বাংলাদেশকে সিনেটর কেনেডির সমর্থন

কেনেডি পরিবার আমেরিকার রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এই পরিবার থেকে একজন প্রেসিডেন্ট ও একাধিক সিনেটর ছিলেন। এই পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবেও সুপরিচিত। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, যিনি ৪৭ বছর ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের প্রভাবশালী সিনেটর ছিলেন, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো সমর্থন দেন। সিনেটর কেনেডি আগস্ট মাসের প্রথম দিকে শরণার্থীশিবির পরিদর্শনে আসেন। তার এই পরিদর্শনের সংবাদ ও সংবাদ সম্মেলনের খবর বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়। একই সফরে তাঁর ভারতের পর পাকিস্তানে যাওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তান তার ভিসা প্রত্যাহার করে নেয়।

সিনেটর কেনেডির ভ্রমণ সম্পর্কে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের শিরোনাম ছিল, ‘ইয়াহিয়ার জন্য আমেরিকার সাহায্য বন্ধ কর, কম্পিত কেনেডি বলেন’ [Halt US aid for Yahya says shaken Kennedy]। দিল্লি থেকে সংবাদটি পাঠিয়েছিলেন ডেভিড লোসাক, যা ছাপা হয় ১৭ আগস্ট সংখ্যায়।

সংবাদটিতে যা ছিল সংক্ষেপে তা এমন—
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি যিনি ভারতের পূর্বাঞ্চলে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করছিলেন তিনি আশা করেন, পূর্ব পাকিস্তানে কোন রকম ‘শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান’ ছাড়া আমেরিকার সরকার পাকিস্তানে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখবে। দিল্লিতে তিনি বলেন, তিনি নিশ্চিত যে, পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা গণহত্যা সংঘটিত করছে।

এটি বোধগম্য যে সিনেটর কেনেডি যিনি সিনেটে শরণার্থী বিষয়ক সাব কমিটির চেয়ারম্যান, বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করতে চাইছেন। কেনেডির শরণার্থীশিবির পরিদর্শনের সময় শিবিরের অবস্থা এবং তাদের দুর্দশা ও অত্যাচারের কাহিনি শুনে কাঁপতে থাকেন।
দিল্লিতে আমেরিকান দূতাবাসে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পাকিস্তান পরিস্থিতির ওপর কূটনৈতিক তার (cable) দেখতে চাইলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে তাঁকে তা দেখতে দেওয়া হয়নি। প্রেসিডেন্টের এ রকম নির্দেশে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অস্ত্র সরবরাহ
সিনেটর কেনেডি জেনেছেন, ভিয়েতনাম থেকে অস্ত্রের চালান পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। এই বিষয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তারা পাকিস্তান থেকে মুক্তি চায়। তিনি মনে করেন, সবচেয়ে ভালো রাজনৈতিক সমাধান হলো পর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দান—যিনি পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় বিচারাধীন আছেন। গতকাল তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন।

কেনেডির ভারত সফর নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট ১৬ আগস্ট একটি প্রতিবেদন ছাপে যার শিরোনাম ছিল, ‘কেনেডির পাকিস্তানে গণহত্যার অভিযোগ, সাহায্য বন্ধের আহ্বান’ [Kennedy charges genocide in Pakistan, urges aid cutoff]।

সংক্ষেপে সংবাদটি হল—
ডেমোক্র্যাট দলীয় ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের সিনেটর আজ পাকিস্তানকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং বিবাদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সব রকম অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখার আহ্বান জানান।

কেনেডি, গত সপ্তাহে চার দিনের সফরে ভারতে আসেন, এই সময়ে তিনি ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন। রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন এবং তার গোপন বিচারের সমালোচনা করে বলেন, শেখ মুজিবের একমাত্র অন্যায় তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন।

সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বের চুক্তিতে আমেরিকার শঙ্কার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন এই সিনেটর এবং ভারতের সঙ্গে আমেরিকার একই রকম চুক্তি হলে তিনি তাকে সিনেটে সমর্থন করবেন বলে উল্লেখ করেন।

ভিয়েতনাম থেকে পাকিস্তানে কোন অস্ত্র পাঠান হয়নি: যুক্তরাষ্ট্র
আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর সংবাদটি দেখেছে এবং এর কোনো প্রমাণ পায়নি বলে জানিয়েছে। দিল্লিতে অবস্থানরত সিনেটর কেনেডি এই অনুসন্ধানের জন্য বলেছিলেন। গত জুন মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং যখন আমেরিকা সফরে যান, তখন পাকিস্তানে আমেরিকা সব ধরনের সামরিক সাহায্য স্থগিত করেছে। পরে নিক্সন প্রশাসন স্বীকার করেছে, ২৫ মার্চের আগে যে চুক্তি হয়েছিল, তার আওতায় সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে।

সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ভারত সফর ও সংবাদ সম্মেলন নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ প্রতিনিধি সিডনি সেনবার্গ দিল্লি থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠান যা ছাপা হয় ১৬ আগস্ট সংখ্যায়। যার শিরোনাম ছিল ‘ভারতে কেনেডি বলেন, পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালাচ্ছে’ [Kennedy, in India, terms Pakistani drive genocide]। প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, কেনেডি অত্যন্ত জোরালো ভাষায় পাকিস্তানের নিন্দা করেছেন এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে জোরালো মত ব্যক্ত করেছেন।

সংবাদটি সংক্ষেপে
সিনেটর কেনেডি আজ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের কার্যক্রমের তীব্র নিন্দা জানান এবং এটিকে একটি গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবের গোপর বিচার, ‘সব আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন।’

ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর তার সপ্তাহব্যাপী ভারত সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিক্সন প্রশাসনের নীতি ও পাকিস্তানে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহেরও ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি করবে। কেনেডি তার সফরের বেশির ভাগ সময় ভারত সীমান্তে নোংরা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নীতি আমাকে স্তম্ভিত করেছে, এটি মনুষ্য তৈরি একটি বিশাল দুর্যোগ।’ এক সপ্তাহ আগে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২০ বছরের বন্ধুত্ব চুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটিতে তিনি কোন অসংগতি দেখেন না। তিনি বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আমেরিকার সঙ্গেও অনুরূপ চুক্তির আগ্রহ দেখিয়েছেন।

তিনি কোন সমাধান প্রদান করতে পারেননি
ভারত-সোভিয়েত চুক্তিটি মূলত পাকিস্তানকে ভারত আক্রমণ থেকে বিরত রাখতে করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা ভারত আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির সম্মুখীন হলে মিলিতভাবে তারা মোকাবিলা করতে পারবে। সিনেটর কেনেডি যিনি সিনেটের শরণার্থী বিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এই সফরে এসেছেন, তাঁর কাছে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান আছে বলে জানাননি। বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকারী গেরিলাদের ভারত আশ্রয় ও অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে বলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করছেন। ভারত যদি গেরিলাদের সাহায্য বন্ধ না করে তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন বলে সাবধান করছেন। ভারতের সাংবাদিকেরা সমস্যার সমাধানে কেনেডির পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। ভারত মনে করে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ও শেখ মুজিবের মুক্তি একমাত্র সমাধান।

সিনেটর কেনেডির পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল এবং তিনি সেখানে যাওয়ার ভিসা নিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে বলেছে তাঁর পাকিস্তান সফর কোন ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে না, কারণ ভারতে এসে তিনি যে একপেশে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে বোঝা যায় তিনি ভারতীয় প্রচারণার স্বীকার। (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]