন্ন এবং ভয়াবহ!

বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই বলছেন। কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বড় ধরনের একটি গবেষণা থেকে বের হয়ে এল, গরুর মাংস খাওয়াই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রায় প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বলছেন, গবাদিপশু, তার মধ্যে গরুই প্রধান, পালতে গিয়ে যে পরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়, যে পরিমাণ জ্বালানি পোড়ান হয়, সেটাই প্রকারান্তরে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে। গবাদিপশুর বর্জ্য থেকে মিথেন তৈরি হচ্ছে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস। গরুর চারণ ভূমির জন্য বন-গাছপালা উজাড় হচ্ছে। তার জন্য খাদ্য তৈরি করা, ওষুধপত্র, তাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া জন্য যে ধোঁয়া তৈরি হয়, তারপর তাকে কাটা-ছেলা, প্যাকেজিং করা, রান্না করা—সবকিছুতে যে পরিমাণ ফসিল ফুয়েল পুড়ে, গাছ নষ্ট হয় সেই সব ক্ষতি মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আমি গরুর ভুনা মাংস খাচ্ছি আর পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

না, এর ভেতরে কোনো ষড়যন্ত্র নেই। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য মানুষই দায়ী। সেটা গাড়ির ধোঁয়া থেকে শুরু করে আমাজনের বন কেটে পুড়িয়ে সাফ করা থেকে গরুর মাংসের যথেচ্ছ ভক্ষণ; গরুর মাংস ভক্ষণই ফসিল ফুয়েল পোড়ানোর ঠিক পরের দাগেই দায়ী। সেই গবেষণা থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সপ্তাহে একদিনের বেশি মাংস খাওয়া পরিবেশের জন্য ঠিক হবে না। আমাজনের জঙ্গল উজাড় করার একটা বড় কারণ গবাদিপশু পালন। গরুর মাংস রপ্তানিতে ব্রাজিল পৃথিবীর সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে! ২০১৮ সালে তারা ৬ বিলিয়ন ডলার শুধু মাংসই রপ্তানি করেছে!

কাজেই অন্যকে দোষারোপের বাইরেও আমাদের নিজেদেরও এই পৃথিবী ধ্বংস/রক্ষায় বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তবে আমাজনকে রক্ষা করতেই হবে। না হলে পৃথিবীর এই এতদিনের মানব সভ্যতা আর কয়েক প্রজন্মের বেশি টিকতে পারবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। সেই সময়টুকুও হবে কঠিন, অগ্নিদগ্ধ সময়। যদি না আমাদের সবার, ব্রাজিল সরকারের, আমেরিকার সরকারের এবং আরও আরও যেসব দেশের সরকার বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ভাঁওতা বলে নিজ স্বার্থে উড়িয়ে দিচ্ছেন, তাদের বোধোদয় না হয়।